লিখুন
ফলো

সুলতান কাবুস: ব্রিটিশ আর্মি থেকে আরব বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী শাসক

বলছি আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত ছোট্ট একটি দেশ ওমানের কথা। প্রতিবেশী দেশ আরব আমিরাতের মতো ওমানে নেই আকাশছোঁয়া অট্টালিকা, কোলাহলপূর্ণ নগর -চত্বর বা ব্যস্ততম রাজপথ। তবে এখানে আছে আকাশছোঁয়া সুউচ্চ পাথুরে পর্বত, অথৈ নীল জলরাশির সমুদ্র সৈকত, এবং বিশাল আকাশের নীলিমা। তাই এখানকার প্রকৃতি এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত আর বিশুদ্ধ। ওমানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেশ সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে দিনদিন পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে। প্রকৃতির স্নিগ্ধ ছোঁয়া, ভ্রমণে আসা পর্যটকদের কাছে বেশ উপভোগ্য।
সুলতান কাবুস
আরব বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী শাসক সুলতান কাবুস; image: britannica
ওমানের বর্তমান রাজধানী মাসকাট। সুউচ্চ মসজিদের মিনার, অসংখ্য পুরাতন রাজপ্রাসাদ আর প্রাচীরে ঘেরা এই শহরটি কয়েক দশক আগেও এতটা কর্মচঞ্চল ছিলনা। ছিল না, তেমন স্কুল-কলেজ বা ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রাস্তা বলতে ছিল কেবল মাসকট শহরে মাত্র ১০ কিলোমিটার পাঁকা সড়ক। সন্ধা হলেই শহরে নেমে আসত রাজ্যের অন্ধকার, ছিল না বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। নিষিদ্ধ ছিল রেডিও-টেলিভিশন, এমনকি সানগ্লাস পড়লেও গুনতে হত মোটা অঙ্কের জরিমানা। সে সময় ওমান ছিল বিশ্বের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ ও দারিদ্রতায় জর্জরিত দেশগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু আজকের মাসকাট আধুনিক বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করছে।
আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে মাসকাটের প্রতিটি ওলিতেগলিতে। তেল ও খনিজ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে প্রজা থেকে রাজা বনে গেছে ওমান। আর যেই ব্যক্তির হাত ধরে ওমান আজ আধুনিক বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করছে তিনি হলেন সুলতান কাবুস। যিনি আরব বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তি।

যুবক বয়সে সুলতান কাবুস; image: getty image

জন্ম এবং প্রাথমিক জীবন

১৯৪০ সালের ১৮ই নভেম্বর সালালাহরে আল সাইদ রাজপরিবারের সুলতান কাবুস জন্মগ্রহণ করেন। ১৭৪৪ সাল থেকে এই পরিবারটি আরব উপদ্বীপে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ওমান শাসন করে আসছে।
সে সময় সুলতান কাবুসের পিতা সাঈদ বিন তৈমুর ছিলেন ওমানের সুলতান। তিনি সুলতান তৈমুরের একমাত্র সন্তান ছিলেন। সুলতান কাবুসের পুরো নাম কাবুস বিন সাইদ আল সাইদ। সুলতান কাবুসের বংশধর ছিল মুসলিম ইবাদি মতের অনুসারী। বর্তমানেও ওমানের সিংহভাগ লোক ইবাদি। ইবাদিরা শিয়া বা সুন্নি থেকে স্বতন্ত্র।

সুলতান কাবুসের প্রাথমিক শিক্ষা অর্জিত হয় সালালাহরেই। এরপর জ্ঞান অর্জনের জন্য অল্প বয়সেই পাড়ি জমান ভারতের পুনেতে। পুনেতে তিনি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মার ছাত্র ছিলেন। এরপর মাত্র ১৬ বছর বয়সে শিক্ষা গ্রহণের জন্য চলে যান যুক্তরাজ্যে। ২০ বছর বয়সে ভর্তি হন লন্ডনের বিখ্যাত ‘রয়েল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স্ট‌ে’। সেখান থেকে ১৯৬২ সালে স্নাতক সমাপ্ত করার পর যোগ দেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে।

