মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে রয়েছে সত্য এবং মুক্তি অনুসন্ধানের আজন্ম পিপাসা। আমি সেই পিপাসায় কাতর হয়েই জাসদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছি। এটা আমার অক্ষমতা বলে বিবেচিত হতে পারে, তবে আমি আমার অক্ষমতার জন্য মোটেই বিব্রত নই। … আমার জীবনের লক্ষ্য আজ স্থির- আমার লক্ষ্য অর্জনে আমি অটল। অন্যায়ের কাছে মাথানত করা আমার স্বভাব নয়। এটাই একজন মুসলমানের প্রকৃত সিফাত।
এটা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দীর জবানবন্দি। এই অকুতোভয়, দেশপ্রেমিক এবং নিজেকে মুসলমান বলে স্বীকৃতি দেওয়া মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার সম্পর্কে জানার আগ্রহ রয়েছে অনেকেরই। বিশেষ করে তরুণ সমাজের কাছে তিনি এক বিস্ময়কর চরিত্র।
সৈনিক জীবন তাকে কেবল সাহসী বানায়নি, তিনি ছিলেন কষ্টসহিষ্ণু, সুশৃঙ্খল এবং একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। স্বাধীনতার পর সুদীর্ঘ ১৪ বছর তিনি ছিলেন জাসদের (বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল) সভাপতি। সংগ্রাম করেছেন অন্যায়, অবিচার জুলুম এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু হঠাৎ করেই পরিবর্তন ঘটে তার চিন্তাজগতের। জীবনের শেষ সময়ে এসে ইসলামী ভাবধারায় প্রবর্তিত হন তিনি। অবশেষে পদত্যাগ করেন জাসদের সভাপতি পদ থেকে।
বলা হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধের খেতাব না পাওয়া একমাত্র সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলের কথা। তার সম্পূর্ণ নাম মোহাম্মদ আব্দুল জলিল। ১৯৪২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এক শিশিরভেজা শীতের সকালে এতিম হয়েই পৃথিবীর আলো দেখেন মেজর জলিল। বরিশাল জেলার উজিরপুর থানা সদরে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা আলী মিয়া চৌধুরী তার জন্মের তিন মাস আগেই পরপারে পাড়ি জমান। এতিম হয়ে জন্মগ্রহণ করার পর থেকেই জীবনের কঠিনতম মুহূর্তগুলোর সম্মুখীন হতে থাকেন এম এ জলিল। এই সময়ে মামার বাড়িতে বড় হওয়া জলিলের একমাত্র সহায় সম্বল ছিল বিধবা মায়ের আদর, স্নেহ আর ভালোবাসা।
এম এ জলিল ১৯৬০ সালে উজিরপুর ডব্লিউ বি ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাস করেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি লেখালেখির প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলেন। তাই তো মেট্রিক পাশ করার আগেই লিখে ফেলেন ‘পথের কাঙাল’ ও ‘রীতি’ নামক দুটি উপন্যাস। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো- এই দুটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিই হারিয়ে যায়, যা আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
১৯৬১ সালে তিনি পাড়ি জমান পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে রাওয়ালপিন্ডির মারি ইয়ং ক্যাডেট ইন্সটিটিউশনে ভর্তি হন। ১৯৬৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর রাওয়ালপিন্ডির কাবুলে সামরিক একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তার অসাধারণ দক্ষতা এবং মনোবল খুব দ্রুতই তাকে উপরে উঠতে সাহায্য করে। মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি কমিশন লাভ করেন এবং পাকিস্তানের ট্যাংক বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ১২ নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার হিসেবে সরাসরি সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
এম এ জলিল ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের সামরিক একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি মুলতানের একটি ইন্সটিটিউট থেকে ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, তিনি সামরিক বাহিনীতে কর্মরত অবস্থাতেও পড়াশোনা চালিয়ে যান। যোগ্যতা ও দৃঢ়তাবলে ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর পদে উন্নীত হন।
১৯৭১ সালের শুরুতেই দেশ থেকে মেজর জলিলের কাছে মায়ের অসুস্থতার সংবাদ আসে। অসুস্থ মাকে দেখতে ১৯৭১ এর ১০ ফেব্রুয়ারি দেশে আসেন তিনি। একাত্তরের সেই দিনগুলোতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ব্যাপক অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছিল। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত না গিয়ে দেশেই অবস্থান করেন। সুকৌশলী ও চৌকস সেনা অফিসার হিসাবে মেজর জলিল রাজনীতির শেষ অবস্থাটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
এরপরে এলো ইতিহাসের ভয়াবহ ২৫ মার্চের কালো রাত। সেই রাত পাকিস্তানের ইতিহাসের চেহারাই পাল্টে দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে ২৬ মার্চ থেকে মেজর জলিল মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার প্রচেষ্টায় ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত বরিশাল এবং পিরোজপুর অঞ্চল শত্রুমুক্ত রাখা সম্ভব হয়। এভাবেই শুরু হলো মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম।
৭ এপ্রিল মেজর জলিল খুলনা বেতার কেন্দ্র শত্রুমুক্ত করতে অপারেশন পরিচালনা করেন। এ অপারেশনে তিনি বীরবিক্রমে লড়াই করেন এবং বিপুল সাহসিকতার পরিচয় দেন। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তার সহযোগী হিসেবে ছিলেন খুলনা বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান টুকু এবং সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন। এরপর ২১ এপ্রিল অস্ত্র সংগ্রহের জন্য সুন্দরবনের দুর্গম পথ ধরে পাড়ি জমান ভারতে। ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধের ৯ নং সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। শুরু করে দেন সর্বাত্মক যুদ্ধ। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
