লিখুন
ফলো

আন্দেজ পর্বতমালায় নিখোঁজ এক বিমানের অমীমাংসিত রহস্য

১৯৪৭ সালের ২রা আগস্ট। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্স থেকে চিলির সান্টয়াগোর উদ্দেশ্যে আকাশে উড়ছে একটি যাত্রিবাহী বিমান। বিমানের চালকের আসনে যিনি রয়েছেন তিনি হলেন রেজিনাল্ড কুক। রেজিনাল্ড কুক ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন সাবেক ব্রিটিশ বৈমানিক। সেসময় তিনি আকাশে উড়তেন যুদ্ধবিমান নিয়ে। আকাশ পথে নিজের সবরকম কসরত দেখিয়ে অসংখ্য শত্রুর মোকাবেলা করেছেন। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে অবশ্য অবসরে যান এবং বেসামরিক বিমানের পাইলট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। বিমানের কো-পাইলটের আসনে যিনি রয়েছেন তিনিও ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন সাবেক বৈমানিক। তার নাম ছিল হিল্টন কুক।
ব্রিটিশ সাউথ আমেরিকান এয়ারওয়েজের এই বিমানটি “স্টারডাস্ট” নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত ছিল। অবশ্য এই বিমানটি নির্মাণ করা হয়েছিল ফাইটার জেট হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়েছিল যুদ্ধবিমান হিসেবেই। সেসময় “ল্যাংক্যাস্টার বোম্বার” নামে পরিচিত এই বিমানটি অনেকগুলো সফল অভিযানে অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হলে কিছু মডিফিকেশনের মাধ্যমে রূপান্তর করা হয় যাত্রিবাহী বিমান হিসেবে। নাম দেওয়া হয় “স্টারডাস্ট”।

মোট ছয়জন যাত্রী এবং পাঁচজন ক্রু নিয়ে আকাশে উড়ছিল স্টারডাস্ট। পাঁচজন ক্রুর সবাই ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাবেক বৈমানিক। বিমানটি ছিল বেশ নির্ভরযোগ্য। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাবেক বৈমানিক হওয়ার কারণে ক্রুরাও ছিলেন বেশ অভিজ্ঞ।

আন্দেজ পর্বতমালা
নিখোঁজ সেই বিমানটি; image: wikimedia commons

স্টারডাস্ট থেকে বার্তা পাঠানো হলো সান্টিয়াগো বিমানবন্দরে। জানানো হলো আর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা সান্টিয়াগো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। কিছুক্ষন পর আবারও একটি বার্তা পাঠানো হলো। কিন্তু সান্টিয়াগো বিমানবন্দরের রেডিও অপারেটর “স্টেনডেক” নামে এই বার্তার কোনো অর্থই খুঁজে বের করতে পারলেন না। তাই তিনি পাইলটের কাছে এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। কিন্তু পাইলট আগের বার্তাটিই পুনরাবৃত্তি করলেন। রেডিও অপারেটর এবারও কিছুই বুঝতে পারলেন না। তারপর সবকিছু নিরব হয়ে গেল। আর কোনো বার্তাও পাওয়া গেল না। এমনকি ওই বিমানের সাথে আর কোনো প্রকার যোগাযোগই করা গেল না।