বৃটিশ আর্মির একজন সাধারণ সৈন্য হিসেবে তিনি জার্মানিতে এক বছর দায়িত্ব পালন করেন। সামরিক দায়িত্ব পালন সমাপ্ত করে পুনরায় ফিরে আসেন লন্ডনে। সেখান থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন। তার বাবা সুলতান সাঈদ বিন তৈমুরের কড়া নজরদারি থেকে বাঁচতে অনুকূল সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন কাবুস। তারপর ফিরে আসেন নিজ দেশ ওমানে। সালালাহতে ফিরে আসার পর তিনি ইসলাম এবং দেশের ইতিহাসের উপর পড়াশোনা করেন।

এক বছর ব্রিটিশ আর্মিতে ছিলেন সুলতান কাবুস; image: wikimedia

ক্ষমতা দখল

সুলতান কাবুস এর পিতা সাঈদ বিন তৈমুর ছিলেন ভীষণ রক্ষণশীল। তিনি ওমানকে বানিয়ে রেখেছিলেন পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর দেশ হিসেবে। একদিকে দারিদ্র্যতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, পুষ্টিহীনতা অন্যদিকে কড়াকড়ি শাসন, সব মিলিয়ে তখন ওমানের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। সাঈদ বিন তৈমুর ওমানে রেডিও, টেলিভিশন এমন কি বিদ্যুৎ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল। ছাতা কিংবা সানগ্লাস এর মত নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসেও ছিল নিষেধাজ্ঞা। ওমানে কে বিয়ে করতে পারবে, কে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে, কিংবা কে দেশত্যাগ করতে পারবে, সবকিছুর সিদ্ধান্তই তিনি দিতেন। পুরো দেশকে পরিণত করে রেখেছিলেন দাস বাণিজ্যের অভয়াশ্রমে।
কিন্তু সুলতান কাবুস ছিলেন এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সুলতান কাবুস বিভিন্ন দেশ ঘুরে উচ্চশিক্ষা অর্জন করার কারণে কিছুটা মুক্তচিন্তার অধিকারী ছিলেন। পিতার রক্ষণশীল ও অনগ্রসরতার বিপরীতে তিনি কিছু করতে চেয়েছিলেন।

১৯৭০ সালের ২৩ শে জুলাই, মাত্র ২৯ বছর বয়সে ব্রিটিশদের সহায়তায় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পিতাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন সুলতান কাবুস। মূলত ব্রিটিশ আর্মিতে যোগ দেওয়ার কারণেই সুলতান কাবুসের ভাগ্য বদলে গিয়েছিল। পিতাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্নভাবে ব্রিটিশ আর্মির সহায়তা পেয়েছিলেন তিনি। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর তিনি ঘোষণা করেন রাষ্ট্রকে আর মাসকাট বা ওমান নামে ডাকা হবে না। রাষ্ট্রীয় একতার জন্য তিনি নতুন নাম ঘোষণা করেন ‘ওমান সালতানাত’। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর শুরু করে দেন সংস্কারযজ্ঞ। উদ্যোগ নেন ওমানকে আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার।

সে সময় ওমানের দক্ষিণাঞ্চলে উপজাতিদের বেশ সশস্ত্র তৎপরতা ছিল। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক বছরের মধ্যেই ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের সাহায্য নিয়ে ওমানের দক্ষিণাঞ্চলে উপজাতিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা দমন করেন। এ সমস্ত বিদ্রোহী ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করার জন্য তিনি সাহায্য নেন ইরানের মোহাম্মদ রেজা পাহলভি, জর্ডানের বাদশাহ হুসাইন বিন তালাল এবং ব্রিটিশ স্পেশাল ফোর্স ও বিমানবাহিনীর।

সুলতান কাবুসের শাসনামলে ওমান

সুলতান কাবুস ছিলেন একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি। পিতাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সুলতান কাবুস ওমানে আধুনিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেন। প্রতিষ্ঠা করেন অসংখ্য স্কুল, কলেজ এবং হাসপাতাল। ওমানের তেল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে খুব দ্রুতই একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তার শাসনামলে ওমান একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়।

