লিখুন
ফলো

ইন্টেল : বিশ্বের সর্ববৃহৎ সেমিকন্ডাক্টর চিপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান [পর্ব – ১]

শিরোনাম দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আজকের লেখা ইন্টেল কর্পোরেশনকে নিয়ে। প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক,ইন্টেল কর্পোরেশনকি?

ইন্টেল হলো একটি আমেরিকান বহুজাতিক কর্পোরেশন এবং টেকনোলজি কোম্পানি। এটির প্রধান কার্যালয়ের অবস্থান ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিরসান্তা ক্লারায়। লভ্যাংশের দিক থেকে হিসাব করলে এটি বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে দামী সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। তারা প্রস্তুত করেএক্সএইটিসিক্স (x86)সিরিজের মাইক্রোপ্রসেসর, যেগুলো দুনিয়ার বেশিরভাগ পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসিতে ব্যহৃত হয়। ২০১৮ সালেফরচুন ৫০০এর করা সবচেয়ে ধনী আমেরিকান কোম্পানির তালিকায় তাদের অবস্থান ছিলো ৪৬ নম্বরে।

ইন্টেল
Image Source : sisystems.co.za

লেনোভো, এইচপি, ডেলএর মত কম্পিউটার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ইন্টেল মাইক্রোপ্রসেসর সরবরাহ করে থাকে। মাইক্রোপ্রসেসর ছাড়াও তারা মাদারবোর্ড চিপসেট, নেটওয়ার্ক ইন্টারফেস কন্ট্রোলার, ইন্টেগ্রেটেড সার্কিট, ফ্ল্যাশ মেমোরি, গ্রাফিক্স চিপ, এম্বেডেড প্রসেসরসহ কমিউনিকেশন এবং কম্পিউটিং এর সাথে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরী করে।

সূচনা

ইন্টেল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসের ১৮ তারিখে। দুই আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট নয়েস এবং গর্ডন মুর এর প্রতিষ্ঠাতা। তরুণদের গ্যারাজে জন্ম নেওয়া স্টার্ট-আপের বিশ্বজয়ের যে সিলিকন ভ্যালীয় সফলতার কথা আমরা নিয়মিত শুনে থাকি, ইন্টেল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। ইন্টেলের শুরু হয় ২.৫ মিলিয়ন ডলারের মূলধন নিয়ে। এই অর্থের সংস্থান করেন আর্থার রক নামক এক আমেরিকান ব্যবসায়ী। অ্যাপলসহ আরো কিছু টেক জায়ান্টের সাথে জড়িয়ে আছে রকের নাম। রবার্ট এবং গর্ডন ছিলেন অভিজ্ঞ, মধ্যবয়সী প্রযুক্তিবিদ; যারা ইতোমধ্যেই নিজেদের ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছিলেন।

নয়েস মহাব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি করতেনফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডাক্টরএ, এটি ছিলোফেয়ারচাইল্ড ক্যামেরা অ্যান্ড ইন্সট্রুমেন্টনামক কোম্পানির একটি বিভাগ। এখানে কর্মরত থাকা অবস্থাতেই ১৯৫৯ সালে তিনিসিলিকন ইন্টেগ্রেটেড সার্কিটসহ-প্রতিষ্ঠা করেন।

Image Source : npr.org

অন্যদিকে মুর ছিলেন ফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডাক্টরের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট শাখার প্রধান।

ইন্টেল প্রতিষ্ঠার পরপরই নয়েস এবং মুর ফেয়ারচাইল্ডে কাজ করা অন্যান্যদের নিজেদের কোম্পানিতে নিয়ে আসতে শুরু করেন। এদের মধ্যে ছিলেন হাঙ্গরীয় বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ীঅ্যান্ড্রু গ্রুভ।কোম্পানির প্রথম তিন দশকে নয়েস, মুর এবং গ্রুভ এই তিনজন পর্যাক্রমে চেয়ারম্যান এবং চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) এর দায়িত্ব পালন করেছেন৷