কোনোভাবেই যখন যোগাযোগ রক্ষা করা গেল না তখন শুরু হয়ে গেল উদ্ধার তৎপরতা। উদ্ধারকারী বিমানগুলো আন্দেজ পর্বতমালার উপর দিয়ে চিলের মত খুঁজে ফিরতে লাগল স্টারডাস্টকে। কিন্তু কোনোভাবেই স্টারডাস্টের হদিস পাওয়া গেল না। কিভাবে একটি বিমান হারিয়ে গেল তা অবাক করলো সবাইকে। ১৯৪৭ সালের সেই দিনগুলিতে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী তৈরি হয় বিভিন্ন প্রকার জল্পনা এবং কল্পনা। এই কল্পনা দানা বাঁধতে শুরু করে তখন, যখন দীর্ঘদিন চেষ্টা চালিয়েও বিমানের কোনো ধ্বংসাবশেষ কিংবা ক্রু অথবা যাত্রীদের কাউকেই খুঁজে পাওয়া গেল না। অথচ পাইলট বিমানবন্দরে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন সেখানে বলা হয়েছিল তারা মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন। সে হিসেবে ধারণা করা হয়েছিল যে, বিমানটি যদি বিধ্বস্ত হয় তাহলে বিমানবন্দরের নিকটবর্তী কোনো জায়গাই হওয়ার কথা।

রেজিনাল্ড কুক; image; wikimedia commons

ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই বিমান নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ছড়িয়ে পড়ল। তৈরি হলো বিভিন্ন ধরণের গল্প এবং কল্পকাহিনী। অধিকাংশ ইউরোপিয়ানই তখন দক্ষিণ আমেরিকা সম্পর্কে তেমন কিছু জানতো না। অনেকেই ধারণা করে বসল রেজিনাল্ড কুক হয়তো বিমান নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার কোনো আদিবাসীদের মাঝে নেমেছেন। সেই আদিবাসীরাই হয়তো তাকে দেখেশুনে রেখেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন তিনি আর ফেরত আসলেন না, তখন এই গল্পগুলো অযৌক্তিক বলে মনে হতে শুরু করল। এখন হয়তো এসমস্ত গল্প অনেকের কাছে অলীক কল্পনা বলেই মনে হবে। কিন্তু একটা বিমান কেন হারিয়ে গেল তার যৌক্তিক কারণ কেউই যখন খুঁজে পাচ্ছে না, তখন তো এটির ভাগ্যে এমন কোন আজব ব্যাপারই ঘটেছে। অনেকে আবার ভেবে বসল ভিনগ্রহের কোন মানুষ কিংবা এলিয়েন এসে বিমানটিকে নিয়ে গেছে।

আজকের যুগে এরকম গল্প বা চিন্তাকে কেউ হয়তো এক মুহূর্তের জন্যও পাত্তা দিবেন না। কিন্তু আজ থেকে প্রায় পৌনে এক’শ বছর পূর্বে এই গল্পগুলো অনেকের কাছেই সত্য বলে মনে হয়েছিল। এর পরেও উদ্ধার কার্যক্রম এবং অনুসন্ধান অব্যাহত রাখা হয়।

আন্দেজ পর্বতমালার প্রতিটি গিরিখাত, উপত্যকাসহ এমন কোন অঞ্চল নেই যেখানে পদাতিক অভিযাত্রী এবং বিমানের মাধ্যমে অনুসন্ধান করা হয়নি নিখোঁজ বিমানের। এভাবেই কেটে গেছে অর্ধশতক। কিন্তু কোনোভাবেই সেই বিমানের হদিস পাওয়া যায়নি।

পাঁচ দশকের এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বেশ কয়েক বার শোনা গিয়েছিল যে সেই নিখোঁজ বিমানটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে তদন্ত এবং অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখা গিয়েছে যে বিমানটি স্টারডাস্ট নয়। কিন্তু কিভাবে নিখোঁজ হয়েছিল সেই বিমানটি?

নিখোঁজ
image: Wikipedia

স্টারডাস্ট নিখোঁজ হওয়ার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ একদিন সেই বিমানের কো-পাইলট হিল্টন কুকের ভাতিজা ক্রিস্টোফার কুক তার বন্ধুর কাছ থেকে একটি ফোন কল পেলেন। তার বন্ধু তাকে জানালেন যে, “তোমার চাচার নিখোঁজ হওয়া সেই বিমানটির খোঁজ পাওয়া গেছে।” ক্রিস্টোফার কুক একথা শুনে তড়িঘড়ি করে টেলিভিশন ছেড়ে দিলেন। চোখ রাখলেন ব্রেকিং নিউজে। সেখানে স্পষ্টই দেখা গেল এবার সত্যিই স্টারডাস্টের খোঁজ মিলেছে। ঘটনাটি সারা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোতে তোলপাড় সৃষ্টি করল। ৫৩ বছর পর এসে বিমানটি যে খুঁজে পাওয়া যাবে অনেকে সেটা ভাবতেও পারেনি।

