ফিলিস্তিনি আরব মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানাের কারণে ইহুদিরা যখন বিশ্ব বিবেকের কাছে সমালােচিত হচ্ছিল, তখন জনমত নিজেদের পক্ষে আনার জন্য তারা বেছে নেয় এক ভয়ংকর পন্থা। ইহুদিদের সবচেয়ে শক্তিশালী আর ভয়ংকর গােপন সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম ‘হাগানাহ’।
১৯৪০ সালে ২৭৬ জন ইহুদিকে বহন করে নিয়ে আসা একটি জাহাজ হাইফা নৌবন্দরে নােঙর ফেলে। তারা এসেছে ফিলিস্তিনে বসবাসের জন্য। হাগানাহ স্বজাতির নিরীহ এসব মানুষের ওপর গুপ্ত আক্রমণ চালায়। বােমা হামলা করে যাত্রীসহ পুরাে
জাহাজটাকেই উড়িয়ে দেয় তারা। তারপর প্রচার করে, ফিলিস্তিনি মুসলিমরা নিরীহ ইহুদিদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। বিশ্ব জনমতকে নিজেদের পক্ষে আনার এ ছিল এক ঘৃণ্য অপকৌশল।
তার দুই বছর পর আবার একই কাহিনির পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছিল এই হাগানাহ। সেই হত্যাকাণ্ড ছিল আরও বীভৎস। তখন জাহাজে যাত্রী ছিল ৭৬৯ জন। বিশ্ব মিডিয়ায় এই হত্যাকাণ্ডের দায়ও স্থানীয় ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর চাপায় তারা। এভাবে দমন-পীড়ন, হত্যা আর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ইহুদিরা তাদের স্বাধীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কণ্টকাকীর্ণ পথ পরিষ্কার করতে থাকে। বহিরাগত ইহুদির আগমনে ভারী হতে থাকে ফিলিস্তিনের পুণ্যভূমি।
১৯৪৭ সালে এসে দেখা গেল ইহুদিদের সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ইহুদিরা এবার চূড়ান্ত ফয়সালার দিকে এগােয়। ফিলিস্তিনে তাদের একটি রাষ্ট্র চায়। ইহুদি রাষ্ট্র-ইসরায়েল। ৬ লাখ ইহুদির নিরাপত্তার জন্য এই রাষ্ট্র না হলেই নয়! জাতিসংঘ তাে আগে থেকে প্রস্তুত হয়েই ছিল। ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল সাধারণ অধিবেশন বসে জাতিসংঘ। অধিবেশনে ফিলিস্তিন নিয়ে আলােচনা হয়। ফিলিস্তিনের চলমান সংকট নিয়ে তদন্তের জন্য গঠন করা হয় ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি।
কমিটির সদস্য ছিল অস্ট্রেলিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, কানাডা, যুগােস্লাভিয়া, গুয়াতেমালা, ভারত, নেদারল্যান্ডস, ইরান, পেরু, উরুগুয়ে ও সুইডেন। নির্ধারিত সময়ে কমিটি রিপাের্ট পেশ করে। রিপাের্টে কমিটির সদস্যরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ভারত, ইরান আর যুগােস্লাভিয়া ফিলিস্তিনে সবার সমন্বয়ে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে সুপারিশ করে। আর বাকি সদস্যরা মতামত ব্যক্ত করে সেখানে ইহুদিদের অভয়ারণ্য নির্মাণের জন্য ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে।
সাধারণ পরিষদ উভয় পক্ষের প্রস্তাব মূল্যায়নের জন্য অ্যাডহক কমিটির কাছে তা প্রেরণ করে। উরুগুয়ে আর গুয়াতেমালা দেশ দুটো সেখানেও ইহুদিদের পক্ষে জোর ওকালতি করে। পাকিস্তানসহ আরও কয়েকটি রাষ্ট্র তাদের বিরােধিতা করে। কিন্তু তাদের এ বিরােধিতা ষড়যন্ত্রকারীদের ধােপে টেকে না। নানা তর্ক-বিতর্কের পর অবশেষে ভােট গ্রহণ করা হয়।
ফিলিস্তিন বিভক্তির পক্ষেই রায় আসে। ইহুদিরা জিতে যায়। জিতে যায় তাদের শত বছরের ষড়যন্ত্র আর কূটকৌশল। (নাকি জিতিয়ে নেয়?) বিভক্তির পক্ষে রায় আসার মূল কারণ আমেরিকা আর রাশিয়া। দুই পরাশক্তিই ইহুদিদের সমর্থন করে।
অ্যাডহক কমিটিতে ফিলিস্তিন বিভক্তির রায় পাস হয়ে ফিরে আসে সাধারণ পরিষদে।
সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন পেলে। তবেই রায়টি কার্যকর করা যাবে। ১৯৪৭ সালের ২৬ নভেম্বর সাধারণ পরিষদের অধিবেশন। রায়টি এই অধিবেশনেই উপস্থাপন করা হবে। কিন্তু ২৬ তারিখ পর্যন্ত পরিস্থিতি ইহুদিদের অনুকূলে ছিল না।
