দশম শতাব্দীর একদম শেষের দিকের কথা। মুসলিম বীর, সিপাহসালারগণ এশিয়ার প্রায় অর্ধেক ভূমি করতলগত করেছে তত দিনে। ইউরােপেও নিজেদের শাসন বিস্তৃত করেছেন। অধিকৃত প্রতিটি অঞ্চলেই গড়ে উঠেছে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির বিপুল চর্চাকেন্দ্র। ইউরােপের নেতৃস্থানীয় খ্রিষ্টানরা, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শাসনের নামে শােষণ করছিল সেখানকার নিরীহ জনগণকে। মুসলমানদের হাতে নিজেদের রাজ্য ও নেতৃত্ব হারিয়ে সবাই তখন অনেকটা দিশাহারা। সবার ভেতরই একটা আক্রোশ আর ক্রোধ দানা বাধছে সঙ্গোপনে।
এ সময়কালে ইউরােপের এই খ্রিষ্টানশক্তি একজোট হতে শুরু করল। মুসলমানদের হাত থেকে খ্রিষ্টানদের হারানাে ভূমিগুলাে পুনরুদ্ধার করতে হবে। এ জন্য যত ঘৃণ্য, হীন আর নৃশংস পথই অবলম্বন করতে হয়, তারা করবে। ক্রুশের ওপর হাত ছুঁয়ে সবাই শপথ নিল। প্রতিহিংসার এ লড়াইকে তারা নাম দিল ধর্মযুদ্ধ। ক্রুসেড। সম্মুখসমরে লড়াই করে কোনাে কালেই মুসলমানদের পরাজিত করা যাবে না—এ কথা তারা অনেক আগেই বুঝে গেছে। মুসলমানদের শৌর্যবীর্য আল্লাহপ্রদত্ত। এ শৌর্যবীর্য নষ্ট করার একমাত্র পথ তাঁদের চারিত্রিক অধঃপতন ঘটানাে। আরাম আর আয়েশের জিন্দেগীর প্রতি আকৃষ্ট করার পাশাপাশি পারস্পরিক দ্বন্দ্ব তৈরি।
খ্রিষ্টানদের সম্মিলিত জোট এ পথটাই বেছে নিল। একদল চৌকস গুপ্তচর পাঠিয়ে দিল প্রতিটি মুসলিম রাজ্যে। গুপ্তচরদের কল্যাণে মুসলিম আমির-ওমারার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল নর্তকী, সুন্দরী নারী, মদ্যপান আর অশ্লীলতা। আমির-ওমারাগণ ধীরে ধীরে জড়িয়ে গেলেন খ্রিষ্টানদের পাতানাে এ ফাঁদে। সেই সঙ্গে শুরু হলাে এক মুসলিম রাজ্যের সঙ্গে আরেক মুসলিম রাজ্যের দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ। মুসলিম শাসকবর্গ আরাম-আয়েশ আর ভাইয়ে ভাইয়ে শক্রতা-বিদ্বেষে ব্যস্ত। এই তাে সুযােগ! হারানাে ভূমিগুলাে পুনরুদ্ধারের এই তাে মােক্ষম সময়! খ্রিষ্টানরা প্রথমেই চাইল বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করতে।
১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি। ক্রুসেডারদের সম্মিলিত শক্তি পবিত্র ভূমি জেরুজালেমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে যাত্রা শুরু। জেরুজালেমের আশপাশের মুসলিম শাসক কেউই তাদের বাধা দিতে এগিয়ে আসেননি। সবাই তখন আমােদ-ফুর্তি আর নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহে ব্যস্ত। প্রতিরােধ তাে দূরের কথা, অনেক শাসক লাজ-শরম সব ভুলে গিয়ে খ্রিষ্টান-শক্তিকে উল্টো আরও সহযােগিতা করে আগ বেড়ে। কেবল একজন ছিলেন সিংহশার্দুল ঈমানদার। আল-কুদসের পার্শ্ববর্তী আক্ৰা শহরের শাসনকর্তা তিনি।