শুধু তাই নয়, সুলতান কাবুসের আমলেই ওমানে একটি লিখিত সংবিধান প্রণীত হয়। ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসে রাষ্ট্রের মৌলিক বিধি উপস্থাপন করেন ওমানের সুলতান কাবুস বিন সাঈদ আল সাঈদ। এটিই হলো ওমানের প্রথম লিখিত সংবিধান। এই সংবিধান ইসলামী আইন ও প্রচলিত আইনের কাঠামোয় বিভিন্ন অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। এর মাধ্যমে মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে  কোনো সরকারি শেয়ার হোল্ডিং সংস্থার কর্মকর্তা হওয়া যাবে না। ২০১০ সালের হিসাব মতে, ওমানের মানুষের গড় আয়ু ৭৬ বছর, যা পৃথিবীর দীর্ঘ আয়ুর দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।

১৯৭০ সালে যখন সুলতান কাবুস ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন ওমানে মাত্র তিনটি স্কুল ছিল, উচ্চ শিক্ষার কোনো মাধ্যম ছিল না। বর্তমানে ওমানে প্রায় ১১ হাজার স্কুল রয়েছে। এছাড়াও উচ্চশিক্ষার জন্য রয়েছে অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে। উচ্চশিক্ষার জন্য ওমানের সর্বপ্রথম ১৯৮৬ সালে ‘সুলতান কাবুস বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

মাসকাটের একটি মসজিদ; image: getty image
৩,০৯,৫০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটির বর্তমান মোট জনসংখ্যা ৫০,৯৯,৮২২ জন। এই জনসংখ্যার প্রায় ৪৩ শতাংশই সে দেশের নাগরিক নন। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর প্রবাসী কর্মের সন্ধানে ওমানে পাড়ি জমিয়েছেন। বর্তমানে ওমানের সাক্ষরতার হার ৯৫.৬৫ শতাংশ, যা আরব বিশ্বের সর্বোচ্চ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ওমানের মাথাপিছু আয় প্রায় ১৭’হাজার মার্কিন ডলার। সুলতান কাবুস যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন ওমানের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৩৫৪ মার্কিন ডলার। সুলতান কাবুস যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন ওমানের জিডিপি ছিল মাত্র ২.৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

একে পরে কোন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ভাগ্য বদলাতে থাকে ওমানের মানুষদের। উন্নয়ন এক সময় ওমানকে এমন অবস্থানে নিয়ে যায় যে, ২০১০ সালে জাতিসংঘ দেশটিকে মানব উন্নয়ন সূচকে চীনের চেয়েও এগিয়ে রাখে।
এ উন্নয়ন ওমানে সুলতান কাবুসকে এক মহান ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে আরব বিশ্বেও। সুলতান থাকা অবস্থায় তিনি ছিলেন একাধারে ওমানের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরও ছিলেন তিনি।

বর্তমানে ওমানের নারীরা ইসলামিক বিধি মেনে স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারেন। পড়াশোনা, চিকিৎসা কিংবা অফিস-আদালতসহ সব জায়গাতেই নারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। মজার ব্যাপার হল, অন্যান্য দেশে নারীদের অনগ্রসরতার কারণ নারী কোটা রাখা হয়। কিন্তু ওমানের সুলতান কাবুস বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা অনগ্রসর, যার কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের কোটা রয়েছে। কর্মক্ষেত্রেও পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমান ভূমিকা রাখছে যা সুলতান কাবুস এর শাসনামলে সম্ভব হয়েছে।

নরেন্দ্র মোদির সাথে সুলতান কাবুস; image: india times
২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় ওমানেও কিছু অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দেশটিতে বড় কোনো বিক্ষোভ হয়নি। তবে কর্মসংস্থানের দাবিতে ওমানের বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করে। তাদের দাবি ছিল আরও অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং দুর্নীতি বন্ধ করা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রথমদিকে কিছুটা নমনীয় থাকলেও পরবর্তীতে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস এবং গুলি ছোড়ে। এতে দুইজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছিল।
সুলতান কাবুসের দীর্ঘ শাসনব্যবস্থায় বিক্ষোভকারীরা ব্যাপক বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে না পারলেও মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের একটি পরিবর্তন আসে। দীর্ঘদিন ধরে মন্ত্রিত্বে থাকা কিছু ব্যক্তিকে সরিয়ে দেন সুলতান কাবুস। এছাড়া সরকারি চাকুরি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

