বিশ্বসেরা অনলাইন শপিং সাইট অ্যামাজন সৃষ্টির গল্প
বর্তমান প্রযুক্তি খাতে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় বন্দি করে দিয়েছে বেশ কিছু নতুন আবিষ্কৃত বিভিন্ন খাত। মানুষ এখন ঘরে বসেই বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করতে পারছে। চোখের পলকে বা শারীরিক পরিশ্রম ছাড়াই তার ব্যক্তিগত কাজ সহ বিভিন্ন অফিসিয়াল কাজেও বর্তমান বিশ্বে এক অভাবনীয় পরিবর্তন এনেছে নতুন প্রজন্মের বেশ কিছু প্রযুক্তি। কোন পণ্য পছন্দ হলে এখন আর কাউকে বাইরে গিয়ে সময় নষ্ট না করে বরং ঘরে বসেই তার সেই পণ্য অর্ডার করতে পারছেন।
ডিজিটাল যুগের এই অভাবনীয় পরিবর্তনটি এনেছে বিশ্বসেরা অনলাইন শপিং সাইট অ্যামাজন।
ইন্টারনেট জগতে অ্যামাজন একটি অতি পরিচিত নাম। ছোট্ট পরিসরে গড়ে তোলা বর্তমান এই পৃথিবী খ্যাত অনলাইন সাইটটির একদিনেই এতো উন্নতি সম্ভব হয়নি। এর পেছনে লুকিয়ে আছে এর আবিষ্কৃত হওয়ার অজানা বেশ কিছু মজাদার গল্প।
অ্যামাজন প্রতিষ্ঠার চিন্তা এবং প্রতিষ্ঠা হলো যেভাবেঃ
১৯৯৪ সালের ৫ই জুলাই জেফ বেজোস নামের এক ব্যক্তি এই অ্যামাজন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এক অফিসে চাকুরীরত থাকা অবস্থায় তার উপর দায়িত্ব পড়ে ইন্টারনেটের উপর বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধানের। তিনি তখন আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলেন ইন্টারনেটের উপর ব্যবহার প্রতি বছর প্রায় ২৩শ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তখন তার মাথায় এক পরিকল্পনা আসে যে, এই ইন্টারনেটের সাহায্যে বেশ সহজে পণ্য বিক্রি করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকতে পারে। এই ভাবনার পরে জেফ তার চাকুরি ছেড়ে দিয়ে প্রথম অ্যামাজর বিজনেস নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। একদা নিউইয়র্ক থেকে সিয়াটল যাত্রার সময় জেফ সর্বপ্রথম আমাজন নিয়ে মূল পরিকল্পনা করেন। বৃহৎ এই অনলাইন কোম্পানিটির প্রথম মাত্র বিশটি পণ্যের তালিকা করা হয়। এর মধ্যে ছিল- সিডি, সফটওয়ার, হার্ডওয়ার সহ ছিল আরও বেশ কিছু প্রোডাক্ট। তবে এর মধ্যে মূল প্রোডাক্ট হিসেবে বইকে তালিকাভুক্ত করা হয়। জেফ সিদ্ধান্ত নেন অ্যামাজনকে একটি অনলাইন ভিত্তিক বই বিক্রির বুক স্টোর হিসেবে দাঁড় করাবেন। তার এই বিজনেসের কাজটি শুরু হয় তার বাড়িতেই, তার গাড়ির গ্যারেজে। পরিপূর্ণ মূলধন না থাকা সত্ত্বেও জেফ তার পরিকল্পনায় অটল ছিলেন। তার মুলধনের যোগানের জন্য জেফ তার পরিচিত সবার কাছে সাহায্য নেয়া শুরু করেন। জেফের বাবা মায়ের রিটায়ারমেন্টের পুরো তিন লক্ষ ডলার তার ছেলের হাতে তুলে দেন! এরপর আরও প্রায় সাত লক্ষ ডলার জেফ তার আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন। আর এই অর্থ দিয়েই জেফ শুরু করেন তার অ্যামাজনের বিজনেসটি। মাত্র দুটি ঘর থেকে অ্যামাজনের কাজ শুরু হলেও তার কর্মীদের সাথে মিটিং করার পর্যন্ত পর্যাপ্ত ঘর ছিল না। আর তাই এদের মিটিং সম্পন্ন হতো এক বুক স্টোরে।
অ্যামাজনের আয় এবং কর্মচারীঃ
আমাজনে প্রায় তিনশো কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। এই কর্মীদের বিভিন্ন কাজে পুরো দেশে বিভিন্ন সেক্টরে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ১৬ জুলাই এর পথচলা আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু করেন জেফ এবং তার কর্মীরা। তাদের বিভিন্ন স্টেটে ছড়িয়ে দেয়ার পর কোন পণ্য বিক্রি হলেই তা জানানোর আদেশ দেন জেফ। এবং তাদের বিক্রির প্রথম সপ্তাহেই এর পরিমাণ দাঁড়ায় কয়েক হাজার ডলারে। এতো এতো উন্নতির পরেও আমাজনের দরজায় নেমে আসে এক কালো অধ্যায়! ১৯৯৭ সালে অ্যামাজনের প্রায় তিন মিলিয়ন শেয়ার বাজারে আটকে যায়। আর তাই এই ক্ষতি লাঘব করার জন্য এর প্রতিষ্ঠাতা দুই মাসের জন্য পাবলিক ফান্ডের জন্য কাজ করে। আর এই ফান্ডই তাদের আরেক সফলতা বয়ে আনে। ১৯৯৮ সালে খ্রিষ্ট ধর্মীয়দের ক্রিসমাসে অ্যামাজন ছোটদের খেলনা ও গিফট কেনার আরেকটি সেক্টর চালু করেন। এই সেক্টরে জেফ কমিশনও প্রদান করেন বলে জানা যায়।
