লিখুন
ফলো

আইফেল টাওয়ারের ইতিকথা

আপনি জানেন কি ১৮৮৯ সালের পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থাপনাটির নাম “আইফেল টাওয়ার”। এটি ৩ যুগের বেশি সময় বিশ্বের উচ্চতম টাওয়ারের আসন দখলে রেখেছিলো। কালক্রমে লোহা নির্মিত এই স্থাপত্যটি হয়ে উঠে ফ্রান্সের রাজধানি প্যারিসের আইকন। ১৮৮৯ সালে প্যারিসের চ্যাম্প ডি মার্সে নির্মাণ করা হয় এই বিশ্বসেরা স্থাপনাটি। আইফেল টাওয়াররের জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি যে প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ আসেন শুধু একবার এই টাওয়ার দেখার জন্য, যার ৭৫% বিভিন্ন দেশের ট্যুরিস্ট। 

আইফেল টাওয়ার তার অপুর্ব স্থাপত্যশৈলী আর জনপ্রিয়তা দিয়ে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তভুক্ত স্থাওনার একটি। জনপ্রিয়ার শীর্ষ স্থানে অবস্থান করা আইফেল টাওয়ার নিয়েই আজকের ব্লগ। ।  

যেভাবে যাত্রা শুরু করে  আইফেল টাওয়ার 

সূত্রঃ আইফেল টাওয়েরের নিজস্ব ওয়েব https://www.toureiffel.paris/

ফরাসীদের কাছে ফরাসী বিল্পবের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই ফরাসী বিল্পবের শতবছর পালনকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বুকে প্যারিসের অবস্থান জানান দিতে নানান পরিকল্পনা করা হয় যার একটি ছিলো রাজধানী প্যারিসে বিশ্ব মেলার আয়োজন। বিশ্বমেলার প্রবেশদ্বারটি সবার থেকে আলদা করার চিন্তা থেকেই যাত্রা পথ শুরু হয়েছিলো আইফেল টাওয়ারের। টাওয়ার নির্মানের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয় প্যারিসের সেসময়ের সফল প্রকৌশলী আলেকজান্ডার গুস্তাভ আইফেলকে আর তার সাথে টাওয়ারের নকশার কাজ করেন প্রকোশলি মরিস কোচিন ও এমিল নুগুইয়ার। গুস্তাভ আইফেলে প্রকৌশ জীবনের সেরা কাজ ছিলো আইফেল টাওয়ার তার নাম অনুসারেই আইফেল টাওয়ারের নামকরণ করা হয়। 

অনন্য অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী আর অনবদ্য প্রযুক্তির নিদর্শন আইফেল টাওয়ার। বিশ্বকে অবাক করে দেওয়া আইফেল টাওয়েররে নির্মাণ যাত্রা শুরু হয় ১৮৮৭ সালের ২৮ জানুয়ারত।  ২ বছর ২ মাস ৫ দিন পর ৩১ মার্চ ১৮৮৯ সালে অসাধারণ স্থাপনাটির কাজ শেষ হয়। যার  ৫ মাসেই ফাউন্ডেশোনের কাজ করা হয়।    

অবাক করার হলেও সত্যি মাত্র ২০ বছরের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিলো এই টাওয়ার। কিন্তু ধীরে ধীরে  স্থাপনাটি বিশ্বের দরবারে প্যারিসকে আরো জনপ্রিয় করে তোলে মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে  আইফেল টাওয়ারের প্রতি।  বিভিন্ন কাজেও ব্যবহার শুরু হয় আইফেল টাওয়ার, যার মধ্য রয়েছে ১৮৯৮ সালে প্রথম প্যানথিয়ন টাওয়ার থেকে রেডিও সংকেত গ্রহণ করে, ১৯০৩ সালে সামরিক রেডিও পোস্ট হিসাবে ব্যবহার এবং ১৯২৫ সালে প্রথম পাবলিক রেডিও প্রোগ্রাম। বর্তমান  এবং তারপরে আরও সম্প্রতি টিএনটি-তে টেলিভিশন সম্প্রচার করে। বর্তমানেও আইফেল টাওয়ার তার ভূমিকা রাখছে।

 খুঁটিনাটি আইফেল টাওয়ার    

এই লোহ্যনির্মিত স্থাপনাটির উচ্চতা ১,০২৪ ফুট। ৭৫ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত  টাওয়ারটির চূড়া দেখতে পারবেন। পুরো টাওয়রে  তিনটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশ অর্থাৎ মাটি থেকে এর  উচ্চতা ১৮৭ ফুট আর আয়তন ১৪,৪৮৫ বর্গফুট। দ্বিতীয় অংশের উচ্চতা ৩৭৭ ফুট যেটি আয়োতনে ৪,৬৯২ বর্গফুট। উপরের অংশটির আয়তন ৮২০ বর্গফুট এবং উচ্চতায় ৯০৬  ফুট।  টাওয়ারে উপরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি আর লিফট দুই ব্যবস্থাই রয়েছে।