তখন থেকেই সেদেশের গণমাধ্যমগুলোর প্রতি কড়াকড়ি নীতি আরোপ করা হয়। সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিত স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয়। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এর ব্যাপক প্রতিবাদ করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, তখন বিভিন্ন বই বাজেয়াপ্ত এবং মানবাধিকার কর্মীদের হয়রানিও করা হয়। সুলতান কাবুস এর দীর্ঘ ৫০ বছরের শাসনামলে এটি ছিল একমাত্র বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

ব্রিটিশ রাণীর সাথে সুলতান কাবুস; image: Indian press

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুলতান কাবুস

ছোট্ট একটি দেশ ওমানের সুলতান হলেও, সুলতান কাবুসের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব মোটেও কম ছিল না। তিনি ছিলেন একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনি সবসময়ই নিরপেক্ষ থেকেছেন।
অর্ধশতকের দীর্ঘ শাসনে বৈশ্বিক নানা গোলযোগের মধ্যেও নিজের দেশকে একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ থেকে উপসাগরীয় অঞ্চলের সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। শুধু তাই নয়, বিচক্ষণতা ও নিরপেক্ষ অবস্থান এর মধ্য দিয়ে নিজেকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছেন।

সুলতান কাবুসের হাত ধরেই ওমান আরব লীগ ও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এছাড়াও উপসাগরীয় আরব রাজতন্ত্রগুলোকে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল’।

বিশ্বের প্রায় সব আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে ওমানের সুদৃঢ় সম্পর্কের নেতৃত্ব দেন কাবুস। ১৯৭৯ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে আরবের প্রথম দেশ হিসেবে মিসরের শান্তি চুক্তির নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক হাঙ্গামা, গোলযোগ এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপ এর মধ্যে থেকেও সুকৌশলী নেতৃত্বের জন্য তাকে চাম্পিয়ন না বলে কোন উপায় নেই। বিশ্বের পরাশক্তি গুলোর সাথে তিনি সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। এমনকি পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন দুটি দেশের সাথে ওমানের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মত। উদাহরণস্বরূপ, ইরান এবং ইসরাইলের মধ্যে শত্রুতা থাকলেও দুই দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্ব ছিল ওমান সুলতানের। অপরদিকে সৌদি আরবের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই ইয়েমেনী হুতিদের সহায়তা করেছেন।

ইরানের কিংবদন্তি নেতা আহমাদিনেজাদের সাথে সুলতান কাবুস; image: middle esat eye
নিজের দেশ ওমানকে পরিণত করেছেন মধ্যপ্রাচ্যের সুইজারল্যান্ডে সেখানে শত্রুভাবাপন্ন বিভিন্ন পক্ষ পরস্পরের সাথে নানা ইস্যুতে আলোচনা এবং সমঝোতা বৈঠকে মিলিত হয়। ২০১১ সালে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ইরানে ৩ মার্কিন পর্বতারোহীর জেল হলে তাদের মুক্ত করতে মধ্যস্থতা করেছিল ওমান সুলতান। শুধু তাই নয়, এই সংকট নিরসনে সুলতান নিজে ওমানের পক্ষ থেকে তিন আরোহীর জন্য ৫ লক্ষ করে মোট ১৫ লক্ষ মার্কিন ডলার মুক্তিপণ পরিশোধ করে দেয়।

২০১৩ সালে সর্বপ্রথম ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এক টেবিলে আনতে সক্ষম হয় ওমান। ওই আলোচনার সূত্র ধরেই তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে দুই পক্ষ। যা ঐ অঞ্চলে শান্তি স্থাপনের জন্য ঐতিহাসিকভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই আলোচনার ধারাবাহিকতায় ঐতিহাসিক পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি হয়েছিল।

সুলতান কাবুস চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করেন। ১৯৯৪ সালে উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে ওমানেই প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সফর করেন আইজ্যাক রবিন। এর বছর দুয়েক পর ইসরায়েলের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী শিমন প্যারেজও ওমান সফর করেন। অন্যদিকে সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের মতো প্রতিবেশী অন্য দুটি শক্তিশালী রাষ্ট্রও ওমানকে সবসময় কাছে টেনেছে এবং নিজেদের মিত্র বলে দাবি করেছে। 

হাসান রুহানি ও সুলতান কাবুস; image: middle east eye
২০১৫ সালে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের নেতৃত্বে হামলা শুরু হলে ওমান এতে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানাই। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করে। এছাড়া ২০১৬ সালে সৌদি আরব, আরব আমিরাত এবং অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলো কাতারকে অবরুদ্ধ করার সময়ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে ওমান।

আরো পড়ুনঃ

এফবিআই এর চোখে বিশ্বের শীর্ষ কয়েকজন সন্ত্রাসী

ঐতিহাসিক যে যুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছিল মাত্র ৩৮ মিনিটেই!