লোগো এবং স্লোগান

ইন্টেলের প্রথম লোগো ডিজাইন করেন প্রতিষ্ঠাতা নয়েস এবং গর্ডন। এরপর আরো বার কয়েক পরিবর্তিত হয়ে তাদের লোগো বর্তমান রুপ লাভ করে। ইন্টেলের বর্তমান লোগোতে বিদ্যমান নীল রং এখানকার লোকদের মনে থাকা পরাক্রমশালীতার প্রতিনিধিত্ব করে। তারা যে কম্পিউটার এবং প্রযুক্তি সম্পর্কিত নতুন নতুন হাই-টেক পণ্য এবং নতুনত্ব নিয়ে আসে তারও প্রতীক এই নীল রং। এছাড়া এই রং জ্ঞান, বিশ্বস্ততা, প্রশান্তি, বুদ্ধিবৃত্তি এবং নীতিবোধেরও প্রকাশক। লোগোতে বিদ্যমান আরেকটি রং হলো সাদা। সাধারণত শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এই রংয়ের আলাদা মাহাত্ম্য রয়েছে। এটি দ্বারা আভিজাত্য এবং শুদ্ধতা প্রকাশিত হয়। গত বছর তাদের নতুন প্রযুক্তির লঞ্চিং ইভেন্টে তারা আগামী দশকের জন্য তাদের লোগো উন্মোচন করে। এই দশকে তাদের লোগো অনেক মিনিমালিস্টিক এবং নতুন রংও যুক্ত হচ্ছে তবে আগের মত নীল রংয়ের রয়েছে আধিপত্য এবং ইন্টেলও ভুলছে না তার অতীতকে।

Image Source : technosports.co.in

লোগোর মত ইন্টেলের স্লোগানও বদলেছে কয়েকবার। তাদের বর্তমান স্লোগান হলো “What’s inside has never mattered more.

চিপ ছাড়াও যে তারা বর্তমানে আরো নানা যন্ত্রাংশ তৈরী করছে সে ব্যাপারে ইঙ্গিত করা হয়েছে এখানে। আর তারা যে কম্পিউটিং এবং প্রযুক্তিকে আরো এগিয়ে নিতে চায় সেটিও প্রকাশিত হয় এর মাধ্যমে।

প্রথমদিকের পণ্য, সাফল্য এবং ব্যর্থতা

ইন্টেল প্রথমদিকে মেমোরি চিপ বানাতো। তারাই সর্বপ্রথম মেটাল অক্সাইড সেমিকন্ডাক্টরতৈরী করে। ১১০১নামে পরিচিত এই চিপটি ব্যবসায়িকভাবে সফলতা পায়নি। তবে এটির উত্তরসূরী বাণিজ্যিকভাবে বেশ সফলতা লাভ করে। ১১০৩নামে পরিচিত এই চিপটি ছিলো একটি ওয়ান-কিলোবিট র‍্যান্ডম-অ্যাক্সেস মেমোরি চিপ। সংক্ষেপে এটিকে ড্র্যাম/DRAMনামে ডাকা হতো। এটিই প্রথম মেমোরি চিপ যেটির বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণ করার সক্ষমতা ছিলো। ১৯৭০ সালে আমেরিকান টেকনোলজি কোম্পানি হানিওয়েল ইনকর্পোরেটেডপ্রথম এই চিপ ব্যবহার করে। তারা তাদের কম্পিউটারে যেসব কোর চিপ ব্যবহার করতো, তার বদলে এগুলো ব্যবহার করতে আরম্ভ করে। হানিওয়েলের ড্র্যাম চিপগুলো ব্যবহার করার কারণ এগুলোর দাম ছিলো কম এবং কম শক্তি ব্যবহার করে কাজ সম্পন্ন করার সক্ষমতা ছিলো। সহসাই বিশ্বব্যাপী কম্পিউটারে মেমোরি ডিভাইস হিসেবে ড্র্যাম চিপ ব্যবহার করার ব্যাপারটি স্ট্যান্ডার্ডে পরিণত হয়।