সম্মিলিত খ্রিষ্টান বাহিনী আক্রা হয়েই বায়তুল মুকাদ্দাস আক্রমণের সংকল্প করেছিল। তিনি খ্রিষ্টানদের এ স্পর্ধা সহ্য করতে পারলেন না। প্রতিবাদ করলেন। রুখে দাঁড়ালেন খ্রিষ্টানদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাদের সম্মিলিত বিশাল সেনাবাহিনীর বিপরীতে তার সৈন্যসংখ্যা নিতান্তই হাতে গােনা। তারপরও তিনি পিছু হটেননি।আল্লাহর ওপর ভরসা করে দাঁড়িয়ে যান পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস রক্ষা করার জন্য। কিছুতেই তিনি এ পথে বায়তুল মুকাদ্দাস আক্রমণ করতে দেবেন না।
১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি ক্রুসেডাররা আক্রা অবরােধ করে। ১৩ মে অবধি টানা তিন মাস অবরােধ করে রাখে। কিন্তু আক্রার মুসলমানরা প্রাণপণে লড়ে খ্রিষ্টান বাহিনীকে আক্রা প্রবেশ থেকে দমিয়ে রাখে। উপায়ান্তর না দেখে খ্রিষ্টানরা পথ পরিবর্তন করে অন্য পথে হামলা চালায় পবিত্র ভূমি আল-কুদসের ওপর।
১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জুন ক্রুসেডাররা আল-কুদস অবরােধ করে। আল কুদসের শাসনকর্তা তখন ইফতেখারুদ্দৌলা। তার সৈন্যসংখ্যা খ্রিষ্টানদের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। পঙ্গপালসদৃশ খ্রিষ্টান বাহিনীকে প্রতিরােধ করতে তিনি পার্শ্ববর্তী ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম রাজ্যগুলাের কাছে সাহায্য চাইলেন। কিন্তু পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলাের আমির-ওমারারা তখন খ্রিষ্টান বাহিনীর রসদ জোগাতেই ব্যস্ত! ইফতেখারুদ্দৌলাকে তাঁরা সাহায্য করবেন কীভাবে!
সবার কাছ থেকে নিরাশ হয়ে ইফতেখারুদ্দৌলা ক্ষুন্ন মনে এক আল্লাহর ওপর ভরসা করে নিজের যা আছে তা-ই নিয়ে প্রতিরােধ করতে লাগলেন খ্রিষ্টান বাহিনীর। শেষতক আর পেরে উঠতে পারলেন না।
১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জুলাই ইফতেখারুদ্দৌলার সকল প্রতিরােধব্যুহ চূর্ণ করে ক্রুসেডাররা হাজার নবীর স্মৃতিধন্য পবিত্র আল-কুদস শহরে অনুপ্রবেশ করে। আল-কুদস শহরে নেমে এল কিয়ামতের ভয়াবহতা। ক্রুসেডাররা মুসলিম পুরুষদের ঘর থেকে বের করে এনে জবাই করতে থাকে এক-এক করে। নারীদের ওপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। বাদ পড়েনি। নিস্পাপ শিশুরাও।
নিরস্ত্র অসহায় মুসলিমরা মসজিদুল আকসায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। আকসা তাে মুসলমানদের কাছে যেমন পবিত্র, খ্রিষ্টানদের কাছেও তেমনি সম্মানিত স্থান। এখানে রক্ত ঝরানাে দুই ধর্মেই পাপ। মুসলিমরা মনে করেছিল, মসজিদে আকসায় আশ্রয় নিলে হয়তাে রেহাই পাওয়া যাবে। খ্রিষ্টানরা অন্তত প্রাণে মারবে না সেখানে। কিন্তু উন্মত্ত সৈন্যরা সেখানে গিয়েও মুসলমানদের নৃশংসভাবে জবাই করতে থাকে।
মুসলিমদের তাজা খুন মসজিদ গড়িয়ে পাশের রাস্তায় এসে পড়ে। রাস্তায় চলমান খ্রিষ্টানদের ঘােড়ার পা পর্যন্ত ডুবে গিয়েছিল বহমান এ রক্তের স্রোতে। এভাবেই খলিফা উমরের বিজয় করা ফিলিস্তিনে ক্রুসেডারদের অনুপ্রবেশে অবনমিত হয়ে যায় দীর্ঘ চার শতাব্দী ধরে পতপত করে উড়তে থাকা বিজয় পতাকা। আর মুসলমানরা হয় চরম নৃশংসতা ও বঞ্চনার শিকার।
সালাহুদ্দিন আইয়ুবীর পুনরুদ্ধার
