মূলত কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান হলেওনাইকো রিসোর্সেস লিমিটেডএর মূল ফোকাস ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। তারা মূলত তেল এবং গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলনের কাজ করে থাকে। এসব প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধান, উত্তোলন এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত নানা ব্যাপারে তাদের সাথে আমেরিকান কোম্পানিকমোডো এনার্জিএবং ভারতীয় প্রতিষ্ঠানরিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজসাথে চুক্তি রয়েছে।
২০১১ সালে তাদের হাতে ৭টি দেশে ৩৭ লক্ষ একরের বিশাল এলাকায় প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধানের অধিকার ছিলো। তবে এসময় তারা কেবল বাংলাদেশ এবং ভারত থেকেই প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করতো। ২০০৯ সালের ১৮ই নভেম্বর তারা ৩১০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ব্ল্যাক গোল্ড এনার্জিনামক কোম্পানি ক্রয় করে। যার ফলে তারা ইন্দোনেশিয়ায় গভীর পানিতে প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানের অধিকার লাভ করে। পরের বছর ২০১০ সালে তারা ভয়েজার এনার্জিনামে একটি কোম্পানি কেনে ৩৭.৬ মিলিয়ন ডলারে। এর ফলে নাইকো বিস্তার লাভ করে ক্যারিবীয় দ্বীপ ত্রিনিদাদে।
এই সময়ে কোম্পানির মোট আয়ের সিংহভাগই আসতো ভারত থেকে। ২০১০ সালে তা ছিলো ৮১.৬% এবং ২০১১ অর্থবছরে ৮৫.৯২ পার্সেন্ট। এই ১২ মাসে ভারতে তাদের আয়ের হার বেড়ে দাঁড়ায় ১০৬% এ। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ থেকে তাদের আয়ের যোগান ছিলো ৩.৯%। উল্লেখ্য, নাইকো সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তার সবই প্রায় ২০১০-২০১১ সালের। এরপরের তথ্য তেমন পাওয়া যায় না।
২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নাইকোর মার্কেট ভ্যালু কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ২০১১ সালের দিকে তারা ত্রিনিদাদে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। ত্রিনিদাদে তারা ৭৮.১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে সমুদ্রতীর থেকে দূরবর্তী অঞ্চলফাইভ-সি (5c) ব্লকেঅনুসন্ধান করার অনুমতি পায়৷ এসময়ে তারা এখানেটুএবি (2AB)নামক আরো একটি ব্লকে অনুসন্ধান শুরু করে।
যদিও কোম্পানির অনুসন্ধান ক্ষেত্রের ৫৮ শতাংশের অবস্থানই ছিলো ইন্দোনেশিয়ায়, তথাপি ভারতে অনুসন্ধানের পেছনে তাদেরকে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হতো। ইন্দোনেশিয়ায় তাদের অধিকৃত এলাকার পরিমাণ ছিলো ১৬.৭ মিলিয়ন একর, যা ভারতের তুলনায় ১০ গুণ বেশি। কিন্তু ভারতে তাদেরকে ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় ১.৪ গুণ (১৯ মিলিয়ন বনাম ৫০ মিলিয়ন) বেশি অর্থ খরচ করতে হতো। ২০১০ সালে তা বেড়ে হয় ২.৬ গুণ এবং ২০১২ তে এসে তা এক লাফে ১২ গুণে পৌঁছায়। তার কারণ এসময় তারা ভারতের কিছু নতুন এলাকায় অনুসন্ধান শুরু করে।
যেভাবে শুরু হয় নাইকো রিসোর্সেস
১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি প্রথমদিকে কেবলওয়েস্টার্ন কানাডিয়ান বেসিন (অ্যালবার্টা এবং সাসকাচিওয়ান)এ সক্রিয় ছিলো। ১৯৯৩ সালের আগ পর্যন্ত বাইরের দেশে কাজের ব্যাপারে তাদের কোন আগ্রহ দেখি যায়নি। বিদেশে তাদের প্রথম প্রজেক্ট ছিলো ভারতের সুরাটে অবস্থিতহাজিরা গ্যাস ফিল্ড।এই প্রজেক্ট তারা পায় ১৯৯৪ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর এবং কাজ শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। সেই শুরু, এরপর থেকে ভারতে তাদের কলেবর কেবল বেড়েছে। ১৯৯৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কোম্পানির বড় বড় প্রজেক্টগুলো ছিলো এখানেই।