আইফেল টাওয়ারের উচ্চতার পরিবর্তন হয় এই বিষয়টি জানেন কি? জি  ঠিকই  আইফেল টাওয়ার রড আয়রোনের তৈরি আর তাই ঋতুভেদে তাপমাত্রা পরিবর্তনের প্রভাব পরে  টাওয়ারের উচ্চতায়।  গ্রীষ্মকালে  তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে প্রসারিত হয় আইফেল টাওয়ার এত্র উচ্চতা ৬ ইঞ্চি মত বৃদ্ধি পায়। শীতকালে পুর্বের উচ্চতা ফিরে পায় এই টাওয়ার। 

আইফেল টাওয়ার নির্মাণ কিন্তু সেসময়ে এক মহা আয়োজন ছিলো।এতে কাজ করেছিলেন ৩০০ জন নির্মাণ শ্রমিক। আইফেল টাওয়ারের মোট ওজন ১০ হাজার ১শ টন যার মধ্য ধাতব ফ্রেমের ওজন ৭,৩০০ টন। ২৫ লাখ নাটবল্ট ব্যবহার করা হয় এই টাওয়ারে।

লিফট 

প্রথমে আইফেল টাওয়ারের ভেতরে যায়ার অনুমতি না থাকলেও ১৮৮৯ সালের ৬ মে থেকে  টাওউয়ারের ভেতরের অংশে দর্শনার্থীরা যেতে পারতেন তবে প্রথম অবস্থায় লিফট ছিলো না। তাই ১৭১০টি ধাপ সিড়ি পার করে উপরে যেতে হতো। ১৮৮৯ সালের জুন মাসে ৫টি হাইড্রোলিক লিফট চালু করা হলেও পরবর্তীতে লিফট আধুনিকরন করা হয়।  তবে মজার বিষয় , এখনো দুটি হাইড্রোলিক লিফট ব্যবহার করা হয়।  

লাইট আর কপিরাইট আইন 

 আলো ঝলমলে রাতের আইফেল টাওয়ার আমাদের সবাইকে আরো বিমোহিত করে। এই আলোকিত টাওয়ারের আলোর মূলে রয়েছে ৬ ওয়াটের ২০ হাজার বাল্ব,৩৩৬টি প্রজেক্টর ১টি বিকন লাইট। ইলেকট্রিশিয়ান এবং আলোক প্রকৌশলী পিয়েরি বিদাউ ১৯৮৫ সালে টাওয়ারটির আলোক সংযোগের কাজ করেন। আইফেল টাওয়ারের আলোর সৌন্দর্য আর প্যারিসের ইকোনমিক্স দুইয়ের ব্যালেন্স এবং বিদ্যুতের রোধ করতে সন্ধ্যা থেকে রাত ১ টা পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় ১ বার করে ৫ মিনিটের জন্য আলোকিত হয়ে বিশ্বে নিজের আভিজাত্য প্রকাশ করে আইফেল টাওয়ার।  

আপনি যদি ফটোগ্রাফার হন আর রাতের আইফেল টাওয়ারের ছবি বিক্রি করতে চান তবে জেনে রাখুন ইউরোপে কপিরাইট আইনের এটি বেআইনি।  ইউরোপ মহাদেশের দেশগুলোতে জনপ্রিয় স্থাপত্যের নির্মাতার মৃত্যুর ৭০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট আঈণেড় অধীনে থাকে। আর এ কারণেই দিনের আইফেল টাওয়ারের ছবি বিক্রী বেআইনি নয়। অন্যদিকে আলোক প্রকৌশলী পিয়েরি বিদাউ এখনো জীবিত থাকার কারণে কপিরাইট আইনটি বহাল রয়েছে এখনো।

সূত্রঃ আইফেল টাওয়েরের নিজস্ব ওয়েব https://www.toureiffel.paris/

পেইন্টিং কান্ড 

আইফেল টাওয়ারের মত প্রকাণ্ড টাওয়ার রং করা কিন্তু সহজ বিষয় নয়৷ টাওয়ারটি রঙিন করে তোলার জন্য প্রয়োজন হয় ৬০ টন রং। ২৫ জন শিল্পীর তুলির ছোয়ায় আইফেল টাওয়ার রং করতে সময় লাগে ১৮ মাস। যাতে ব্যবহার হয় ৫ হাজার শিরিষ কাগজ, ১ হাজার ৫০০টি তুলি, ১ হাজারটি স্ত্রাপার, ১ হাজার জোড়া সেফটিক চামড়ার গ্লোভস সেট।  কিন্তু রং করার সময় কখনোই বন্দ রাখা হয়না আইফেল টাওয়ার তাই দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার জন্য ৫০ কিলোমিটার এরিয়ায় সেফটি লাইন এবং ২ হেক্টর অঞ্চল জুড়ে বুভার করা হয় সেফটি নেট। আইফেল টাওয়ারের পেইন্টিং খরচ প্রায় ৪ মিলিয়ন ইউরো।  

