আল-কুদস। ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি। মুসলমানদের প্রাণের শহর। প্রথম কেবলার শহর। ইহুদি আর খ্রিষ্টানদের ভালােবাসাও প্রােথিত আছে এই জেরুজালেম শহরে। তিন ধর্মের তীর্থ শহর এই আল-কুদস, জেরুজালেম। নবী দাউদ, নবী সুলায়মান—পিতা-পুত্র। দুই নবী শাসন করে গেছেন এ শহর। এ শহরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নবী ঈসা আলায়হিস সালামের কত স্মৃতি! আরও অনেক নবীর পুণ্যস্মৃতি!
নবী মুহাম্মদ (স)-এর মেরাজ এই ভূমি থেকেই শুরু হয়েছিল। মেরাজ রজনীর বাহন বােরাকের পদধূলি মিশে আছে এই শহরের বালুকণায় ।
ঈসায়ী ৬৩৭ সাল। জেরুজালেম তখন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শাসনে। বাইজেন্টাইন সরকারের প্রতিনিধি সােফ্রোনিয়াস এ শহরের শাসনকর্তা। সােফ্রোনিয়াস খ্রিষ্টানদের ধর্মযাজকও।
জেরুজালেমের বাসিন্দা খ্রিষ্টধর্মের বাইরে যারা, তারা তাে নির্যাতিত ছিলই, এমনকি খােদ খ্রিষ্টানরাও ছিল রাষ্ট্রীয় নিষ্পেষণের শিকার। ইসলামী খেলাফতের খলিফা তখন হজরত উমর ফারুক (রা:)। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। আমিরুল মুমিনিন। উমরের নির্দেশে মুসলিম সেনাপতিরা ইসলামের বিজয় নিশান উড়িয়ে চলেছেন পৃথিবীর দিকে দিকে। একের পর এক শহর পদানত হচ্ছে খেলাফতের অধীনে।
খালিদ ইবনে ওয়ালিদ। নবীজি যাঁর উপাধি দিয়েছেন সাইফুল্লাহ বা ‘আল্লাহর তলােয়ার’। ইসলামের অজেয় বীর। মুসলমানদের সাহসী সেনাপতি। তাঁর সঙ্গে আমর ইবনে আস। আরেক সিংহশার্দুল সাহাবি। সঙ্গে সাহাবাদের যােদ্ধাদল। ইসলামের বিজয় নিশান বাইজেন্টাইনদের বিভিন্ন শহরে বীরদর্পে উড়িয়ে সবাই এসে অবরােধ করেন জেরুজালেম। আল-কুদস।
জেরুজালেমের অধিপতি সােফ্রোনিয়াসের সাহস নেই অজেয় এই বাহিনীর মােকাবিলা করার। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অন্যান্য অনেক শহর পর্যদস্ত করে মুসলমানরা কীভাবে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন, সব খবর তার কাছে আছে। মােকাবিলা করে এ শক্তিকে দমানাে যাবে না। সােফ্রোনিয়াস সন্ধির প্রস্তাব পাঠালেন। আত্মসমর্পণ করবেন তিনি। তবে শর্ত আছে। কী শর্ত?
মুসলমানদের খলিফাকে আসতে হবে জেরুজালেমে। তার কাছেই তিনি আত্মসমর্পণ করবেন। আর কারও কাছে নয়। কিন্তু খলিফা তাে এখানে নেই। দূর মদিনায় তিনি। খেলাফতের মূল
ঠিকানায়। না, তাঁকেই আসতে হবে। আত্মসমর্পণ তার কাছে হবে। দূত পাঠানাে হলাে মদিনায়। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ ও আমর ইবনে আস দূত মারফত জানতে চাইলেন—আমিরুল মুমিনিন কি আসবেন, না অন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে? আমিরুল মুমিনিন আসবেন। তিনি বেরিয়ে পড়েছেন। একটি উটে সওয়ার হয়ে। সঙ্গে এক ভৃত্য। বেশভূষা নিতান্ত সাদামাটা এক মুসাফিরের। দেখে কারও বােঝার উপায় নেই, এই সাদামাটা মুসাফিরের অঙ্গুলিহেলনেই পরিচালিত হয় অর্ধজাহান!
