বিশ্বজুড়ে ৮০০টিরও বেশি সামরিক ঘাঁটি এবং অন্য যেকোন দেশের চেয়ে সামরিক খাতে বেশি অর্থ ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সামরিক বাহিনীর পেছনে পুরো বিশ্বে এক বছরে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়, তার ৩৭ শতাংশই ব্যয় হয় আমেরিকান আর্মির পেছনে। বর্তমানে আমেরিকা এমন একটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বৈশ্বিক ব্যবস্থার প্রধান যেটি নিয়ে এসেছে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি এবং দ্বন্দ্বের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে অনেকাংশে। আমেরিকা বিশ্বের জন্য কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং কিভাবে এটি বিশ্ব রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় কুশীলবের দায়িত্ব পালন করে, সেটি জানতে আমাদেরকে নজর দিতে হবে দেশটির গোড়া পত্তনের সময়ে, যখন এটি কোনভাবেই সুপার পাওয়ার হিসেবে পরিগণিত হতো না৷
১৭৭৬ সালের ৪ঠা জুলাই আমেরিকা ইংল্যান্ডের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। তখন হয়তো কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে এই দেশটাই একদিন সকল ক্ষেত্রে পুরো বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ১ম ৭০ বছরে উত্তর আমেরিকায় এর আকার এবং প্রভাব ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এভাবে সম্প্রসারিত হতে হতে এটির সীমানা একসময় আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত পৌঁছে। এই সময়ে তারা প্রচুর যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং এখানে বসবাসকারী রেড ইন্ডিয়ান লোকজনের উপর ব্যাপক হারে গণহত্যা চালায়।
কিন্তু আটলান্টিক পেরিয়েও আমেরিকার এই সম্প্রসারণশীলতা (ইংরেজিতে এক্সপ্যানশনিজম নামে পরিচিত) চলতে থাকবে কি না তা নিয়ে প্রথমদিকের আমেরিকানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিলো। ১৮৬৫ সালে গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পর এই বিতর্ক আরো জোরালো হয়ে ওঠে। এইসময় উইলিয়াম এইচ শিউয়ার্ডএর মত কিছু নেতা মত দেন যে সকল সমৃদ্ধিশালী দেশের মত আমেরিকারও ক্রমাগত সম্প্রসারণ হওয়া প্রয়োজন এবং বৈশ্বিক সুপার পাওয়ার হওয়ার ব্যাপারেও তাদের মনোযোগী হওয়া উচিত। শিউয়ার্ড এবং তার সমভাবাপন্ন নেতারা সম্প্রসারণশীলতাকে আরো জোরদার করতে মনোযোগী হন, যার ফলশ্রুতিতে ১৮৬৭ সালে আমেরিকা রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কিনে নেয়। কিন্তু তারা গ্রিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ড কিনতে চাইলে এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা চেষ্টা করলে তাতে কংগ্রেস বাধ সাধে। কারণ তখন ক্যাপিটল হিলের লোকজনসহ অনেক আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের প্রতি বিরুপ মনোভাব পোষণ করতেন। বিশ্ব রাজনীতির আষ্টেপৃষ্টে আমেরিকার জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারেও তারা ভীত ছিলেন। এছাড়া তাদের আরেকটি অভিমত ছিলো আমেরিকা যদি এভাবে সম্প্রসারিত হতে থাকে, তাহলে অনেকে অন্য দেশ থেকে সেই দেশে আসতে শুরু করবে। এতে করে তাদেরকে ‘নিম্ন’ প্রজাতির মানুষের সাথে উঠতে বসতে হবে। ফলে জাত বিশুদ্ধতা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এর ফলে দেশটির সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণশীলতার আকাঙ্ক্ষা ব্যাপকভাবে বাধার সম্মুখীন হয়।