২০০২ সালে তারা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের সাথে মিলে প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান করেকৃষ্ণা-গোদাভারী বেসিনে।এখানে প্রাপ্ত ক্ষেত্রটি ছিলো ভারতের সর্ববৃহৎ এবং ঐ বছর বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রের আবিষ্কার।
২০০৩ সালে বাংলাদেশে কর্মকাণ্ড শুরু করার মাধ্যমে তারা ভারতের বাইরে বিস্তৃতি লাভের দিকে এগোয়। ২০০৮ সালের মার্চে তারা পাকিস্তানে তাদের কর্মকান্ড শুরু করে এবং এখানে ৪টি ব্লকের দায়িত্ব তাদেরকে দেওয়া হয়। একই বছর তারা মাদাগাস্কার এবং ইন্দোনেশিয়াতেও কাজ করতে শুরু করে। মাদাগাস্কারে তাদের কার্যক্রম শুরু হয় অক্টোবরে এবং ইন্দোনেশিয়ায় নভেম্বরে। মাদাগাস্কারে তারা পায় একটি একটি ব্লক এবং ইন্দোনেশিয়ায় পায় ৪টি ব্লক।
২০০৯ সালে তারা ত্রিনিদাদে একটি ব্লকের ২৬ শতাংশ কিনে নেয়। এই ব্লকের বিভিন্ন অংশের মালিকানা ছিলো বিভিন্ন কোম্পানির হাতে। আর ভয়েজারের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এই কোম্পানিকে কেনার ফলে ত্রিনিদাদে তাদের কলেবর বাড়ে অনেকগুণে। কারণ ভয়েজারের হাতে সেদেশের ৪টি ব্লকের মালিকানা ছিলো এবং তারা টুএবি (2AB)ব্লকেরও ৯.৭৫ শতাংশের অংশীদার ছিলো।
নাইকোর বিভাগসমূহ, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং মূল কর্তাব্যক্তি
নাইকোর মূল সদরদপ্তর কানাডার অ্যালবার্টার ক্যালগারিতে অবস্থিত। মূল কোম্পানিটি ছাড়াও বিভিন্ন দেশ মিলিয়ে তাদের আরো ৫টি বিভাগ ছিলো। সেগুলো হলো যথাক্রমে : নাইকো রিসোর্সেস সাইপ্রাস লিমিটেড, নাইকো রিসোর্সেস বাংলাদেশ লিমিটেড, নাইকো রিসোর্সেস কেইম্যান লিমিটেড, নাইকো রিসোর্সেস ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোএবং ভয়েজার লিমিটেড।
২০১১ সালের তথ্য অনুযায়ী তাদের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিলো ২১৩ জন। নাইকোর মূল কর্তাব্যক্তিরা হলেন :এড স্যাম্পসন (সিইও), উইল হর্নাডে (সিওও, ডিরেক্টর), জে কামিংস (ডিরেক্টর)এবংডব্লিউ ডিবনি (ডিরেক্টর)
নাইকোর মূল অপারেশনসমূহ
২০১০ সালের প্রথমার্ধে নাইকো অনুসন্ধানের পেছনে মূল ব্যয় ৯৬ মিলিয়নের অধিকাংশ ব্যয় করেছে তিনটি দেশে। এগুলো হলো : ভারত (৩৪.৪%), ইন্দোনেশিয়া (২৮.১%) এবং মাদাগাস্কার (২২.৯%)। তবে ২০১১ সালের মার্চ নাগাদ ভারতে আগের বছরের তুলনায় তাদের উত্তোলিত সম্পদের পরিমাণ কমে যায়, যার সিংহভাগই ছিলো প্রাকৃতিক গ্যাস। এর কারণ প্রুভড রিজার্ভেরপরিমাণ কমে যাওয়া। ভারতে বড় প্রজেক্টগুলোর ক্ষেত্রে তাদের পার্টনারশিপ ছিলো রিলায়েন্সের সাথে। এছাড়া দুইটি ব্লকের সম্পূর্ণ মালিকানা ছিলো তাদের হাতে।
বাংলাদেশ এবং কানাডা থেকে নাইকোর উৎপাদন বা আয়ের ২ শতাংশেরও কম আসতো। যে ৭টি দেশে তাদের অপারেশন ছিলো, তার মধ্যে মাত্র ২টি দেশ হতে তাদের আয় হতো। আর এক্ষেত্রে নাইকোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো ভারত। ভারতের বাইরে তাদের কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভারতই ছিলো তাদের আয়ের মূল উৎস। বাংলাদেশের তুলনায় নাইকোর উৎপাদন সেদেশে ছিলো দ্বিগুণ। বাকি ৫টি দেশে তাদের সম্পদের পরিমাণ ছিলো ৪১.৮ শতাংশ। তবে ২০১২ সালে ভারতে তাদের আয় কমে যাবে এমন পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিলো কারণ এখানকার ব্লকসমূহে গ্যাসের উৎপাদন কমে যাচ্ছিলো আর আরেকটি ব্লকের মেইনটেনেন্স খরচ বাড়ছিলো।
২০১১ সালে নাইকো সন্দেনামক অপর একটি কানাডিয়ান কোম্পানি থেকে ত্রিনিদাদে ফাইভ-সি (5c)ব্লকের ২৫ শতাংশ কিনেছিলো। এসমস্ত দেশগুলো ছাড়া ইরাকের কুর্দিস্তানে নিজেদের কর্মকাণ্ড শুরু ব্যাপারে আগ্রহী ছিলো তারা। এজন্য ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রয়োজনীয় খননকাজও করতে শুরু করেছিলো তারা।
উৎপাদন এবং আয়
২০১১ অর্থবছরে নাইকোর গড় উৎপাদনের পরিমাণ ছিলো ২৯৪,৭৬৫ হাজার ঘনফুট, যা দৈনিক ৪৯,১২৭ ব্যারেল তেল উত্তোলনের সমানুপাতিক। যা আগের বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। এই উৎপাদন বৃদ্ধির কারণ ডি-সিক্স (D6)ব্লক হতে নতুন উৎপাদিত সম্পদের সংযোজন। ভারতের এই ব্লক আরো একটি ক্ষেত্রে নাইকোর জন্য সুফল নিয়ে আসে। কেননা এখানকার উৎপাদিত সম্পদের দাম বেশি ছিলো।
