উসমানীয় সাম্রাজ্য ঐতিহাসিকভাবে তুর্কি সাম্রাজ্য বা অটোম্যান সাম্রাজ্য বলে পরিচিত। এই সাম্রাজ্যের স্রষ্টা ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা উসমান গাজীর পিতা আরতুগ্রুল গাজী।
জানা যায়, কয়েকটি আমিরাতের মাঝে পশ্চিম আনাতেলিয়ার একটি আমিরাত ছিল আরতুগ্রুল গাজির পুত্র উসমানের। তার নাম অনুসারেই সাম্রাজ্যকে উসমানীয় রাজ্য বা অটোম্যান সাম্রাজ্য বলা হয়।
১২৯৯ সালে অঘুজ তুর্কি বংশোদ্ভূত প্রথম উসমান উত্তরপশ্চিম আনাতোলিয়ার দ্বায়িত্ব পান।, প্রথম দিকে রোমের সেলযুক সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত থাকলেও রোমের সেলজুক সাম্রাজ্যের ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এবং ধীরে ধীরে একটি বৃহৎ সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রথম মুরাদ কর্তৃক বলকান জয়ের মাধ্যমে উসমানীয় সাম্রাজ্য বহুমহাদেশীয় সাম্রাজ্য হয়ে উঠে এবং খিলাফতের দাবিদার হয়। ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের কনস্টান্টিনোপল জয় করার মাধ্যমে উসমানীয়রা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য উচ্ছেদ করে। ১৫২৬ সালে হাঙ্গেরি জয়ের পর ইউরোপের বলকান অঞ্চল সমূহ নিয়ে বড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পৃথিবীতে ইতিহাসে শতাব্দীর পর শতাব্দী অর্থনৈতিক শক্তিতে অটোমানরা ছিল সবচেয়ে এগিয়ে।
এই সুলতানদের প্রাধান্য ছিল স্বয়ং সুদূর দক্ষিণপূর্ব ইউরোপেও। দখলদারিতে একটা সময় তাদের হাত চলে যায় পূর্ব ও উত্তর আফ্রিকাতেও।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য হিসেবে খ্যাত এই অটোম্যান সাম্রাজ্য এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে এদের দখলদারি বাড়তেই থাকে।
ইতিহাস বিখ্যাত দানিয়ুব নদীর তীরবর্তী অঞ্চল থেকে শুরু করে নীল নদ অব্দি এদের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী তাদের লাভজনক অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিখ্যাত স্থাপনা এবং জ্যোতির্বিদ্যার উন্নতির জন্য সারা বিশ্বে ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু দেখা যায় যে, এতো এতো সফলতার পরেও একটা সময় এই বিশাল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। গোটা বিশ্ব এদের পতন নিজ চোখে দেখেছিলেন।
ঠিক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২২ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে পতন ঘটে অটোমান সাম্রাজ্য। চুক্তির মাধ্যমে তৎকালীন অটোমান ষষ্ঠ মেহমেদকে পদচ্যুত করা হয়। তারা তাদের এই পরাজয় মেনে নিয়ে একটি ব্রিটিশ জাহাজ নিয়ে ইস্তাম্বুল ত্যাগ করেন অটোম্যান সুলতান।
এই অটোমানদের পদত্যাগের পরেই আধুনিক তুরস্কের অভ্যুদয় ঘটে। ইতিহাসবিদরা তাদের এই পতন নিয়ে বিস্তর আলোচনাও করেছিলেন। কিন্তু এই বিতর্কের শেষ কোথায় ছিল তা জানা মুশকিল! ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালে দেখা যাবে যে, সাম্রাজ্যবাদ এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একে অপরের বিপরীতে অবস্থান করেছে। বেশ কিছু শাসকরা বরাবরই সামরিক শক্তিতে অত্যাধিক মনোযোগী ছিলেন। অটোমান সাম্রাজ্যও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিন্তু এরা এদের পরিধি বাড়াতে গিয়ে পুরো সাম্রাজ্যে শিক্ষার প্রসার বৃদ্ধি করতে পারেননি। যার ফলে বিশ্ব অনেকটাই আধুনিক হলেও এরা অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। তবে জানা যায় যে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইয়োরোপীয়দের মতো অটোমানরাও শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নতি করার চেষ্টা করতে থাকে। কেননা একটি জাতীকে আর যাই হোক শিক্ষা থেকে দূরে রাখা সম্ভব না এটা হয়ত তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্যালেসে জাদুঘরে বেশ কিছু বই সংরক্ষিত আছে, যার তথ্যমতে ১৭৯০ এর দশকে পুরো ইস্তাম্বুলে ১৭৯ টি মাদ্রাসা ছিল। তবে বাকি মাদ্রাসাগুলোর অবস্থান ছিল ইয়ুপ, উসদার এবং গালাতায়। এইসব মাদ্রাসায় প্রায় ২৭৯৭ জন ছাত্র যারা প্রায় ২০৪৬ টি কামরায় বাস করতো। শিক্ষার হার নিয়ে একেক দেশে একেক রকমের চিন্তা ভাবনা কাজ করে। অটোমান সাম্রাজ্যদের মধ্যেও শিক্ষা নিয়ে ছিল এক অন্য রকম চিন্তা।
কোন জাতীর উন্নতির পূর্ব শর্ত হচ্ছে সেই জাতী শিক্ষিত কিনা, সেই জাতীর উন্নতি অবনতি সব কিছুই নির্ভর করে সেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা দেখে। এর খুব ভালো উদাহরণ হচ্ছে এই অটোমানরা। তাদের ছিল না কোন আধুনিক অস্ত্রশাস্ত্রের পারদর্শী সেনা, ছিল না শিক্ষিত কোন প্রকৌশলী। এমনকি ডাক্তার পর্যন্ত ছিল না।
বিংশ শতাব্দীতে এসে ইউরোপীয় দেশগুলোয় যখন শিল্পে, এবং শিক্ষায় সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই অটোমানদের শিক্ষার হার ছিল মাত্র ৫% থেকে ১০%! যুদ্ধে পরাজয় হয়ে যুদ্ধ কৌশল কিংবা শক্তি সামর্থ্যকে দায়ী করা যায়, কিন্তু জাতী হিসেবে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে পিছিয়ে পড়ার জন্য সাম্রাজ্যের এই পতনে শিক্ষাকেই দায়ী করা যেতে পারে।
কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে অটোমান সাম্রাজ্যরাও ছিলেন আলোচনার শীর্ষে। শিক্ষার দিকে পিছিয়ে থাকলেও কৃষিতে ছিলেন তারা অনেকটাই এগিয়ে। এমনকি সারা বিশ্বে অন্যান্য যেকোনো অঞ্চল থেকে আরো অনেকটাই সমৃদ্ধশালী। তাদের অর্থনীতির সিকিভাগই ছিল কৃষি নির্ভর। যদিও তাদের ব্যবসা বানিজ্যের ধরণ অনেকটাই ভেনিসের মতো। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের জীবিকার এবং বানিজ্যের মূল হাতিয়ারে পরিণত হয় শিল্পকারখানা।
একই সময়ে সুলতানরা সবে মাত্র শিক্ষায় মনোযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের এই শিক্ষা প্রকৌশল নির্ভর ছিল না। যার দরুন শিল্প নিয়ে কাজ করার মতো যথাযথ জনবলের ঘাটতি দেখা যায়। এবং এর কারণে ইউরোপের কাছাকাছি এসেও শিল্প বিপ্লবের হাতছানি দিতে পারেনি এই অটোমান সাম্রাজ্যরা। রাজনীতিতেও অটোমান সাম্রাজ্যদের বেশ কিছু ইতিহাস লক্ষ্য করা যায়। শোনা যায়, গণতন্ত্রের উত্থান সকল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী ছিলেন।
১৭৯০ এর দশকে ব্রিটিশরা আমেরিকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন কেবল মাত্র এই গণতন্ত্রবাদী আমেরিকানদের জন্য। অটোমানদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বর্তমান তুরস্ক ছাড়াও সেকালে অটোমানদের অন্তর্ভুক্ত ছিল বুলগেরিয়া, মিশর, গ্রিস, হাঙ্গেরি সহ আরও অনেক দেশ। আফ্রিকার বেশ কিছু অঞ্চলও ছিল অটোমানদের অধীনস্থ! অধ্যাপক রেইনল্ড বেশ কিছুদিন অটোমানদের নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তার গবেষণার পর তিনি জানান যে, সাম্রাজ্যের দেশ সমূহ ব্যতীত আশেপাশের দেশেও রাজনীতিতে গণতন্ত্রের উত্থান ওইসব দেশে প্রভাব ফেলে।