তিনি এলেন জেরুজালেমে। সােফ্রোনিয়াস দেখে তাে হতবাক। এ কেমন রাজা? কোনাে শান-শওকত নেই। নেই প্রাচুর্যের জৌলুশ। দেখতে ফকিরের মতাে। এই লােকের হুকুমেই তবে অর্ধজাহান পরিচালিত হয়। সােফ্রোনিয়াস খলিফা উমরকে স্বাগত জানালেন পবিত্র ভূমি আল-কুদসে। মুসলিম সেনাবাহিনী নিয়ে উমর প্রবেশ করলেন জেরুজালেম শহরে। সােফ্রোনিয়াস আত্মসমর্পণ করলেন আমিরুল মুমিনিনের কাছে। সন্ধির চুক্তিপত্র তুলে দিলেন তার হাতে। আমিরুল মুমিনিনকে ঘুরে ঘুরে দেখালেন পুরাে শহর। দেখালেন জেরুজালেমে খ্রিষ্টানদের প্রধান গির্জা।
উমর যখন গির্জা পরিদর্শন করছিলেন, তখন নামাজের সময়।
আরো পড়ুনঃ
১)ইহুদীবাদী ইসরায়েলের ইতিহাস (২য় পর্ব): ক্রুসেডারদের নৃশংসতা এবং সালাউদ্দিন আইয়ুবীর মহাবিজয়
২)
সােফ্রোনিয়াস আমিরুল মুমিনিনকে গির্জার ভেতরেই নামাজ আদায়ের আমন্ত্রণ জানালেন। দূরদর্শী আমিরুল মুমিনিন সােফ্রোনিয়াসকে তাঁর উদারতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, আমি যদি আজ এখানে নামাজ আদায় করি, তবে ভবিষ্যতে আমার নামাজের অজুহাত দেখিয়ে
এই গির্জাকে মসজিদ বানানাের সম্ভাবনা রয়েছে। এটা ভিন্নধর্মী জনগােষ্ঠীর অধিকার লঙ্ঘনের শামিল। ইসলাম এই অধিকার লঙ্ঘনকে। সমর্থন করে না। নামাজ আমি বাইরেই আদায় করব। উমর গির্জা থেকে বাইরে বেরিয়ে নামাজ আদায় করলেন।
মুসলমানদের খলিফার এমন দূরদর্শী চিন্তাধারা আর ভিন্ন ধর্মের মানুষের অধিকারের প্রতি সচেতনতা দেখে সােফ্রোনিয়াস অভিভূত হয়ে গেলেন। মুসলমানরা মানবাধিকারের প্রতি এমন সচেতন বলেই অর্ধজাহান তাঁদের পদানত করতে পেরেছিল। তাদের দিগ্বিজয়ের মূল চালিকাশক্তি কোথায়, সােফ্রোনিয়াস কিছুটা হলেও সেদিন আন্দাজ করতে পেরেছিলেন।
খলিফা উমর সেদিন গির্জা থেকে বেরিয়ে যে স্থানে নামাজ আদায় করেছিলেন, জায়গাটি কিছুদিনের ভেতর সত্যি সত্যি মসজিদে রূপান্তরিত হয়েছিল। মসজিদটির নাম মসজিদে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু। আল-কুদসের বুকে সেটা আজও মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। মুসলমানদের দ্বিতীয় খলিফার দূরদর্শিতার নীরব সাক্ষী হয়ে। উমরের কাছে সেদিন সােফ্রোনিয়াসের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন সর্বপ্রথম মুসলমানদের করতলগত হয়। তখন থেকেই ফিলিস্তিনের আকাশে পতপত করে উড়তে থাকে ইসলামের পতাকা। হেলালি নিশান।
মসজিদুল আকসা। মেরাজ রজনীতে মক্কা থেকে বােরাকে চড়ে নবীজি (স) এখানেই এসেছিলেন প্রথমে। এখানে পূর্ববর্তী নবীদের নিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে রওনা হয়েছিলেন আকাশপানে। অসংখ্য নবী-রাসুলের পদধূলির সঙ্গে আমাদের প্রিয় নবীর পদধূলিও মিশে আছে আকসার আঙিনায়। মিশে আছে মেরাজ রজনীর পবিত্র স্মৃতি। ১৪ লাখ ৪০ হাজার বর্গমিটারজুড়ে মসজিদুল আকসার চৌহদ্দি। চৌহদ্দির ভেতরের পুরাে অংশটাই হারাম শরিফ। পবিত্র ভূমি।