২০১১ সালে নাইকোর মোট আয়ের পরিমাণ ছিলো ১৯৪.৪৬৪ মিলিয়ন ডলার যার মধ্যে নিট মুনাফার পরিমাণ ছিলো ৫৪.৩৩৪ মিলিয়ন ডলার৷ এসময়ে কোম্পানির মোট সম্পদের অর্থমূল্য ছিলো ১৮৩০.১১ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ বনাম নাইকো
২০০৩ সালে কানাডার নাইকো রিসোর্সেস কোম্পানি অধীনস্থ নাইকো রিসোর্সেস (বাংলাদেশ) লিমিটেডবাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এন্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)এর সাথে ফেনী এবং ছাতকে গ্যাস ক্ষেত্র নির্মাণের চুক্তি করে। একটিজেনারেল পারচেস অ্যান্ড সেলস এগ্রিমেন্ট (জিপিএসএ)এর মাধ্যমেপেট্রোবাংলাফেনী গ্যাস ক্ষেত্রে উৎপাদিত গ্যাসের ক্রেতা হয়। ছাতক গ্যাস ক্ষেত্রে নাইকোর খননকাজ চলাকালীন ২০০৫ সালের ৭ই জানুয়ারী এবং ২৪শে জুন দুটি বিস্ফোরণ ঘটে। এ দুটি বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় নি। যার ফলে এখানকার গ্যাস কূপ, মানুষ এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। শক্তি মন্ত্রণালয়ের কমিটি এই বিস্ফোরণের জন্য নাইকোর কাজ চালানোর ব্যর্থতা এবং অনুপযুক্ত কেসিং ডিজাইনকে দায়ী করে। ফলে এই ক্ষয়ক্ষতি এবং তার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়ভার কার উপর বর্তাবে তা নিয়ে বিবাদ শুরু হয়। ২০০৮ সালে পেট্রোবাংলা এই বিষয়ে নাইকোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বাংলাদেশের আদালতে। কিন্তু নাইকো বাংলাদেশের আইনকে এড়াতেইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর দ্যা সেটেলমেন্ট অফ ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউটস (আইসিএসআইডি)এর দ্বারস্থ হয়।
তারা সেখানে নিজেদের নির্দোষ দাবী করে এবং পেট্রোবাংলা চুক্তি অনুযায়ী তাদের টাকা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করে। আইসিএসআইডি প্রথমে তাদের পক্ষেই রায় দেয়। এ ঘটনা নিয়ে দেশে নানা তোলপাড় হয়। পরে বাংলাদেশ ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট আইসিএসআইডির কাছে অনুরোধ জানায়। এসময় বাংলাদেশ থেকে বলা হয় ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত দায় থেকে যদি নাইকো নির্দোষ প্রমাণিত হয়, তাহলে অবশ্যই চুক্তি অনুযায়ী তাদের প্রাপ্য প্রদান করা হবে।
অবশেষে বহু জল ঘোলা হওয়া এবং আইনী জটিলতার পর ২০২০ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী আইসিএসআইডি বাংলাদেশের পক্ষে রায় দেয়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ১.১৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করে। যা বাংলাদেশি টাকায় ৮০০ কোটিরও বেশি। এই অর্থ ভাগ হবে বাপেক্স এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে। ২০২০ সালের ৩রা মে মন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আইসিএসআইডি চূড়ান্তভাবে ঘোষণা দেবে কিভাবে এই অর্থ বাংলাদেশ পাবে সে বিষয়ে।
নাইকো এ বিষয়ে নিজেদের দায় স্বীকার করেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অভিযোগের আগেই একটি কানাডিয়ান আদালত তৎকালীন শক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেনকে ঘুষ প্রদানের দায়ী দোষী সাব্যস্ত করে তাদেরকে। এছাড়া আরো লোকজনকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। যার ফলশ্রুতিতে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে টরন্টো স্টক এক্সচেঞ্জ নিজেদের লিস্ট থেকে নাইকোকে বাদ দিয়ে দেয়। তারাই প্রথম কানাডিয়ান কোম্পানি যারা দেশের বাইরে জরিমানার শাস্তি পেলো।
This is a Bangla article. The article is about Canadian company Niko Resources and Bangladesh’s leagal dispute with them.
All the necessary links are hyperlinked.
Featured images are collected from Google.