মোহসিন ফখরিযাদে। ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী। মনে করা হতো ইরানের যত গোপন পারমাণবিক কর্মসূচি আছে তার মূল হোতা হলো মোহসিন ফখরিযাদে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গবেষণা ও উদ্ভাবনী সংস্থার প্রধান। তিনি ইরানের রেভরল্যুশনারি গার্ডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ছিলেন। পশ্চিমা মিডিয়া এবং গোয়েন্দা সংস্থার মতে দেশটির গোপন পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিতে ফখরিযাদে মূল ভূমিকা রাখছিলেন। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা তাকে ইরানের “পরমাণু বোমার জনক” উপাধি দিয়েছিল।
ইসরায়েল বরাবরই বলে আসছে মোহসিন ফখরিযাদে ইরানের খুবই ক্ষমতাশালী ব্যক্তি এবং ইরানের পরমাণু কর্মসূচির প্রধান স্তম্ভ। তাই ইরানকে পরমানু কর্মসূচি থেকে বিরত রাখতে হলে ফখরিযাদের কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ২০১৮ সালে ইসরায়েলি বার্তা সংস্থা বলেছিল তাদের হাতে যেসব গোপন নথিপত্র এসেছে সেগুলো অনুয়ায়ী ইরানের পরমাণু কর্মসূচির তিনি প্রধান রূপকার।
মোহসিন ফখরিযাদের নেতৃত্বেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি গড়ে উঠছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেসময় মোহসিন ফখরিযাদেকে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির প্রধান বিজ্ঞানী উল্লেখ করে বলেছিলেন, “ওই নামটা মনে রাখবেন”।
২০১৫ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস ফখরিযাদেকে তুলনা করেছিল জে রবার্ট ওপেনহাইমারের সাথে। জে রবার্ট ওপেনহাইমার হলো সেই বিজ্ঞানী, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় “ম্যানহাটান প্রজেক্ট” এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যে প্রজেক্টের অধীনে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। জাপানে নিক্ষিপ্ত ফ্যাটম্যান এবং লিটলবয়ও তার হাত ধরেই নির্মিত হয়েছিল।
ক্যারিয়ার
মোহসিন ফখরিযাদের জন্ম ১৯৫৮ সালে ইরানের কোমে শহরে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হলে তিনি সেখানে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড এর সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তার সফলতার ধারায় ইসলামিক রেভুলেশনারি গার্ডের একজন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হন। ফখরিযাদে ১৯৯১ সালের শুরুর দিকে ইমাম হোসেইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি সদস্য ছিলেন।
২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকে, ফখরিযাদে বায়োলজিকাল স্টাডি সেন্টার নামে একটি উদ্যোগের নেতৃত্ব দেন, যাকে পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের (পিএইচআরসি) উত্তরসূরি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। এই গবেষণা দলের কার্যক্রম ছিল ইরানের বিখ্যাত লাভিজন শিয়ান টেকনিক্যাল সেন্টারে।
জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা
২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ফাখরিযাদের সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ইরান তার সাথে এ সংস্থার সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকার করে। ইরান ফখরিযাদের কাজ সম্পর্কিত কিছু তথ্য সরবরাহ করেছিল আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার কাছে। কিন্তু আইএইএ তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। আইএইএ বলেছে যে “এই তথ্য সঠিক নয়, কারণ তাদের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সাথে এর কোনো মিল নেই”, তবে আইএইএ তার অনুসন্ধানগুলোর সংশোধন অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে ইরান বারবারই দাবী করে আসছে আইএইএ তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করেছে।
আইএইএ’ এর সাথে সাক্ষাৎ না করার অপরাধে ২০০৬ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ফাখরিযাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং তার উপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে ফখরিযাদে ছিলেন ইরানের প্রতিরক্ষা ও সশস্ত্র বাহিনীর লজিস্টিক বিজ্ঞানী এবং পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের (পিএইচআরসি) প্রাক্তন প্রধান। সেসময় আইএইএ তাঁর প্রধান পিএইচআরসি-র কার্যক্রম সম্পর্কে তার সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলেন, তবে ইরান এই আবেদন অস্বীকার করেছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে জাতিসংঘের ২০০৭ সালের প্রতিবেদনে ফখরিযাদেকে ‘মূল ব্যক্তি’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
পারমাণবিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ
এমএএমডি প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পরে, ফখরিযাদে পারমাণবিক অস্ত্রের গবেষণা ও বিকাশে বিশেষায়িত একটি সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত সংস্থা ও ডিফেন্সিভ ইনোভেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এসপিএনডি) প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া ঐ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বও দিয়েছিলেন তিনি। ইরানের এই গোপন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এর সদর দফতর ইরানের প্রতিরক্ষা ও সশস্ত্র বাহিনী লজিস্টিকের মধ্যে অবস্থিত। ফখরিযাদে ২০০৮ এবং ২০১১ সালের মধ্যে এসপিএনডি-র পরিচালক ছিলেন। এসপিএনডি মালেক-অষ্টার প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে গবেষণায় যুক্ত ছিলো।
পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি (২০০৭-২০২০)