টাওয়ারটি গড় সময়ের হিসেবে ৭ বছর অন্তর অন্তর এ পর্যন্ত ১৮ বার ভিন্ন ভিন্ন র রং করা হয়েছে।  বর্তমানে টাওয়ারটির রং ব্রোঞ্জ কালার। নির্মাণের পর আইফেল টাওয়ার প্রথম হাতে রং করা হয়েচিলো এই ঐতিহ্য বজার রাখতে আজো একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় রং করতে। সব মিনিয়ে আইফেল টাওয়ার রং করতে ব্যয় হয় প্রায় ৪ মিলিয়ন ইউরো।     

১৯০০ সালের দিকে আইফেল টাওয়ার নিয়ে লেখা  “The 300-Meter Tower” বইটিতে  প্রকৌশলী  আইফেল লিখেছিলেন, আমরা অনেকেই  টাওয়ারটি রং করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি আমলে না নিলেও আইফেল টাওয়ার দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য রং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।     

সূত্রঃ আইফেল টাওয়েরের নিজস্ব ওয়েব https://www.toureiffel.paris/

আইফেল টাওয়ারের রেস্টুরেন্ট

আইফেল টাওয়ারে বাইরের দৃশ্যর সাথে ভোজনের আইডিয়া কিন্তু মন্দ নয়। এই টাওয়ারে রয়েছে কয়েকটি রেস্টুরেন্ট আর বার রয়েছে। ১৮৮৯ সালে বিশ্ব মেলায় আয়োজনে দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে নিচ তালায় মোট ২ হাজার জনের জন্য ৪ টি কাঠের রেস্টুরেন্টের নকশা করেন স্টিফেন সৌভেস্ত্রে । আইফেল টাওয়েররের ভেত্রের সব রেস্টুরেন্ট ফাইফ স্টার এদের কিছুতে আগে বুকিং দিতে হয়। এদের মধ্য দ্যা বুফেট (The Bufet) , দ্যা জুলিস ভেরনি (The Jules Verne) অন্যতম।  

আইফেল টাওয়ারের রেপলিকা 

বর্তমানের উচ্চত্র টাওয়ার দুবাইয়ের বুজ খলিফা হলেও জনপ্রিয়ার শীর্ষ এখনো আইফেল টাওয়ার এগিয়ে আছে। বিশ্ববাসির ভালোবাসায় আইফেল টাওয়ারের জনপ্রিয়তার কমটি নেই তাই তো বিশ্বের নানান দেশ আইফেল টাওয়ার অনুকরণ করে টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। ৫৪১ ফুট উচ্চতার যুক্তরাষ্টের লাস ভেগাসের রেপলিকা আইফেল টাওয়ারটি সবচাইতে বড়। বিলাসবহুল হোটেল ক্যাসিনো কমপ্লেস ১৯৯৯ সালে এঈ নির্মাণ করেছিলো এই রেপলিকা টাওয়ারটিও জনপ্রিয়।  চায়নাতেও ২টি রেপলিকা আইফেল টাওয়ার রয়েছে। 

আইফেল টাওয়ারের বয়স প্রায় ১৫০ বছর হয়ে গেলেও  আজো আমাদের তার মায়া জ্বালে আবদ্ধ মুগ্ধ করে রাখে।  বিভিন্ন ইভেন্টসের সূচনা হয় এই টাওয়ার থেকেই। শত প্রেমের সূচনার সাক্ষী আইফেল টাওয়ার। নিউ ইয়ার উদযাপনে নানান আয়োজন করা হয় এই টাওয়ার কেন্দ্র করে। আইফেল টাওয়ারের অনন্য আর সেরা বলেই বরতামের উচ্চতর টাওয়ারের আইকন।   

সুত্রঃ আইফেল টাওয়ারের ওয়েবসাইট, হিস্টোরি চ্যানেল ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া।

https://www.toureiffel.paris/en/the-monument

https://www.history.com/topics/landmarks/eiffel-tower

https://roar.media/bangla/main/tech/interesting-facts-of-eiffel-tower

https://bn.fullersociety.com/strange-reason-why-its-illegal-take-nighttime-photos-eiffel-tower-864487

Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous Article

পাইলট থেকে ট্রাক ড্রাইভার-এয়ারলাইন ক্যারিয়ার কোভিড-১৯ মহামারী দ্বারা যে ভাবে ধ্বসে গেলো

Next Article

কন্সপিরেসি থিওরিষ্টদের চোখে 'এরিয়া ৫১'

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন

Total
0
Share