কোন দেশে গোপনে গণতন্ত্রবাদী বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠে যার বিদ্রোহ কয়েকটি দেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৭০ এর দশকে বুলগেরিয়া সহ কয়েকটি দেশকে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় অটোমানরা। এরপর ১৯১২ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত চলা বলকান যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চল ছেড়ে দিতে বাধয হয় তারা। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, সেকালে রাশিয়ান সাম্রাজ্যকে অটোমান সুলতানরা নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন। আর সেই গবেষণা করা অধ্যাপক রেইনল্ডও এই ব্যপারে সম্মতি জানিয়েছিলেন। দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে যে লড়াই ছিল তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লক্ষণীয় ছিল।
একে অপরের মুখোমুখি অবস্থান করলেও রাশিয়া কিছুটা হলেও বিপাকে পড়েছিলো বলে জানা যায়। সাধারণত সেলজুকের পতনের পর বেশ কিছু স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায় আনাতেলিয়া, এদের বলা হতো “গাজি আমিরাত।” ১৩০০ সাল নাগাদ দুর্বল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য তুর্কি এই অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা হারিয়ে ফেলে। ইতিহাসের পাতায় উঠে এসেছে, পনেরো শতাব্দীতে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছিল এই অটোমান জাতীরা।
আরো পড়ুনঃ
ইন্টারভিউ প্রশ্ন: “আপনি কিভাবে নিজেকে বর্ণনা করবেন?”
একটি সফল চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য সেরা কৌশল
কিন্তু এক সময় বিভিন্ন কারণে এর পতন নেমে আসে। এশিয়া ছাড়া সুদূর দক্ষিণপূর্ব ইউরোপেও প্রাধান্য ছিল তাদের। কিন্তু এরপরেও কেন এদের পতন হয় তা ইতিহাস জানায় খুবই বর্ণনাতীত ভাবেই! উসমানীয় রাজ্যের বেশ কিছু সফলতার পরেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর আনুষ্ঠানিক ভাবে পতন ঘটে অটোমান সাম্রাজ্যদের। শোনা যায়, চুক্তির মধ্য দিয়ে তৎকালীন অটোমান সুলতান ষষ্ঠ মেহমদকে পদচ্যুত করা হয়। তারা তাদের এই পরাজয় মেনে নিয়ে এক ব্রিটিশ জাহাজে করে ইস্তাম্বুল ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং এক পর্যায়ে তারা ইস্তাম্বুল ত্যাগ করেন। এবং তাদের এই ইস্তাম্বুল ত্যাগের পরেই অটোমানদের পতনের পর আধুনিক তুরস্কের অভ্যুদয় হয়।
বিভিন্ন ইতিহাসবিদরা তাদের এই পতন এবং ত্যাগ নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা করেন এবং এর দ্বারা বেশ কিছু বিতর্কেরও জন্ম হয়।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠার পরপরই অটোমান সাম্রাজ্যের দুর্বল শাসক জার্মানির সাথে সন্ধি চুক্তি করে এবং চুক্তির শর্ত হিসাবে হিটলারের বাহিনীকে সমর্থন করে অসময়ে যুদ্ধে যোগ দিয়ে পরাজিত হয়। যুদ্ধের মাঝেই অটোমানের আরব অঞ্চলগুলো বিদ্রোহ করে বসে। একটা সময় তাদের কার্যকলাপে যুদ্ধে ভুল সিদ্ধান্ত সহ একেকটা প্রক্রিয়ায় ব্যর্থ হতে থাকে, যার ফলে খুব দ্রুত অটোমান সাম্রাজ্য ছোট হতে হতে এক সময় একেবারেই ধ্বংস হয়ে যায়।
This is a Bangla Article. This article is discussed about the Ottoman Empire.
All references are hyper linked.
Featured image is taken from Google.