ব্লু অরিজিনের পুনঃব্যবহারযোগ্য নিউ শেফার্ড সাবঅরবিটাল সিস্টেম
ব্লু অরিজিন একটি রকেট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এবং এখন তারা এমন ধরণের রকেট তৈরী করছে যেগুলো পৃথিবীর কক্ষপথে না ঘুরেই মহাশূন্যে যেতে সক্ষম।
তাই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মহাশূন্য সীমার বাইরে গবেষণার জন্য গবেষক এবং তাদের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বহনের জন্য এগুলো আদর্শ।
তারা নির্মাণ করেছে ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যের ১টি পুনঃব্যবহারযোগ্য সাব-অরবিটাল রকেট। এটির নাম নিউ শেফার্ড। এটির নাম নিউ শেফার্ড রাখা হয়েছে মার্কিউরি স্পেস প্রোগ্রামের নভোচারী অ্যালান শেফার্ডের নাম অনুসারে, যিনি ছিলেন মহাশূন্যে পা রাখা প্রথম আমেরিকান নাগরিক। এটিকে শক্তি যোগায় একটি বিই-থ্রিপিএম রকেট এঞ্জিন। ২০১৫ সালের এপ্রিলে নিউ শেফার্ড রকেট প্রথমবারের মত উড্ডয়ন করে।

উড্ডয়নের ক্ষেত্রে এটি গতানুগতিক লঞ্চপ্যাডই ব্যবহার করে। ১২ ফুট ডায়ামিটারের ক্রু ক্যাপসুল বিচ্ছিন্ন হয় এবং কারম্যান লাইন অতিক্রম করে। এরপর প্যারাসুটের সাহায্য এটি ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। মেরামতের মাধ্যমে এটিকে পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব।
কারম্যান লাইন কি? এই প্রশ্ন কৌতূহলী পাঠকদের মনে আসতে পারে। এটি হলো একটি সীমানারেখা। সাধারণভাবে এটি পৃথিবীর বায়ুমন্ডল এবং বাইরের মহাশূন্যের মাঝে সীমানা নির্দেশ করে। এই সংজ্ঞা ওয়ার্ল্ড এয়ার স্পোর্টস ফেডারেশন দ্বারা স্বীকৃত। ১০০ কি.মি বা ৬২ মাইল উচ্চতার এই সীমারেখা আইনী এবং নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ব্লু অরিজিন এবং মনুষ্য মহাকাশ যাত্রা
ব্লু অরিজিন, স্পেসএক্স বা ভার্জিন গ্যালাকটিক এগুলোর কোনটিই কেবলমাত্র স্পেস ট্যারিজম বেইজড কোন কোম্পানি নয়। তবে স্পেস ট্যুরিজম এইসব কোম্পানির মূলধন গঠনের অন্যতম বড় হাতিয়ার। এ ব্যাপারে মানুষের মাঝেও রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। মূলধন গঠনের মাধ্যমে তারা আরো বড় প্রোজেক্ট হাতে নিতে পারবে পাশাপাশি ভবিষ্যতে অন্য কোন গ্রহে বসবাস এবং পণ্য বা শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও স্পেস ট্যুরিজম যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে।