সদ্যস্বাধীন দেশে ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর বরিশালে মেজর জলিলকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। ২১ ডিসেম্বর বরিশালে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ প্রদান করেন মেজর এম এ জলিল। এই দুই জনসভাতেই তাকে একনজর দেখার জন্য জনসাধারণের ঢল নামে।
স্বাধীনতার পরপরই সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে ভারত কার্যত একটি প্রদেশ হিসেবেই বিবেচনা করতে চেয়েছিল। পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র, মালামালসহ বিভিন্ন ধরনের সামরিক যান ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের দেশে নিয়ে যেতে থাকে।
এমনই এক ঘটনা ঘটে যশোরে। ভারতীয় সেনা প্রহরায় যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই কয়েকটি ট্রাক নিয়ে যাওয়ার সময় মেজর জলিল তার বাহিনী নিয়ে সামনে দাঁড়ান। বাধা দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। তাৎক্ষণিকভাবে এই খবর পৌঁছে যায় সরকারের উপর মহলে। ৩১ ডিসেম্বর তাদের বহনকারী প্রাইভেট কার এবং মাইক্রোবাস যখন যশোর শহরে প্রবেশ করবে, ঠিক তখনই কুষ্টিয়া ও যশোর নিয়ে গঠিত ৮ নং সেক্টরের আরেকদল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পথরোধ করে দাঁড়ালো। তাদের লক্ষ্য করে বন্দুক তাক করে একে একে দাঁড়িয়ে গেল ২০ জন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা।
মেজর জলিলের সঙ্গেও ১৬ জন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। জলিলের সাথীরা বন্দুক তাক করতেই তিনি “ডোন্ট ফায়ার” বলে তাদেরকে থামিয়ে দিলেন। যে দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করলেন, সেই দেশে দুই সপ্তাহ না পেরোতেই ১৬ জন সঙ্গীসহ গ্রেপ্তার হন তিনি। যশোর ক্যান্টনমেন্টের পুরাতন একটি জরাজীর্ণ কোয়ার্টারের নির্জন বাড়িতে দীর্ঘদিন বন্দী করে রাখা হয় তাকে। শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দী সেক্টর কমান্ডারের মানবেতর জীবন।
দীর্ঘ ৫ মাস ৬ দিন বন্দী থাকার পর ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই মুক্তিলাভ করেন মেজর এম এ জলিল। সেসময় সেক্টর কমান্ডারসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি, মুক্তিযোদ্ধা এবং সেক্টর কমান্ডারদের বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়। দেওয়া হয় বিশেষ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। অথচ মেজর জলিল এমনই একজন হতভাগ্য যিনি একজন সেক্টর কমান্ডার হয়েও কোনো প্রকার খেতাব বা সম্মাননা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। বলা হয়ে থাকে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণেই তাকে বঞ্চিত করা হয়েছিল।
এরপর ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়।
১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ জাসদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি চালায়। এতে বেশ কয়েকজন নিহত হন। আহত হন মেজর জলিল নিজেও। সহিংস কর্মকান্ডের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাকে। ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর তিনি পুনরায় মুক্তি লাভ করেন। ২৩ নভেম্বর তৃতীয়বারের মতো পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। সামরিক ট্রাইব্যুনালে সে বছরই কর্নেল তাহের এবং মেজর জলিলের ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে মেজর জলিলের বিশেষ অবদানের জন্য তার মৃত্যুদন্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
প্রায় সাড়ে চার বছর কারাভোগের পর ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ তিনি মুক্তিলাভ করেন। ১৯৮২ সালে মেজর জলিল টাঙ্গাইলের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা সায়মা আক্তারের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সায়মা-জলিল দম্পতির দুই কন্যা সারাহ জলিল ও ফারাহ জলিল। এরপর থেকেই মেজর জলিলের চিন্তাভাবনা এবং কর্মকাণ্ডে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় হঠাৎ একদিন, ১৯৮৪ সালের ৩ নভেম্বর, তিনি জাসদের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এর মাত্র ১৬ দিন পর এম এ জলিল ১৯৮৪ সালের ২০ অক্টোবর ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে গৃহবন্দী করা হয়। দীর্ঘ প্রায় একমাস তাকে গৃহবন্দী অবস্থায় থাকতে হয়। এরপর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের কারণে ১৯৮৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৮ সালের মার্চ পর্যন্ত তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকে রাখা হয়।
১৯৮৯ সালের ১১ নভেম্বর মেজর জলিল পাকিস্তানে যান। ১৬ নভেম্বর তিনি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাৎক্ষণিকভাবে একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হলেও ১৯ নভেম্বর রাত সাড়ে দশটায় তিনি ইন্তেকাল করেন। সমাপ্ত হয় একজন অভিমানী সেক্টর কমান্ডারের বর্ণাঢ্য জীবনের যাত্রা। ২২ নভেম্বর তার লাশ ঢাকায় আনা হয় এবং পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
This is a bangla language article. This is about Biography of Sector Commander MA Jalil
All the references are hyperlinked within the article.
বুক রেফারেন্সঃ
বইঃ অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা
লেখকঃ মেজর (অবঃ) এম এ জলিল
প্রকাশনীঃ ইতিহাস পরিষদ
পৃষ্ঠাঃ ৬-৮
Featured Image: archives.gov