বিশ্ববাসী স্টারডাস্টের কথা যেন ভুলেই গিয়েছিলেন। কিন্তু মনে রেখেছিলেন ওই বিমানে আরোহী যারা ছিলেন তাদের নিকট আত্মীয়রা। তাদের কাছে যখন এই সংবাদ পৌঁছল তারা বেশ অবাকই হয়েছিল। বিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে আটজনের দেহাবশেষ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। বাকি তিনজনের দেহাবশেষ তখনও পাওয়া যায়নি। তাই পরিচয় নির্ণয়ের জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যায় রেজিনাল্ড কুক এবং ক্রিস্টোফার কুকের দেহাবশেষ সেখানে রয়েছে। স্টারডাস্ট’-এর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল আন্দেজ পর্বতমালার ১৩ হাজার ফুট উঁচু একটি স্থানে। কিন্তু কেন এত বছর অনুসন্ধান চালানোর পরও বিমানটি খুঁজে পাওয়া গেল না?

image: insider.com
বিমান দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন যে তদন্তকারী দল, তারা এর একটি সঠিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারা জানালেন কেন পাঁচ দশক সময় লেগেছে বিমানটিকে খুঁজে পেতে। যদিও এর সঠিক তথ্য প্রমাণ তারা দেখাতে পারেনি। এটা শুধু তাদের ধারণা মাত্র।

স্টারডাস্ট সোজা আন্দেজ পর্বতমালার মাউন্ট টুপুনগাটোতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছিল। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই তুষারপাতের ফলে তুষারের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। এ কারণেই ঘটনার পর পরই যেসব তল্লাশি দল এবং উদ্ধারকারী বিমান পাঠানো হয়েছিল তারা স্টারডাস্টকে খুঁজে পায়নি। এমনকি উদ্ধারকারী বিমানগুলো এর উপর দিয়ে একাধিকবার উড়ে গেলেও তুষারের নিচে চাপা পড়ে থাকার কারণে স্টারডাস্টকে তারা দেখতে পায়নি। এই তুষার পরে জমে গ্লেসিয়ার বা হিমবাহে পরিণত হয়। আর বহু বছর পর গ্লেসিয়ার যখন গলতে শুরু করল তখন বিমানটির খোঁজ পাওয়া গেল।

কিন্তু আর্জেন্টিনার তদন্তকারী দল একটা বিষয় স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিলেন না। স্টারডাস্ট’-এর ক্রুদের দেয়া সর্বশেষ বার্তা অনুযায়ী এটি বিমানবন্দরে অবতরণ থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের দূরত্বে অবস্থান করছিল। দুইজন অভিজ্ঞ পাইলটের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিমানটি কিভাবে বিমানবন্দর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে বিধ্বস্ত হয়? এই প্রশ্নের উত্তর তারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত অনেক তদন্ত এবং তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, এই ঘটনার জন্য দায়ী ছিল জেট স্ট্রিম বা তীব্র বায়ুপ্রবাহ।