এখন পর্যন্ত ব্লু অরিজিন তার নিউ শেফার্ড রকেটের মাধ্যমে কেবল ম্যানিকুইন স্কাইওয়াকারকে মহাশূন্যে প্রেরণ করেছে। এই ম্যানিকুইন স্কাইওয়াকার ছিলো একটি মূর্তি বা পুতুল। স্কাইওয়াকার নামটি তারা নিয়েছে বিশ্ববিখ্যাত সাই-ফাই ফ্যাঞ্চাইজি স্টার ওয়ার্স থেকে। এখানকার একটি চরিত্রের নাম স্কাইওয়াকার।

কিন্তু মনুষ্য স্পেস ফ্লাইটের ব্যাপারে তাদের রয়েছে বিশাল বড় এবং অ্যাডভান্সড পরিকল্পনা। আদতে তাদের বিশেষভাবে তৈরী করা ক্রু ক্যাপসুল মহাকাশযান থেকে পৃথিবী পর্যবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত। এতে রয়েছে ৪৩×২৯ ইঞ্চি আকৃতির উইন্ডো। পাশাপাশি রয়েছে আরাম করে গা এলিয়ে দেওয়ার উপযোগী ৬টি রিক্লাইনিং চেয়ার।
১০টি মিশন সফলভাবে সম্পন্ন করার পর মানুষসহ মহাকাশ যান মহাশূন্যে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে ব্লু অরিজিনের। ইতোমধ্যেই তারা ২০১৮ সালের জুলাই মাসে একটি সফল স্কেপ টেস্ট সম্পন্ন করেছে। এই স্কেপ টেস্টে তারা ক্রু ক্যাপসুল স্কেপ মোটরকে এযাবৎকালের মধ্যে সর্বাধিক উচ্চতায় তুলতে সক্ষম হয়েছে।
কেমন হবে ব্লু অরিজিনের মহাশূন্যচারীদের অভিজ্ঞতা?
মহাশূন্যের প্রান্তে ১১ মিনিট দৈর্ঘ্যের ব্লু অরিজিন ভ্রমণে নভোযাত্রীরা ১৯৬০ এবং ১৯৭০ এর দশকে অ্যাপোলো’র চন্দ্রাভিযানের সময় নভোচারীরা যেমন অনুভব করেছিলেন, অনেকটা সেরকম অনুভব করবেন। ৬ জন গ্রাহক টাকার বিনিময়ে চড়ে বসবেন একটি নিউ শেফার্ড রকেটের ক্রু ক্যাপসুলে। ভার্টিক্যাল লঞ্চের পর রকেটের এঞ্জিন আড়াই মিনিট ধরে চলবে এবং রকেটটি শব্দের গতির ৩ গুণ গতির সমানুপাতিক বেগ লাভ করবে। এরপর রকেট এবং ক্রু ক্যাপসুল পরস্পরের থেকে আলাদা হয়ে যাবে।
৬ যাত্রীকে বয়ে চলা ক্রু ক্যাপসুল মহাশূন্যে পৌঁছাবে। এসময় যাত্রীরা ওজনশূন্যতা অনুভব করবেন এবং নিজেদের জানালা দিয়ে মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর বক্রতার দিকে তাকিয়ে সেখানকার সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারবেন। তারপর তাদের বাহন আবার নীচের দিকে নামতে থাকবে দ্রুত গতিতে। এরপর প্যারাসুট প্রসারিত হবে এবং বাহনের গতি হ্রাস পেতে শুরু করবে। অবশেষে তারা নিরাপদে পৃথিবীপৃষ্ঠে অবতরণ করবেন।

অ্যাপোলোর মত ভার্টিক্যাল টেক-অফ এবং স্বল্প সময়ের মহাশূন্য ভ্রমণের ফলে ব্লু অরিজিনের গ্রাহকদের যে অভিজ্ঞতা হবে; সেটি ভার্জিন গ্যালাকটিকের গ্রাহকদের অভিজ্ঞতার চেয়ে অনেকাংশে ভিন্ন হবে।
ব্লু অরিজিনের হাতে কি কমার্শিয়াল কন্ট্র্যাক্ট আছে?