তারা আঁচ করতে পারে এই তারিখে ফিলিস্তিন বিষয়ক রায়টি পুনর্বিবেচনার জন্য উত্থাপিত হলে অধিকাংশ রাষ্ট্রই তাদের বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করবে। নানা টালবাহানা করে তাই এই দিন রায়টি উত্থাপন করাটা তারা বানচাল করে দেয়। তারপর পশ্চিমা শক্তিগুলাে ছােট ছােট সদস্যরাষ্ট্রের ওপর চাপ প্রয়ােগ শুরু করে। চলে নানা হুমকি-ধমকি, যাতে তারা ফিলিস্তিন বিভক্তির পক্ষে ভােট দেয়।
আরো পড়ুন:
ইসরায়েলি ষড়যন্ত্রের হাজার বছরের ইতিহাস
রায় উত্থাপিত হয় ২৯ নভেম্বর। তত দিনে পরিস্থিতি ইহুদিদের পক্ষে চলে আসে। ভােট অনুষ্ঠিত হয়। আগের সিদ্ধান্তের ওপরই রায় আসে। ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করা হবে। পবিত্র ভূমির বুকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে ইহুদিদের অভয়ারণ্য। ইসরায়েল।
ফিলিস্তিনকে ভাগ করে দেওয়া হয় বহিরাগত ইহুদি আর যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসা স্থানীয় আরব মুসলিমদের মধ্যে। সংখ্যালঘু ইহুদিরা পেল ফিলিস্তিনের ৫৭ ভাগ ভূমি আর স্থানীয় অধিবাসী, যারা ছিল মােট জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ, তাদের ভাগে পড়ল মাত্র ৪৩ ভাগ ভূমি। পৃথিবীর ইতিহাসে বোধ হয় এর চেয়ে বড় অযৌক্তিক ও অন্যায্য বিচার আর কখনো হয়নি।
ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে আরবের বুকে, সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। কিন্তু ফিলিস্তিন? ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কীভাবে হবে, কী হবে এর অবকাঠামাে, তা অমীমাংসিতই থেকে যায়। জাতিসংঘ থেকে ইহুদিরা তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাস করানাের পর ফিলিস্তিনিদের ওপর শুরু করে নতুন রূপে নির্যাতন। তাদের জঙ্গি
গ্রুপগুলাে হয়ে ওঠে আরও বেপরােয়া। ঘরবাড়ি লুণ্ঠন, উচ্ছেদ আর একটু প্রতিবাদ করলেই গুলি করে হত্যা—ফিলিস্তিনিদের ওপর যেন কিয়ামতের বিভীষিকা নেমে আসে!
মাত্র ১০০ দিনে ১৭ হাজার ফিলিস্তিনি মুসলিম ইহুদিদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে শাহাদাতবরণ করেন। ভয়ানক এই পরিস্থিতির কারণে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আবারও আলােচনায় ওঠে ফিলিস্তিন নিয়ে।
১৯৪৮ সালের ২০ এপ্রিল। অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মার্কিন প্রতিনিধি ফিলিস্তিন বিভক্তির ব্যাপারটা স্থগিত রেখে পুরাে ফিলিস্তিনকে সরাসরি জাতিসংঘ কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ করার প্রস্তাব পেশ করেন। এ প্রস্তাবকে সামনে রেখে আলােচনার
নামে শুরু হয় নতুন প্রহসন। এদিকে একই বছর ১৪ মে ফিলিস্তিন থেকে ব্রিটিশরা চলে আসার কথা। ১৪ মের আগে আগেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছা জরুরি। ইহুদি নেতা ওয়াইজম্যান এক নতুন চাল চাললেন তখন।
তিনি গােপনে সাক্ষাৎ করলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিস্টার হ্যারি টুম্যানের সঙ্গে। ব্যস, কেল্লা ফতে করে এলেন তিনি। ১৪ মে স্থানীয় সময় রাত ১২টা। ফিলিস্তিনে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণের মেয়াদ শেষ। ওয়াশিংটনে তখন ভাের ছয়টা। মিনিটের কাঁটা পেরােতে না পেরােতেই ইহুদি নেতা বেন-গুরিয়ান তেল আবিব থেকে ফিলিস্তিনের বুকে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্রের ঘােষণা দিলেন। রাষ্ট্রের নাম ‘ইসরায়েল’।
এর ঠিক ১০ মিনিটের মাথায় ওয়াশিংটন থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। তারপর ব্রিটেন থেকেও শােনা গেল স্বীকৃতির আওয়াজ। সােভিয়েত ইউনিয়নও সুর মেলাল এরপর। তিন সুপার পাওয়ারের স্বীকৃতি প্রায় একসঙ্গেই পেয়ে গেল ইহুদিরা। আর কী লাগে!