কিন্তু ১৮০০ সালের শেষের দিকে এমনকিছু হয় যার ফলে এই সম্প্রসারণশীলতা বিষয়ক বিতর্ক ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। শিল্প বিপ্লবের ফলে ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়। আর আমেরিকার এই বৃহদাকারের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আরো কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থা এবং আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এতে করে কেন্দ্রীয় সরকারই সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়, যার ফলেউইলিয়াম ম্যাককিনলেএর মত সম্প্রসারণশীলতায় বিশ্বাসী প্রেসিডেন্টরা একতরফাভাবে আমেরিকান প্রভাবকে বাইরের দেশসমূহে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন৷
এক্ষেত্রে টার্নিং পয়েন্ট আসে ১৮৯৮ সালে, যখন অভ্যন্তরীণ তীব্র বিরোধীতা উপেক্ষা করে উইলিয়াম ম্যাককিনলে কিউবার দখল নিয়ে স্পেনের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। উদীয়মান পরাশক্তি আমেরিকা সহজেই মৃতপ্রায় স্প্যানিশ শক্তিকে পরাজিত করে। এতে করে পুয়ের্তো রিকো, গুয়াম এবং ফিলিপাইন তাদের আওতাধীন হয়। পরের দুই বছরে আমেরিকা ওয়েক আইল্যান্ড, হাওয়াই এবং আমেরিকান সামোয়া অধিকার করে। কয়েক বছর পর, ১৯০৩ সালে তারা পানামা খাল দখল করে নেয়। ১৯১৬ সালে তারা ডমিনিকান রিপাবলিক দখল করার লক্ষ্যে সৈন্য প্রেরণ করে এবং ১৯১৭ সালে আমেরিকান ভার্জিন আইল্যান্ডস কিনে নেয়। এই সময়কালে এমন দূরবর্তী এলাকাসমূহকে দখলের মাধ্যমে আমেরিকা বিশ্বকে তার শক্তির ব্যাপারে জানান দেয় এবং সত্যিকারের বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।
এই সময়ে রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ও রাজনীতি বিষয়ক স্বার্থ রক্ষার্থে আমেরিকা বহির্বিশ্বে নিজেদের প্রভাবকে ব্যবহার করতে শুরু করে। যার প্রমাণস্বরুপ নিকারাগুয়ায় আমেরিকান ভাবধারায় বিশ্বাসী সরকার গঠিত হতে দেখা যায়। এছাড়া পশ্চিমা দেশগুলো কোন নীতিতে চীনের সাথে বাণিজ্য করবে তা নির্ধারণেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চীনের সাথে তারা‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’এর মাধ্যমে বাণিজ্য শুরু করে। এই নীতির প্রবর্তনও করে তারা ১৮৯৯-১৯০০ সালে। এই নীতির নিয়মানুযায়ী যেসকল দেশ চীনের সাথে বাণিজ্য করবে তারা সমান সুযোগ পাবে এবং সেই দেশের প্রাদেশিক এবং প্রশাসনিক অঙ্গসমূহ থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা লাভ করবে।
ঐসময়ে বিশ্বে আমেরিকার প্রভাব কতটা প্রকট হয়েছিলো তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রমাণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের শেষের দিকে আমেরিকার অংশগ্রহণ যে কেবল এর ফলাফলে নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করেছে তা-ই নয়, উপরন্তু প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ১৯১৮ সালের ১৮ই জানুয়ারী থেকে ১৯১৯ সালের ২১শে জানুয়ারী পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্যারিস পিস কনফারেন্সএ অংশগ্রহণ করেন৷ এই কনফারেন্সেই যুদ্ধের সমাপ্তি নিশ্চিত করা হয় এবং শান্তি আনয়নে কোন কোন পন্থা অবলম্বন করা হবে তা চূড়ান্ত করা হয়। এছাড়া তিনি লিগ অফ নেশন্সনামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা সৃষ্টির উদ্যোগ নেন। এর লক্ষ্য ছিলো বিশ্বব্যাপী শান্তি এবং সহযোগীতার মনোভাব সৃষ্টি করা। এই যে পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা; এটিই প্রমাণ করে তখন আমেরিকান বৈদেশিক নীতি কতটা শক্তিশালী ছিলো। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন উইলসন এবং এটাই ছিলো তাদের বৈদেশিক নীতির ইতিহাসে সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগ। কিন্তু অনেক আমেরিকান অধিবাসীই তখনো বিশ্বের ব্যাপারে নাক না গলিয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে চাইতো। এই মনোভাবকে ইংরেজিতে আইসোলেশনিজমবলা হয়। ১৯১৮ সালে কংগ্রেস আমেরিকার লীগ অফ নেশন্সে যোগ দেয়ার সকল পথ রুদ্ধ করে দেয়। ফলে প্রেসিডেন্ট উইলসনের উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ে।
যখনগ্রেট ডিপ্রেশন (অর্থনৈতিক মন্দা, ১৯২৯) চলছিলো এবং হিটলারের উত্থান হচ্ছিলো; তখন আমেরিকা ইউরোপের ঘটনাবলির ব্যাপারে চিন্তিত হওয়ার পরিবর্তে নিজেদেরকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলো। কিন্তু দেশটি ক্রমাগত বৈশ্বিক ঘটনাবলীতে জড়িয়ে পড়লে এবং গোটা বিশ্বে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে তারা নিজেদেরকে আর আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পারেনি। পূর্ব এশিয়ায় ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকা জাপানি সাম্রাজ্য এই অঞ্চলে তাদের অধিকৃত জায়গা এবং অবস্থানকারী সৈন্যদের জন্য ছিলো সরাসরি হুমকি৷ ফলে আমেরিকা এবং জাপানের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। এই দ্বন্দ্ব চরম পরিণতি লাভ করে জাপান কর্তৃক ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর হাওয়াইতে অবস্থিত পার্ল হারবারে হামলার মাধ্যমে। এই হামলার ফলেই যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। তার আগে তারা এই যুদ্ধে যোগদানের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলো না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বৈশ্বিক বিষয়াবলীতে আমেরিকার উপস্থিতিকে চূড়ান্ত রুপ দান করে। তখন আমেরিকাই ছিলো একমাত্র প্রধান শক্তি যাদের পক্ষে যুদ্ধকালীন সময়ে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভবপর ছিলো৷ এছাড়া তারাই ছিলো একমাত্র দেশ যাদের অস্ত্রাগারে পারমাণবিক অস্ত্র স্বমহিমায় বিরাজমান ছিল। এতে করে তারা এমন একটি অনুপম অবস্থানে ছিলো যে তাদেরই কেবল শান্তি বিষয়ক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার ছিলো।
আর তাই বিশ্বকে আরো একটি নারকীয় হানাহানি থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে তারা এই শক্তিশালী অবস্থানের সদ্ব্যবহার করে। তাদের শক্তিশালী অবস্থানের উপর ভিত্তি করে নেওয়া এসব সিদ্ধান্তগুলোর একটি হলো‘জাতিসংঘ’নামক সংস্থার সৃষ্টি। জাতিসংঘের সনদে এমন কিছু আইনের সন্নিবেশ ঘটানো হয় যেগুলো নাৎসি বাহিনী এবং জাপানীদের মত অন্য দেশ দখল এবং নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানোর লক্ষ্যে যুদ্ধ করার পাঁয়তারাকে নস্যাৎ করে দিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এছাড়া এটি একটি বিচারালয় হিসেবেও কাজ করবে, যেখানে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিরাজমান বিতর্কিত বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি হবে। আমেরিকানরা আশা করেছিলো এভাবে জাতিসংঘের মাধ্যমে শক্তিশালী দেশগুলো যুদ্ধের পরিবর্তে আপস এবং আইনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে বিবাদমান বিষয়ে সমঝোতা এবং শান্তিমূলক সমাধানের পথে হাঁটতে সক্ষম হবে।
This is a Bangla article. This article covers the topic ‘How America Became A Superpower’. All the necessary links are hyperlinked.
Featured images are collected from Google.