এই প্রশ্নের উত্তর হলো হ্যাঁ! তাদের হাতে কমার্শিয়াল কন্ট্র্যাক্ট আছে এবং খুব দ্রুততার সাথে তারা নতুন নতুন চুক্তিতে সাক্ষর করছে। অনেকদিন ধরে তারা ছিলো ব্যাক্তি অর্থায়নের উপর নির্ভরশীল একটি সিক্রেটিভ কোম্পানি। এসময় তারা কেবল নাসার সাথে কিছু ছোটখাট উন্নয়নমূলক চুক্তি করেছিলো। এখন তারা স্পেস ট্যুরিজম সেক্টরে প্রাধান্য বিস্তার করতে চায় এবং এই বাজারে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। প্রতিনিয়ত তারা নতুন চুক্তির জন্য বিড করছে এবং বড় বড় কমার্শিয়াল চুক্তি করছে। দ্রুততার সাথে বড় হতে চায় এমন মনোভাবের কোম্পানির জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এসব চুক্তির মাধ্যমেই তারা মহাকাশ ভ্রমণের খরচ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার যে কোম্পানি লক্ষ্য; সেটি অর্জন করতে সমর্থ হবে।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তারা নাসার তত্ত্বাবধানে ফ্লাইট অপারচুনিটিজ নামে একটি প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছে। এসময় তারা নিজেদের নিউ শেফার্ড (এনএস-টেন) মিশনে করে কেবিনভর্তি নাসা যন্ত্রপাতি মহাশূন্যে নিয়ে গেছে। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে তারা নাসার সাথে চাঁদে অবতরণ করতে সক্ষম এমন একটি সিস্টেম তৈরী করার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে। এছাড়া তারা লুনার ল্যান্ডার-স্কেলড ইন্টেগ্রেটেড প্রোপালশন সিস্টেমের জন্য ক্রায়োজেনিক লিকুইড প্রোপালশন তৈরীর ব্যাপারে কাজ করবে। যার ফলশ্রুতিতে একসময় হয়তো ব্লু অরিজিন নিজেরাই চাঁদে অবতরণ করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে।

ইউএস এয়ার ফোর্সের কাছ থেকে তারা ৫০০ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি বাগিয়ে নিয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী ইউএস এয়ার ফোর্সের জন্য নতুন প্রজন্মের নিউ গ্লেন রকেট তৈরী করবে তারা। নিজেদের ডেভেলপমেন্টে আরো বেশি টাকা বিনিয়োগের জন্য ব্লু অরিজিন চুক্তি সাক্ষর করেছে ইউনাইটেড লঞ্চ এলায়েন্স এর সাথে। ব্লু অরিজিন তাদেরকে নিজেদের দুটি বিই-ফোর এঞ্জিন প্রদান করবে। এই এঞ্জিনগুলো ব্যবহার করে ইউনাইটেড তাদের ভলকান রকেট লঞ্চ করবে এই বছর। বিই-ফোর এঞ্জিনগুলো এখন ব্লু অরিজিন তাদের নিউ গ্লেন রকেটের জন্য ডিজাইন করছে।
ব্লু অরিজিনের নিউ গ্লেন অরবিটাল রকেট
ব্লু অরিজিনের নিউ গ্লেন অরবিটাল রকেট নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। বড়সড় আকারের এই রকেটকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন এটি মানুষ এবং যন্ত্রপাতি উভয়ই বহন করে মহাশূন্যে নিয়ে যেতে পারে। নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার আগেই এই রকেটের পরিকল্পনার ঘোষণার মাধ্যমে ব্লু অরিজিন স্পেসএক্সের মত বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দিলো। এই হেভি-লিফট রকেটের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে ২০২১ সালে। পুনরায় ব্যবহার করা যাবে এমন সুবিধাসম্পন্ন রকেটটিতে ব্যবহৃত হবে ৭টি বিই-ফোর এঞ্জিন। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২.৫ বিলিয়ন ডলার এবং এর নামকরণ করা হয়েছে জন গ্লেন এর নামানুসারে; যিনি ১৯৬২ সালে প্রথম আমেরিকান হিসেনে অরবিটে গিয়েছিলেন। ব্লু অরিজিন দাবী করেছে তাদের নিউ গ্লেন রকেটের মাধ্যমে বর্তমানে বিদ্যমান অন্য যে কোন রকেটের তুলনায় দ্বিগুণ পণ্য বহন করা যাবে।