জেট স্ট্রিম অনেক সময় বায়ুমণ্ডলের নিচের দিকের বায়ুপ্রবাহের একেবারে উল্টো দিকে চলে। এখানে বাতাসের গতি এত তীব্র থাকে, যে তা এর বিপরীত দিক থেকে আসা বিমানের গতি অনেকখানি কমিয়ে দিতে পারে। এর ফলে পাইলটরা হিসেবে ভুল করতে পারেন। তারা যতখানি দূরত্ব পাড়ি দিয়েছেন বলে হিসেব করছেন, তার চেয়ে তারা হয়তো অনেক দূরে আছে। স্টারডাস্ট’ এর ক্ষেত্রে হয়তো এরকম কিছুই ঘটেছিল। পাইলট হয়তো ভেবেছেন তিনি একটি উঁচু পর্বত পাড়ি দিয়ে এসেছেন। কিন্তু মেঘ ফুঁড়ে নিচে নেমে আসতেই তিনি হয়তো ওই পর্বতটার উপর গিয়েই বিমানটিকে আঁছড়ে ফেলেছেন। ওই তদন্ত দলের প্রধান কর্মকর্তা কার্লোস সুরিনি দাবি করেন, স্ট্যারডাস্টের ক্ষেত্রে ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছিল।

জেট স্ট্রিম; image: wikimedia commons
আজকের যুগে পাইলটদের কাছে আবহাওয়ার অনেক চার্ট থাকে। এ যুগে পাইলট হতে হলে অবশ্যই জানতে হয়, জেট স্ট্রিম কিভাবে তৈরি হয়। কিন্তু এই জেট স্ট্রিমের ব্যাপারে স্টারডাস্ট’-এর ফ্লাইট ক্রুদের কোন ধারনাই ছিল না। যেদিন স্টারডাস্ট দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল সেদিন আসলেই এরকম জেট স্ট্রিম তৈরি হওয়ার মত আদর্শ আবহাওয়া ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার ৫৩ বছর পরে এসে এই ঘটনার কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া গেল।

বিমানের আরোহীদের মধ্যে যাদের দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল, তাতে কয়েকটি হাড়গোড় ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না।

রেজিনাল্ড কুকের দেহাবশেষ নিয়ে আসা হয় লন্ডনে। সেখানে তার স্ত্রীর সমাধির পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। বিমানের অন্যান্য আরোহীদের দেহাবশেষ কবর দেওয়া হয় আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সের ব্রিটিশ সমাধিতে। কিন্তু সবকিছুর সমাধান সঠিকভাবে হলেও একটা বিষয় এখনও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। স্টারডাস্ট থেকে পাঠানো সেই সর্বশেষ বার্তা “স্টেনডেক” এর মানে কি? সেটা আজও কেউ বুঝতে পারেনি। যা এখনও অমীমাংসিত রহস্যই হয়ে রয়েছে।

আরো পড়ুন:

This is a Bengali article. It is about a missing plane “stardust”.

All the references are hyperlinked within the article.
Featured Image: Etihashnama Blog
Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous Article

বাংলাদেশে ভাস্কর্য সংস্কৃতি কিভাবে এলো?

Next Article

কাঞ্চনজঙ্ঘা: তুষারধবল শুভ্রতায় আচ্ছাদিত ওপারের স্বর্গ

Related Posts

ইহুদীবাদী ইসরায়েলের ইতিহাস (৫ম পর্ব): বিশ্ব রাজনীতি এবং ফিলিস্তিন পরাজয়

বিংশ শতাব্দীর পুরােটা সময় জুড়ে মধ্যপ্রাচ্য সংকট যত বেশি আলােচিত হয়েছে, অন্য কোনাে সংকট এত বেশি আলােচিত হয়নি।…

ইসরায়েলি ষড়যন্ত্রের হাজার বছরের ইতিহাস

ইহুদিদের আবির্ভাব মানব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহল কোনাে যুগেই কম ছিল না। আজকের…

বেনসন অ্যান্ড হেজেস : রাজকীয় ব্রিটিশ সিগারেটের সাতকাহন [পর্ব-১]

পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত ব্র্যান্ডের নাম নিতে গেলে বেনসন অ্যান্ড হেজেস এর নাম সামনের দিকেই থাকবে। ধূমপায়ীরা তো বটেই…

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন

Total
0
Share