অ্যামাজনের পণ্যসমূহঃ
১৯৯৯ সালে অ্যামাজনের কয়েক বিলিয়ন মূল্যের ঔষধ বাজারে আসে। এবং ২০০২ সালে প্রথম অ্যামাজনের পোশাক বাজারে আসতে শুরু করে। এই পণ্যটি বাজারে আসার পরপরই অ্যামাজনের পণ্য বাড়তে থাকে। বছর না যেতেই যুক্ত হয় আরও কয়েক হাজার নামীদামী ব্র্যান্ড। এরপর জেফ তার অ্যামাজনে A9 চালু করেন, এটি একটি বাণিজ্যিক ভিত্তিক সার্চ ইঞ্জিন। এর কয়েক বছর পরেই অ্যামাজনের বিজনেস ইটালি, জাপান, কানাডা সহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের ইতিহাস এবং অর্জনঃ
একটি ছোট অফিসে চাকুরী করা সেই জেফকে ২০১৭ সালে টাইম ম্যগাজিনে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করে। জেফ বেজোসের বর্তমান সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি ডলার। তার এই অবস্থান পিছিয়ে দিয়েছে বিল গেটসকেও! জেফ বেজোসের জন্ম ১৯৬৪ সালে। তার জন্মের কয়েক বছরেই তার বাবা মায়ের বিচ্ছেদ হলে জেফ তার মা জ্যাকির সাথে থাকতে শুরু করেন। জেফকে নিয়ে লেখা তার জীবনীতে উঠে এসেছে, জেফ তার ছোট বয়স থেকেই বিজ্ঞান আর ইঞ্জিনিয়ারিং এর দিকে তার বেশ আগ্রহ ছিল। তার এই জীবনীর লেখকের নাম হচ্ছে ব্র্যাড স্টোন। তিনি বলেন, জেফ মাত্র তিন বছর বয়সেই স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে তার খেলনা খুলে ফেলতে পারতেন! বড় হয়ে জেফ প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং আর কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়েন। তার এই অ্যামাজনের বিরাট সফলতার পেছনে লুকিয়ে ছিল তার বেশ কিছু কৌশল। তিনি সবসময় চিন্তা করতেন যে অর্থ আয় করার জন্য তাকে অবশই অর্থ ব্যয় করতে হবে। আর এই চিন্তা থেকে কখনো তিনি পিছপা হননি। অ্যামাজনে বিভিন্ন পণ্যের বিক্রির জন্য তিনি ফ্রি শিপিং সুবিধা চালু করেছিলেন। এমনকি অ্যামাজনের বিভিন্ন পণ্যের দাম বেশ কম রাখতেন কোনোরকম বার্ষিক লাভের কথা না ভেবেই। বর্তমানে বইপ্রেমীদের বেশ পছন্দের কিন্ডল ই-বুক রিডার তৈরি করার আমাজনে চলে আসে আরেক বিরাট সফলতা। অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা নতুন নতুন চিন্তার কথা এগিয়ে নিয়ে গেছে, কখনোই তা মাঝ রাস্তায় ফেলে রাখেননি! বর্তমানে জেফ বেজোস ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার মালিক। বিয়ে করেছেন ম্যাকেঞ্জি নামে এক তরুণীকে। স্ত্রীর সাথে জেফের পরিচয় হয় মূলত তার সেই চাকুরীর স্থানে। তাদের এই বিনিয়োগের কারণেই দিনদিন আরও বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে অ্যামাজন। বিনিয়োগকারীদের ধারণা, এই অ্যামাজনের ভবিষ্যতে লাভের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে। কেননা অ্যামাজনের মতো কোন প্রতিষ্ঠানই এখন পর্যন্ত এতো স্বল্প পরিমাণে মুনাফা দিয়ে সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। আর তাই গেলো বছর প্রায় ১হাজার ৩৬০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে এই বৃহত্তম অনলাইন শপটি! ১৯৯৭ সালে পাবলিক কোম্পানিতে পরিণত হওয়ার পর অ্যামাজনের অর্থ উঠে ৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সম্ভবত ২০১৯ সালের জুন মাসে অ্যামাজন পণ্য বিক্রি করেছে প্রায় ৫৩০ কোটি ডলারের। এবং সেই বছরের প্রথম তিন মাসে মুনাফা করেছে ২৫০ কোটি ডলার।