আরব রাষ্ট্রগুলাে বিশ্বমােড়লদের এ হঠকারিতা মেনে নিতে পারেনি। ফিলিস্তিনি মুসলিমদের মেনে নেওয়ার তাে প্রশ্নই আসে না। শুরু হয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। যুদ্ধ যে অনিবার্য, ইহুদিরা আগে থেকেই জানত। তারা আটঘাট বেঁধেই ছিল।
কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলাের ভেতর ছিল প্রচণ্ড অনৈক্য আর বিশৃঙ্খলা, অন্যদিকে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র। ইহুদিরা আগ থেকেই এসব রাষ্ট্রে ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে রেখেছিল। যাতে তারা রাষ্ট্র ঘােষণা দেওয়ার পর আরবরা যুদ্ধ করতে এসে এই জালে আটকা পড়ে হাঁসফাস করে।
ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হলাে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আর ইসরায়েলি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করা সম্ভব হলাে না আরবদের পক্ষে। ইসরায়েল এই ফাঁকে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করে নিল অসহায় ফিলিস্তিনিদের ওপর। নির্যাতন-নিষ্পেষণ তাে আছেই। ফিলিস্তিনিরাও থেমে নেই। নিজেদের যা আছে, যতটুকু আছে, তা দিয়েই প্রতিরােধ করতে লাগল ইহুদিদের।
এল ১৯৬৭ সাল। আবারও বাধল আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। আরবরা এবার দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েই নেমেছিল। কিন্তু ইসরায়েলিদের গােপন ষড়যন্ত্র রুখবে কে? এরা আগে থেকেই আরব রাষ্ট্রগুলােতে অনৈক্য আর বিভেদ ছড়িয়ে রেখেছিল। তার ওপর আছে তাদের শক্তিশালী গােয়েন্দা তৎপরতা। আরবদের পূর্বপরিকল্পনা গােয়েন্দা মারফত মুহূর্তেই পৌঁছে যেত তেল আবিবে। ছয় দিনের যুদ্ধে আরবরা আবারও পরাজিত হলাে। হারাতে হলাে আরও নতুন কিছু ভূখণ্ড।
মিসরের অধীনে থাকা সিনাই উপত্যকা, সিরিয়ার অধীনে থাকা গােলান মালভূমি এবং জর্ডানের অধীনে থাকা পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম ইসরায়েলিরা দখল করে নেয়। আর এর মধ্য দিয়েই মুসলমানদের ভালােবাসার শহর পবিত্র আল-কুদসে ইহুদিদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফিলিস্তিনি মুসলমানরা হয় চূড়ান্ত বঞ্চনার শিকার। সেই বঞ্চনা আর না পাওয়ার হাহাকারে আজও ভারী হয়ে আছে ফিলিস্তিনের আকাশ।
এর ভেতরে পৃথিবীর রূপ-বৈচিত্র্যে কত পরিবর্তন এসেছে, জর্ডান নদীতে কলকল রব তুলে গড়িয়েছে কত জল, কিন্তু হতভাগ্য আল-কুদস আর ফিলিস্তিনের মানুষের ভাগ্যে কোনাে পরিবর্তন আসেনি। জুলুম, নির্যাতন আর পরাধীনতার গ্লানিতে আজও তারা ক্লান্ত-শ্রান্ত। তাই বলে যে তারা থেমে আছে, এমন নয়। তাদের সংগ্রাম আর প্রতিরােধ চলমান। বঞ্চনার আগুনে পুড়তে পুড়তে তাদের কেউ কেউ হঠাৎ জ্বলে ওঠে। আর পৃথিবী অবাক হয়ে দেখে প্রতিবাদের অভিনব ভাষা এবং স্বরূপের আগুন-মূর্তি।
এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলো পড়ুন:
২. ক্রুসেডারদের নৃশংসতা এবং সালাউদ্দিন আইয়ুবীর মহাবিজয়
৩. বেলফোর ঘোষণা এবং এক নতুন ষড়যন্ত্র
This is a Bengali article. This is the second episode of ‘The History of Zionist Israel’.
Necessary references are hyperlinked inside the article.
Featured Image: Random Image