ড্র্যাম চিপের সফলতার পর ১৯৭১ সালে ইন্টেল পাবলিক কোম্পানিতে পরিণত হয়। সেই বছরই তারা নিয়ে তাদের ইরেজেবল প্রোগ্রামেবল রিড-অনলি মেমোরি চিপনিয়ে আসে। এই চিপগুলো সংক্ষেপে ইপ্রোম/EPROMনামে পরিচিত ছিলো। ১৯৮৫সালের আগপর্যন্ত এগুলোই ছিলো ইন্টেলের সবচেয়ে সফল প্রোডাক্ট। এই ১৯৭১সালেই কোম্পানির তিন ইঞ্জিনিয়ার টেড হফ, ফেদেরিকো ফ্যাগিনএবং স্ট্যান ম্যাজোরমিলে তৈরী করেন একটি জেনারেল-পারপাস ফোর-বিট মাইক্রোপ্রসেসর।এটি ছিলো পৃথিবীর প্রথম সিঙ্গেল-চিপ মাইক্রোপ্রসেসরগুলোর একটি। ৪০০৪নামে পরিচিত এই চিপগুলো বানানোর কন্ট্র্যাক্ট পায় তারা জাপানী ক্যালকুলেটর প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান নিপ্পন ক্যালকুলেটিং মেশিন কর্পোরেশন এর কাছ থেকে। চুক্তির ফলে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সম্পর্কিত সকল অধিকার রয়ে যায় ইন্টেলের কাছেই।

Image Source : decadecounter.com

সফলতা আর ব্যর্থতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে। সবার মত ইন্টেলের ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। তাদের প্রথমদিকের সবগুলো প্রয়াস সফলতা লাভ করেনি। ১৯৭২সালে কর্তৃপক্ষ ঠিক করে তারা ক্রমশ বর্ধমান ডিজিটাল ঘড়ির বাজারে প্রবেশ করবে। এজন্য তারা মাইক্রোমানামে একটি ঘড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানিকে কিনে নেয়।

কিন্তু এই বাজারের ভোক্তারা কি চায় সে-সম্পর্কিত তেমন কোন ধারণা ছিলো ইন্টেলের৷ যার ফলে১৯৭৮সালে তারা ১৫ মিলিয়ন ডলার লসে মাইক্রোমা বিক্রি করে দেয়৷

১৯৭৪সালে ড্র্যাম চিপ মার্কেটের প্রায় পুরোটাই ইন্টেলের দখলে ছিলো। এখানকার ৮২.৯শতাংশ চিপই তারা সরবরাহ করতো। কিন্তু বিদেশী সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানির আগমনে ১৯৮৪ সাল নাগাদ ইন্টেলের মার্কেট শেয়ার নাটকীয়ভাবে কমে ১.৩শতাংশে গিয়ে ঠেকে। তবে ঐসময়ে তারা চিপ মেমোরি চিপের বাজার থেকে সরে গিয়ে মাইক্রোপ্রসেসর বাজারের দিকে নিজেদের মনোযোগ নিবদ্ধ করে।

১৯৭২সালে ইন্টেল তৈরী করে এইট-বিট সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট (সিপিইউ/CPU)।এই সিপিইউটির নাম ছিলো ৮০০৮।তার ২ বছর পর তারা নিয়ে আসে ৮০৮০নামক সিপিইউ। এটি আগের মডেল থেকে ১০গুণ দ্রুতগতিসম্পন্ন ছিলো। ১৯৭৮সালে আসে কোম্পানির প্রথম সিক্সটিন-বিট মাইক্রোপ্রসেসর, যার নাম তারা দেয় ৮০৮৬।

১৯৮১সালে আমেরিকান কম্পিউটার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিন (আইবিএম/IBM)ইন্টেলের সিক্সটিন-বিটের মাইক্রোপ্রসেসর  ৮০৮৮ কে তাদের প্রথম ব্যাপক হারে উৎপাদিত পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসির সিপিইউ হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া কিছু কোম্পানি ছিলো যাদের বানানো পিসিতে আইবিএমের পিসিতে ব্যবহৃত সকল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যেত। এগুলো পরিচিত ছিলো আইবিএম ক্লোননামে। এসব কোম্পানিকেও মাইক্রোপ্রসেসর সরবরাহ করতো ইন্টেল৷ আইবিএম এবং এর ক্লোনগুলো পার্সোনাল কম্পিউটার বিক্রির হারকে ব্যাপক হারে বাড়িয়ে দেয়।