বর্তমানে অ্যামাজনে চাকরি করেন প্রায় ৫ লাখ ৭৫ হাজার লোক যা লুক্সেমবার্গ নামক দেশের জনসংখ্যার প্রায় সমান। এক মাসের মধ্যে আমাজন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের সবগুলোতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ৪৫টি দেশে অর্ডার পাঠায়। জানা যায়, পাঁচ বছর পর অ্যামাজনের ক্রেতার এ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে বেড়ে ১ কোটি ৭০ লাখে দাঁড়ায় প্রায়! যেখানে বিক্রি শুরুতে ছিল ৫ লাখ ১১ হাজার ডলার, আর পাঁচ বছর পর তা দাঁড়ালো ১৬০ কোটি ডলারে।
অ্যামাজনের প্রতিদ্বন্দ্বীঃ
কিছু কিছু ব্যক্তি ধারণা করছেন যে, অ্যামাজনের সফলতার ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে চলে আসতে পারে। কারণ ইতিমধ্যেই অ্যামাজনের বেশ কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি হয়েছে আর তারা চেষ্টা করছে যেন অ্যামাজনের মতো বৃহৎ এই প্রতিষ্ঠানকে পাল্লা দিয়ে তাদের আগে যেতে পারে। তবে এই সম্পর্কে অ্যামাজনের কর্মরত কর্মচারী বা স্বয়ং জেফ তেমন চিন্তিত নন! কেননা তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে অ্যামাজন বাদে অন্য কোন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারলো কিনা। জানা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে নেটফ্লিক্সকে ভিডিও সেবা চালু করে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে অ্যামাজন। আর তারা প্রায় ২০০টি দেশে তাদের এই সেবা ছড়িয়ে দিবে। অ্যাপলের সাথে অ্যামাজনের স্ট্রিমিঙে কন্টেন্ট বিক্রির প্লাটফর্ম নিয়ে দিনদিন তাদের প্রতিযোগিতা বাড়ছেই। আর গুগলও অ্যামাজনের মাধ্যমে কেনাকাতার সুযোগ দিতে এক প্রকার নারাজ! অ্যামাজন তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন যে, তাদের বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বীদের তালিকায় রয়েছে লজিস্টিক ফার্ম, সার্চ ইঞ্জিন, সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট সহ সকল ধরণের মিডিয়া এবং খাদ্য উৎপাদন। আর শুধু নিজেদের স্বার্থের কথা চিন্তা না করা আমাজন কাজ করছে এখন অন্যের হয়েও! তারা নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও সেবা দিতে নিরলস কাজ করে চলেছেন। ক্লাউড সেবা, ওয়্যারহাউস ভাড়া, অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম সহ আরও বিভিন্ন প্রযুক্তি নিয়েও কাজ করে যাচ্ছে।
এতো কিছুর পরেও এই অনলাইন সাইটটি এখনো যুক্তরাষ্ট্রে বৃহত্তম রিটেইলার হয়ে উঠতে পারেনি। জানা যায়, দেশটির অ্যান্টিট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ তাদের গ্রাহকের উপর প্রভাব ও দামের বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন। সমালোচকদের মুখের উপর কড়া জবাব দেয়ার জন্য জেফ বেছে নিয়েছেন এক অভিনব পদ্ধতি। তিনি অ্যামাজনের লবিইস্ট নিয়োগের পেছনে খরচ আগের তুলনায় আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। অন্যান্য ধনীদের মতো জেফের দাতব্য কর্মকাণ্ড অনেকটাই কম, আর তাই এই প্রভাবশালী ব্যক্তিটি এখন দাতব্য কর্মকাণ্ড বাড়াতে যাচ্ছেন যা জানা যাবে ভবিষ্যতে স্বয়ং জেফের কাছেই!
আরো পড়ুনঃ
একটি ডিভিডি রেন্টাল কোম্পানি যেভাবে পরিণত হলো বিশ্বের জনপ্রিয়তম স্ট্রীমিং প্লাটফর্মে
This is a Bengali Article. Here, everything is written about the “Amazon”.
All reference links are hyperlinked.
Feature image taken from google