এখনও এই রকেটের কোন অস্তিত্ব না থাকলেও স্পেস ইন্ডাস্ট্রিতে নিউ গ্লেন রকেট নিয়ে আগ্রহের কোন কমতি নেই। এবং তা দিনেদিনে আরও বেড়ে চলেছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে টেলিস্যাট ঘোষণা দেয় যে তারা তাদের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট স্যাটেলাইট মহাশূন্যে প্রেরণের জন্য নিউ গ্লেন রকেট ব্যবহার করবে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়াকালীন বেশকিছু রকেট লঞ্চ করা হবে। এদিকে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইউএস এয়ারফোর্স কথা দেয় যে তারা তাদের ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্পেস (এনএসএস) মিশনের ক্ষেত্রে এই রকেট এবং ভলকানকে ব্যবহার করবে। আরো কয়েকটি কোম্পানি নাম লিখিয়েছে ব্লু অরিজিনের গ্রাহক তালিকায়। এগুলো হলো : ওয়ানওয়েব, ইউটেলস্যাট এবং মিউ স্পেস। এদের সবার সাথেই ব্লু অরিজিনের লঞ্চ ডিল আছে।

কি আছে ব্লু অরিজিনের ভবিষ্যতে?
যদিও নিউ শেফার্ড রকেটের মাধ্যমেই হয়তো মনুষ্য মহাকাশ ভ্রমণ শুরু হবে, তথাপি স্পেস রেস পুরোদমে শুরু হবে যখন নিউ গ্লেন রকেটের উৎক্ষেপন শুরু হবে তখন। একসময়ের ক্ষুদ্র, সিক্রেটিভ এবং লিমিটেড লায়াবিলিটি কোম্পানি ব্লু অরিজিন ইতোমধ্যেই নতুন যুগে পা রেখেছে। এই ব্যবসায় যে তারা থাকতেই এসেছে সেটিও প্রমাণ করে ফেলেছে। বর্তমানে গ্রাহকদের মহাশূন্য ভ্রমণের স্বপ্ন পূরণের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা কোম্পানিটি নাসার সাথে আরো নানা চুক্তি সাক্ষর করছে এবং স্পেস ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। অর্থনৈতিক শিথিলতাও অর্জন করে ফেলেছে তারা। এখন পর্যন্ত কোম্পানি ইতিহাসে বর্তমানে ব্যাংকে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি অর্থ আছে তাদের। এই অর্থ ব্যবহার করে তারা নিজেদেরকে আরো সম্প্রসারিত করতে চায়, নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে চায় এবং নতুন জেনারেশনের হেভি-লিফট অরবিটাল রকেট তৈরী করতে চায়।

মোট কথা, ব্লু অরিজিন সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে প্রস্তুত এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে তারা। এর মাধ্যমে পূরণ হবে তাদের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের স্বপ্ন। সম্প্রতি তিনিও অ্যামাজনের সিইও পদ হতে অব্যাহতি নিয়ে নিজের পুরো মনোযোগ ব্লু অরিজিনে দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। তাই বিশ্বের সেরা ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতার সাথে সাথে স্পেস ইন্ডাস্ট্রিতেও আমরা দেখতে যাচ্ছি বেজোস-এলন প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এলনের স্পেসএক্স ছাড়াও স্পেস রেসে ব্লু অরিজিনকে টেক্কা দিতে হচ্ছে ভার্জিন গ্যালাকটিক, বোয়িং, এরিয়ানেস্পেস, রসকসমস এবং ইউএলএ এর মত কোম্পানির সাথে। শেষপর্যন্ত তারা কেমন করবে তার উত্তর তোলা থাকলো সময়ের হাতে।
This is a Bangla article. This article covers everything you need to know about Jeff Bezos’s spaceflight company Blue Origin.
All the necessary links are hyperlinked.
Featured images are collected from Google.