২০১৮ সালে ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে নিজ প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান সুলতান কাবুস। ওমানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখা যায়, ওমানের ট্রেডিশনাল সাদা পোশাক, সাদা পাগড়ী এবং সাদা স্যান্ডেল পরিহিত বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার স্ত্রী সারাকে স্বাগত জানাচ্ছেন সুলতান কাবুস। যদিও ওই প্রতিবেদনে দুই নেতার মধ্যে কি নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা গোপন রাখা হয়।

২০০৭ সালে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সুলতান কাবুস বলেন-

আমরা দেশের ভেতর নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজ করি। আর বিদেশীদের সাথে বন্ধুত্ব, শান্তি, ন্যায়বিচার ও সম্প্রীতি, সহবস্থান এবং গঠনমূলক সংলাপে বিশ্বাস করি। এভাবেই আমরা শুরু করেছিলাম, এখনো আমরা এভাবেই আছি, আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা এভাবেই চলবো।

মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার

২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি, শুক্রবার ৭৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন সুলতান কাবুস। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। ২০১৪ সাল থেকেই তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শরীরে বাসা বাঁধা ক্যানসারের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগেই তিনি বেলজিয়াম থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরেছিলেন।
৭৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন সুলতান কাবুস; image: getty image
১৯৭৬ সালে সুলতান কাবুস চাচাতো বোন নাওয়াল বিনতে তারিক আল সাইদকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তাদের দাম্পত্যজীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র তিন বছরের সংসার জিবনে তারা নিঃসন্তানই থেকে যান। এরপর পুরোটা জিবনে তিনি আর বিয়ে করেননি। সে কারণে তার কোন উত্তরাধিকারী ছিল না। জীবদ্দশায় তিনি কাউকে উত্তরাধিকারি হিসেবে ঘোষণা করেননি।
ওমানের সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুলতানের পদ খালি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে রাজপরিবারকে নতুন সুলতান নির্বাচন করতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় সুলতান হিসেবে কাবুস বিন সাঈদের চাচাতো ভাই হাইথাম বিন তারিক আল-সাঈদের নাম ঘোষিত হয়। তিনি এখন ওমানের বর্তমান সুলতান।

This is a Bengali article. It’s a biography of sultan Qaboos. Necessary reference are hyperlinked within article.
Featured Image: Getty Image

Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous Article

ডু দ্যা রাইট থিং (1989) : স্পাইক লির ম্যাগনাম ওপাস যা তিন দশক পর এখনও প্রাসঙ্গিক

Next Article

এফবিআই এর চোখে বিশ্বের শীর্ষ কয়েকজন সন্ত্রাসী

Related Posts

নেটফ্লিক্সের বিবর্তন : একটি ডিভিডি রেন্টাল কোম্পানি যেভাবে পরিণত হলো বিশ্বের জনপ্রিয়তম স্ট্রীমিং প্লাটফর্মে [পর্ব : ২]

পূর্বের অংশের পর থেকে ২০১৩ : ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল ছিলো নেটফ্লিক্সের জন্য ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়। ২০১৩ সাল থেকেই…

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি এবং মোহসিন ফখরিযাদে

সূচিপত্র Hide ক্যারিয়ারজাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাপারমাণবিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণপারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি (২০০৭-২০২০)মৃত্যু মোহসিন ফখরিযাদে। ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী। মনে করা হতো…

হোয়াইট ডেথ: ইতিহাসের সর্বাধিক কিল রেকর্ড যে স্নাইপারের

সূচিপত্র Hide শীতকালীন যুদ্ধসর্বাধিক হত্যার রেকর্ডপ্রাথমিক জিবনহাইহার ‘হোয়াইট ডেথ’ হয়ে ওঠাদ্যা হোয়াইট ডেথ (২০১৬) ইতিহাসে অনেক দুর্ধর্ষ স্নাইপারের…

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন

Total
0
Share