সানডে টাইমসে প্রকাশিত ২০০৭ সালের একটি ইরানি অভ্যন্তরীণ নথিতে ফখরিযাদেকে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচী পরিচালিত সংস্থার প্রধান ব্যক্তি ও অ্যাডভান্সড টেকনোলজি অব ডিপ্লোমেন্টের চেয়ারম্যান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরের চার বছরে বিশেষ নিউট্রন সম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপগুলোর জন্য “আউটলুক” শিরোনামের এই দস্তাবেজটিতে ইউরেনিয়াম ডিউটারাইড নিউট্রন ইনিশিয়েটার বিকাশের জন্য চার বছরের পরিকল্পনা পেশ করা হয়।
২০১০ সালে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে যে ফখরিযাদেকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির দায়িত্বে নেওয়া হবে বলে মনে করা হয়।২০১২ সালে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তাকে ‘তেহরানের পারমাণবিক অস্ত্রের গুরু’বলে সম্বোধন করেছিল। ২০১৪ সালে, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস তাকে ইরানের রবার্ট ওপেনহেইমার বলে অভিহিত করেছিল। ফখরিযাদেকে হত্যার পর আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি তাকে ‘দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও বিশিষ্ট পারমাণবিক ও প্রতিরক্ষামূলক বিজ্ঞানী’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এই বিষয়গুলো থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় ফাখরিযাদে ইরানের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অভিযোগ করেছে যে ফখরিযাদে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচী, ‘প্রকল্প-১১১’এর দায়িত্বে ছিলেন। তারা দাবী করেছি যে তিনি ইরানের জন্য পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। ইরান অস্বীকার করে বলেছে যে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য সামরিক বিভাগই রয়েছে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচীকে অস্বীকার করেনি। ফখরিযাদেকে ‘গ্রিন সল্ট’ প্রকল্পের পরিচালক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক বার্তায় দাবী করা হয়েছিল, ফখরিযাদেকে আমেরিকান গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ইরানের জন্য পারমাণবিক যুদ্ধের নকশার পরিকল্পনায় গভীরভাবে জড়িত বলে বর্ণনা করা হয়েছিল।
মূলত, মোহসিন ফাখরিযাদে ছিলেন তেহরানের ইমাম হুসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক। তার সূত্র ধরেই তিনি ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন গবেষণার কাজে। এরপর ইরানের সবচেয়ে গোপন পারমাণবিক প্রকল্পগুলোতে কাজ করার সুযোগ পান। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পদোন্নতি পেতে থাকেন। পরবর্তীতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এভাবেই তিনি ইরানের একজন বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। নজরে পড়তে থাকে পশ্চিমা গুপ্তঘাতকদের।
মৃত্যু
গত ২৭শে নভেম্বর, ২০২০ তারিখে তেহরানের কাছে অবস্থিত আবসার্ডের একটি গ্রামীণ সড়কে একটি বুলেটপ্রুফ প্রাইভেট কারে করে ভ্রমণের সময় ফাখরিযাদেকে আক্রমণ করে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসদের গুপ্তঘাতকরা। একটি কাঠ পরিবহনকারী বিস্ফোরক বোঝাই ট্রাক থেকে ফাখরিযাদের গাড়ির উপর এই হামলা চালানো হয়। দ্বিতীয় গাড়িটি বোমা হামলা করে ধ্বংস করা হয়। এরপর ফাখরিযাদের দেহরক্ষীরা গুপ্তঘাতকদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। হামলাকারীদের সাথে যুদ্ধে তিনজন দেহরক্ষী নিহত হয়, অন্যরা আহত হয়। ইরানী সূত্র জানিয়েছে যে হামলাকারীদের মধ্যে তিন থেকে চারজন নিহত হয়েছে। এই হামলায় ফাখরিযাদের পরিবারের সদস্যরাও নিহত বা আহত হয়েছেন। এছাড়াও একজন আত্মঘাতী হামলাকারীর সংবাদ পাওয়া গেছে। ঐ হামলায় ফখরিযাদে মারাত্মকভাবে আহত হন।
তাৎক্ষনিকভাবে ফাখরিযাদেকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন না থাকায় তাকে বাঁচানোর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তিনি মারা যান। এই ঘটনার পর ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী দোষীদের খোঁজে সমগ্র তেহরান ঘিরে ফেলা। বন্ধ করে দেয়া হয় যানবাহন চলাচল।
এই ঘটনার জন্য ইরান মোসাদকে দায়ী করে। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে বলেছেন, এ ঘটনা তাদের দেশের পরমাণু কর্মসূচির গতি ধীর করতে পারবে না। এছাড়া, দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সামরিক উপদেষ্টা হোসেইন দেঘান বলেছেন, এই হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের ওপর বজ্রের মত ‘আঘাত হানা’ হবে।
২০১৫ সালে ছয়টি বিশ্বশক্তির সাথে এক চুক্তিতে ইরান তাদের ইউরেনিয়ামের উৎপাদন সীমাবদ্ধ করার কথা বলেছিল। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পর, ইরান ইচ্ছাকৃতভাবে চুক্তির শর্তগুলোর বরখেলাপ করে আসছিল। ইসরায়েলের আশঙ্কা ছিল তারা হয়ত পুনরায় গোপনে পারমাণবিক কর্মসূচী শুরু করেছে।
এরপর ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের বিরোধিতা সত্ত্বেও জো বাইডেন জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ইরানের সাথে পুনরায় যুক্ত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে ইসরায়েল আরো শঙ্কিত হয়ে উঠে। সেই আশঙ্কা থেকেই শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীকে গুপ্তহত্যা করে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম স্তব্ধ দিতে চাচ্ছে ইসরায়েল। এমনটাই ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
All the references are hyperlinked within the article.
Featured Image: Alone Nixon/ Getty Image