Image Source : wikipedia.org

আইবিএম ওয়াশিংটনের রেডমন্ডের একটি ছোট একটি ফার্মের সাথে ডিস্ক অপারেটিং সার্ভিস (ডিওএস/DOS)সরবরাহের ব্যাপারে চুক্তি করে। এই ছোট ফার্মের নাম ছিলো মাইক্রোসফট কর্পোরেশন,যারা পরবর্তীতে টেকনোলজির জগতে মহীরুহে পরিণত হয়। মাইক্রোসফট আইবিএমকে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমসরবরাহ করতে শুরু করে।

আইবিএমের পিসি, ইন্টেলের চিপ এবং মাইক্রোসফটের সমন্বয়ে সৃষ্ট যন্ত্রগুলোকে ডাকা হয় উইন্টেলনামে। এই উইন্টেল তিনটি কোম্পানির জন্যই সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাজারে এসেই এগুলো পুরো বাজার দখল করে নেয় দুর্দান্ত প্রতাপের সাথে। এটিকে চ্যালেঞ্জ জানাবে এমন কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো না৷

Image Source : pngitem.com

ইন্টেল নিয়ে লেখার ১ম পর্বের এখানেই সমাপ্তি টানছি। পরের অংশে আমরা ইন্টেলের মাইক্রোপ্রসেসরের ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়া, পেন্টিয়াম মাইক্রোপ্রসেসর, তাদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ ইত্যাদির ব্যাপারে আলোচনা করবো।

পরের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে

This is a Bangla article. This article is about the evolution of American tech giant Intel.

All the necessary links are hyperlinked.

Featured images are collected from Google.

Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous Article

দ্যা ম্যান্ডালোরিয়ান সিজন ২: কেমন ছিল বেবি ইয়োডাকে নিয়ে ডিন জারিনের নতুন অ্যাডভেঞ্চার?

Next Article

ইন্টেল : বিশ্বের সর্ববৃহৎ সেমিকন্ডাক্টর চিপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান [পর্ব - ২]

Related Posts

পারফিউমের ইতিহাস : প্রাচীন মেসোপোটেমীয় পণ্য যেভাবে তৈরী করলো বিলিয়ন ডলারের বাজার

সৌন্দর্যচর্চায় সাজপোশাক ও অলঙ্কারের পাশাপাশি যে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্ববহ সেটি হলো পারফিউম বা সুগন্ধি। দৈনন্দিন জীবনে আমরা…

মাহেশিন্তে প্রাথিগারাম (২০১৬) : ইন-ডেপথ ক্যারেক্টার স্টাডি, বাটারফ্লাই ইফেক্ট এবং জীবনের বয়ে চলা

মাহেশিন্তে প্রাথিগারাম এর বাংলা অর্থ হলো মহেশের প্রতিশোধ। এটি একটি ভারতীয় মালায়ালাম ভাষার চলচ্চিত্র যেটি কেরালায় মুক্তি পায়…

বেনসন অ্যান্ড হেজেস : রাজকীয় ব্রিটিশ সিগারেটের সাতকাহন [পর্ব-২]

বেনসন অ্যান্ড হেজেস  প্রথম অংশ  প্রতিষ্ঠা এবং প্রাথমিক বিকাশ এবং কি ভাবে ব্যবসার সম্প্রসারণ হলো তা নিয়ে বিস্তারিত…
আরও পড়ুন

পাইলট থেকে ট্রাক ড্রাইভার-এয়ারলাইন ক্যারিয়ার কোভিড-১৯ মহামারী দ্বারা যে ভাবে ধ্বসে গেলো

এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এবং লাভজনক কর্মজীবনের পথ এখন আর নিশ্চিত নয়। কলিস ওয়াগনার তার ব্যক্তিগত পাইলট লাইসেন্স পেয়েছে।যখন তিনি আর্থিক মন্দার সময় একজন শিল্প প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি হারান, তিনি তার শখ পূরণের জন্য পাইলটে যোগ দেন।যেখানে সে…

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন

Total
0
Share