মসজিদুল আকসা কমপ্লেক্সটি চতুর্দিক থেকে দেয়ালবেষ্টিত। এর ভেতরে অনেক স্থাপনা আছে। আছে স্বতন্ত্র দুটি গম্বুজওয়ালা মসজিদ। একটির গম্বুজ সােনালি আরেকটির কালাে। ছবিতে সােনালি গম্বুজের মসজিদটি দেখে আমরা মনে করি ওটাই বােধ হয় মসজিদুল আকসা। আবার কেউ কেউ ভাবি, কালাে গম্বুজওয়ালাটির কথা—ওটাই মসজিদুল আকসা।
আসলে দুটিই আকসার আলাদা আলাদা অংশ। সােনালি গম্বুজওয়ালাটির নাম কুব্বাতুস সাখরা বা ডোম অব দ্য রক। আর কালো গম্বুজওয়ালাটি আল-জামিউল কিবালি। তবে আল-জামিউল কিবালির আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। এটা নির্মাণ
করেছিলেন হজরত উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু। আকসা কমপ্লেক্সের মূল মসজিদ হিসেবে এটাকেই গণ্য করা হয়।
৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ। মুসলিমরা ফিলিস্তিন জয় করেছেন। আমিরুল মুমিনিন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এসেছেন জেরুজালেমে। পবিত্র নগরী তিনি ঘুরে ঘুরে দেখছেন। দেখে দেখে চোখ জুড়াচ্ছেন নবী-রাসুলদের স্মৃতিধন্য শহর। মসজিদুল আকসায় এসে তিনি থামলেন। বিশাল আঙিনা। আহা,
এই আঙিনায়ই তাে কত নবী-রাসুলের পদচিহ্ন মিশে আছে। মিশে আছে নবী মুহাম্মদের মেরাজ রজনীর স্মৃতি। এই তাে হায়েতুল বােরাক! এই দেয়ালেই তাে নবীজি তার মেরাজ রজনীর সওয়ারি বােরাক বেঁধে রেখেছিলেন।
সাখরা পাথরটা কোথায়? যে পাথরটার দিকে মুখ করে সাহাবিদের নিয়ে নবীজি ১৬ মাস নামাজ আদায় করেছিলেন। পাথরটা পাওয়া গেল ময়লা-আবর্জনার স্তুপের নিচে। খ্রিষ্টানরা এখানে এত দিন ময়লা ফেলেছে। ইহুদিদের প্রতি হিংসাপরাছু হয়ে
তারা এ কাজটা করেছে। ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টানদের দুই চোখের দুশমন ছিল ইহুদিরা। কলহপ্রিয় এই ইহুদিরা কোনাে কালেই ভালাে ছিল না। কেউ তাদের দেখতে পারত না।
মারও খেয়েছে ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে। ‘সাখরা’ অর্থ পাথরখণ্ড। পাথরখণ্ডটি ছিল ইহুদিদের সম্মানের জিনিস। এটাকে মূল বিন্দু ধরেই মূলত কিবলা নির্ধারিত হতাে। ইহুদিরা এখনাে এটাকে কিবলা মানে। এদিকে ফিরে তাদের সব উপাসনা-আরাধনা অনুষ্ঠিত হয়। খ্রিষ্টানরা এ জন্যই এটাকে ময়লা-আবর্জনা দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। উদ্দেশ্য—ইহুদিদের অপমান করা।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সাখরা পাথরটার ওপর থেকে ময়লা-আবর্জনা সরানাের নির্দেশ দিলেন। নিজেও লেগে গেলেন পবিত্র পাথরটা পরিষ্কার করার কাজে। আকসা কমপ্লেক্সের ভেতর একটা মসজিদ নির্মাণের কথা ভাবলেন খলিফা। কোথায় কীভাবে করা যায়—সঙ্গীদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। সঙ্গীদের একজন ছিলেন কাবে আহবার। তিনি নও-মুসলিম। ইসলাম গ্রহণের আগে ইহুদিদের বড় পণ্ডিত ছিলেন। আহবার পরামর্শ দিলেন মসজিদটি সাখরা পাথরের উত্তর পাশে। নির্মাণ করার জন্য। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু মুচকি হাসলেন তাঁর পরামর্শ শুনে। বললেন, ‘আহবার, তােমার মধ্যে ইহুদিবাদের গন্ধ রয়ে গেছে। পূর্বের ধর্মের রীতি-নীতির প্রতি এখনাে তুমি দুর্বল।
জেরুজালেম থেকে কাবা শরিফ দক্ষিণ দিকে। সেখানকার কিবলাও তাই দক্ষিণ।
আহবারের কথামতাে যদি সাখরার উত্তর পাশে মসজিদ। নির্মাণ করা হয়, তাহলে নামাজের সময় সাখরাও কিবলা হয়ে যায়। কাব এ পরামর্শ দিয়ে চেয়েছিলেন তার পূর্বের ধর্মের কিবলাটাও অন্তত এ মসজিদের ক্ষেত্রে ঠিক থাকুক। কিন্তু বিচক্ষণ উমর কাবের সূক্ষ্ম এ চালটা ধরে ফেলেন। কাব লজ্জিত হন। নও-মুসলিম হওয়ার কারণে পূর্বের ধর্মের প্রতি কিছুটা ভালােবাসা রয়ে গিয়েছিল তার মনে। উমরের কথা শুনে তিনি সে ভালােবাসা ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে নেন। উমর নির্দেশ দিলেন সাখরার সামনে, অর্থাৎ দক্ষিণ পাশটায় মসজিদ নির্মাণ করতে। তাহলে নামাজের সময় সাখরাটা আর মুসল্লিদের সামনে পড়বে না। পেছনে থাকবে।
উমরের নির্দেশে দ্রুত মসজিদ নির্মিত হলাে। তিনি তা উদ্বোধন করলেন। এটাই আজকের কালাে গম্বুজওয়ালা মসজিদ আল-জামিউল কিবালি। মসজিদুল আকসার নামাজ তারপর থেকে এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। কুব্বাতুস সাখরা মসজিদটি নির্মিত হয় আরও অনেক পরে। এর অবস্থান মূল সাখরা পাথরটি যেখানে আছে, সেখানে। বহুকাল এখানে কোনাে স্থাপনা ছিল না। পঞ্চম উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের শাসনামলে সাখরাকে কেন্দ্র করে মসজিদটি নির্মিত হয়।
আল-আকসা কমপ্লেক্সের এ জায়গাটি ইহুদিদের কাছে খুব সম্মানিত। কারণ, তাদের কিবলা সাখরা পাথরটা এ মসজিদের ভেতরেই আছে। মুসলমানদের কাছেও তা গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। কারণ, ঐতিহাসিকদের মতে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম মেরাজ রজনীতে এখান থেকেই ঊর্ধ্বাকাশে রওনা হয়েছিলেন। ক্রুসেড যুদ্ধের আগ পর্যন্ত জেরুজালেম মুসলিম শাসনের অধীনেই ছিল।
এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলো পড়ুন:
২. ক্রুসেডারদের নৃশংসতা এবং সালাউদ্দিন আইয়ুবীর মহাবিজয়
৩. বেলফোর ঘোষণা এবং এক নতুন ষড়যন্ত্র
৪. ফিলিস্তিনের বুকে দখলদার ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা
This is a Bengali article. This is the first episode of ‘The History of Zionist Israel’.
Necessary references are hyperlinked inside the article.
Featured Image: Getty Image