জেরুজালেম তখন খ্রিষ্টানদের দখলে। মসজিদে আকসাকে ইতিমধ্যেই তারা গির্জায় রূপান্তরিত করেছে। দীর্ঘ চার শতাব্দী ধরে যে মসজিদের আজান শুনে আল-কুদসের জনগণের ঘুম ভাঙত, সেখানে এখন ঢনঢন করে বাজে গির্জার ঘণ্টা। মুসলিম বিশ্বের প্রতিটা ঈমানদারের হৃদয়ে এ ব্যথা চিনচিন করে প্রতিটা মুহূর্ত। বাগদাদ শহরে এমনই এক ঈমানদার কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। মসজিদে আকসা হারানাের বেদনা যাকে তাড়া করে ফিরত প্রতিনিয়ত।
একবার তিনি মনের মাধুরী মিশিয়ে খুব যত্ন করে ফুল তুলে একটা মিম্বর বানালেন। মিম্বরটির সৌন্দর্যের খ্যাতি তামাম বাগদাদ নগরীতে চাউর হয়ে গেল। দলে দলে লােকজন আসতে লাগল মিম্বরটি দেখার জন্য। ধনকুবের অনেকেই চড়া মূল্যে কিনতে চাইলেন, কিন্তু মিস্ত্রি সাফ জানিয়ে দিলেন- এ মিম্বর বিক্রির জন্য নয়। তবে বাগদাদের কোনাে মসজিদে দান করে দাও!
-তা-ও করব না।
কেন কেন? বিক্রিও করবে না, কোনাে মসজিদে দানও করবে না, তাে এ মিম্বর বানিয়েছ কী জন্যে?
-এ মিম্বর মসজিদে আকসার জন্য বানিয়েছি। আল্লাহ চাহে তাে এটা একদিন আল-আকসায় স্থাপিত হবে।
কাঠমিস্ত্রির আজগুবি এ বাসনার কথা শুনে সবাই হাসাহাসি শুরু করল। আল-আকসা তাে খ্রিষ্টানদের দখলে। খ্রিষ্টানরা যেভাবে শক্তপােক্ত হয়ে বসেছে সেখানে, অদূর ভবিষ্যতে তা মুসলমানদের করতলগত হওয়া আকাশকুসুম কল্পনা বৈ কিছু নয়। অথচ এ কাঠমিস্ত্রি বলে কী! তার বানানাে মিম্বর নাকি আল-আকসায় নিয়ে স্থাপন করবে! মানুষের হাসি-তামাশাকে থােড়াই কেয়ার করে কাঠমিস্ত্রি তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর অটল থাকেন। সৌন্দর্যমণ্ডিত মিম্বরটি তিনি কারও কাছে বিক্রি করেন না, কোনাে মসজিদেও স্থাপন করেন না।
একদিন একটি বাচ্চাছেলে তার বাবার হাত ধরে এল মিম্বরটি দেখার জন্য। মিম্বর দেখতে এসে এর নির্মাতা কাঠমিস্ত্রির পবিত্র সেই ইচ্ছার কথা শুনে সে মনে মনে সেদিনই প্রতিজ্ঞা করল, এ স্বপ্ন যেকোনো উপায়ে পূরণ করতে হবে। বড় হয়ে একজন দক্ষ সিপাহসালার হতে হবে। তারপর পুনরুদ্ধার করতে হবে পবিত্র ঘর মসজিদুল আকসা।
হ্যাঁ, কাঠমিস্ত্রির মিম্বর দেখতে যাওয়া সেদিনের সেই ছােট্ট বালকটিই পরবর্তীকালে আল-কুদস পুনরুদ্ধার করেছিল খ্রিষ্টান ক্রুসেডারদের জবরদখল থেকে। কাঠমিস্ত্রির সেই স্বপ্নও সে পূরণ করেছিল। সৌন্দর্যমণ্ডিত মিম্বরটি এনে স্থাপন করেছিল আল-আকসার মেহরাবে। বালকটি আর কেউ নন, ইতিহাসের বিখ্যাত মুসলিম বীর সুলতান
সালাউদ্দিন আইয়ুবী। পশ্চিমাদের ভাষায় ‘গ্রেট সালাদিন’।
সালাউদ্দিন আইয়ুবী তখন আব্বাসী খেলাফত কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দামেস্কের সুলতান। নিজ কর্মদক্ষতা, বীরত্ব, বাহাদুরি আর একনিষ্ঠতা তাকে এত দূর নিয়ে এসেছে। খ্রিষ্টান ক্রুসেডারদের কাছে ছিলেন তিনি সাক্ষাৎ এক মৃত্যুদূত। ১১৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী দামেস্কের সিংহাসনে বসেন। সিংহাসনে বসার প্রায় এক যুগ কাল অবধি অভ্যন্তরীণ শক্তির উৎপাতের কারণে আল-কুদস পুনরুদ্ধারে খুব একটা মনােযােগী হতে পারেননি। এই সময়টাতে তিনি মুসলিম নামধারী আরামপ্রিয় গাদ্দার আমির-ওমরাদের কখনাে বুঝিয়ে কখনাে যুদ্ধের মাধ্যমে নিজের আনুগত্যে আনেন।
১১৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পূর্ণ মনােযােগ দেন পবিত্র ভূমি জেরুজালেম পুনরুদ্ধারে। ২০ সেপ্টেম্বর মােতাবেক ৫৮৩ হিজরির ১৫ রজব রবিবার নিজ নেতৃত্বে মুসলিম মুজাহিদদের বিশাল এক কাফেলা নিয়ে অবরােধ করেন আল-কুদস। আল-কুদস খ্রিষ্টানদেরও পবিত্র ভূমি। জীবন দিয়ে হলেও এ ভূমি তারা নিজেদের করায়ত্তে রাখতে চায়। শুরু হলাে রক্তক্ষয়ী লড়াই। মরণপণ লড়াই করছে উভয় পক্ষই। কিন্তু সালাউদ্দিন আইয়ুবীর জানবাজ মুজাহিদদের মােকাবিলায় খুব বেশি দিন ঠিকল না ক্রুসেডারদের এ বীরত্ব।
অবরােধের ১২তম দিন ২ অক্টোবর মােতাবেক ২৭ রজব শহরের সব প্রতিরােধব্যুহ ভেঙে পড়ল। মুসলিম যােদ্ধারা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে প্রবেশ করলেন পুণ্যভূমি জেরুজালেমে। প্রবেশ করলেন দীর্ঘ প্রায় ৯০ বছর পর। এ ৯০ বছর এখানে একটি বারের জন্যও আল্লাহু আকবারের ধ্বনি উচ্চারিত হতে দেয়নি খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা। মুসলিমরা ছিল এখানে চরম নিষ্পেষণের শিকার। যারাই ইসলামের নাম মুখে এনেছে, তারাই নিক্ষিপ্ত হয়েছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, শিকার হয়েছে সীমাহীন নির্যাতনের।
কিন্তু আজ, এই বিজয়ের দিন, আল-কুদসের সর্বময় ক্ষমতা পেয়ে মুসলিমরা কী করলেন? ৯০ বছর আগে যেভাবে খ্রিষ্টানরা গণহত্যা চালিয়েছিল নিরীহ মুসলমানদের ওপর, তার প্রতিশােধ নিলেন? খ্রিষ্টানদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে তাদের জবাই করলেন? না, এর কোনােটিই করেননি। কেবল যারা যুদ্ধাপরাধী, তাদের বিচার করলেন। যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল না, যারা নিরীহ খ্রিষ্টান, তাদের রাষ্ট্রীয় কর আদায়ের শর্তে নিরুপদ্রবে বেঁচে থাকার অধিকার দিলেন। তাদের গায়ে ফুলের আঁচড়টিও লাগতে দিলেন না।
এটাই মানবতা। এই মানবতাই শিক্ষা দেয় ইসলাম। সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর ঐতিহাসিক এ বিজয়ের পর ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ অবধি একাধারে এখানে শাসন করেছেন মুসলিমরা। ১৯১৭ সালের পর থেকেই এ অঞ্চলের মুসলমানদের ওপর আপতিত বর্তমান জিল্লতি আর জুলুমের সূচনা হয়।
এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলো পড়ুন:
মুসলমানদের জেরুজালেম বিজয়
বেলফোর ঘোষণা এবং এক নতুন ষড়যন্ত্র
ফিলিস্তিনের বুকে দখলদার ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা
This is a Bengali article. This is the second episode of ‘The History of Zionist Israel’.
Necessary references are hyperlinked inside the article.
Featured Image: Wikimedia Commons