মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় একটি ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্মের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য সংকটের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ইসরাইলী রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বেলেফোর ঘােষণা। ১৯৭১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. জে. বেলেফো ব্রিটিশ জায়নিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি লর্ড রথসচাইল্ডকে একটি চিঠি দেন।
ওই চিঠির উদ্দেশ্য হচ্ছে ইহুদিদের জন্য একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা। ইতিহাসে এটাই বেলেফোর ঘােষণা নামে পরিচিত। ১৯২২ সালে লীগ অব নেশনস-এর সভায় ব্রিটেনকে ফিলিস্তিনের উপর ম্যান্ডেট প্রদান করা হয়।
বেলেফোর ঘােষণার পর পরই ইউরােপ-আমেরিকা থেকে ইহুদিরা ব্যাপক হারে প্যালেস্টাইনে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। আর এর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা বারে বারে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। তারা দাবি করেছিলেন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অবসানের। তারা চেয়েছিলেন একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র। কিন্তু বৃহৎ শক্তিগুলাে বারে বারে তাদের সে দাবি প্রত্যাখ্যান করে।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ কর্তক ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত আরব এলাকা বিভক্তির মধ্য দিয়ে যে বৈরিতার জন্ম হয়েছিল, দীর্ঘ ৭৩ বছর পরও সে বৈরিতার পুরােপুরি অবসান হয়নি।
পশ্চিমা শক্তিগুলাে সেদিন জাতিসংঘকে ব্যবহার করে ফিলিস্তিনি এলাকায় গঠন করেছিল ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিসর, জর্ডান, লেবানন ও ইরানের সাথে ইসরাইল যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। সেটা ছিল আরব রাষ্ট্রগুলাের সাথে ইসরাইলের প্রথম যুদ্ধ। পরবর্তীকালে আরব রাষ্ট্রগুলাে আরাে দুবার ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
ওই যুদ্ধের ফলে এক বিরাট আরব এলাকা ইসরাইলীরা দখল করে নেয় এবং ধীরে ধীরে অধিকৃত আরব এলাকায় গড়ে তােলে ইহুদি দখলদার সাম্রাজ্য।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল দখল করে নিয়েছিল মিসরের সিনাই আর সিরিয়ার গােলান উপত্যকা। পরবর্তীকালে ক্যাম্প ডেভিড (১৯৭৮) চুক্তির বিনিময়ে মিসর সিনাই এলাকা ফিরে পেলেও সিরিয়া তার গােলান উপত্যকা ফিরে পায়নি। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল ফিলিস্তিনি এলাকা গাজা ও পশ্চিম তীর দখল করে নিয়েছিল। একই সাথে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে গিয়েছিল পূর্ব জেরুজালেম ও সেখানে অবস্থিত মুসলমানদের পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদ। ইসরাইল এখন এই এলাকা দাবি করছে তাদের পবিত্র স্থান জুদিয়া ও সামারিয়ার কথা বলে।
ইহুদিদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলােতে জুদিয়া ও সামারিয়ার কথা বলা আছে। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক শান্তি আলােচনার জন্ম ১৯৭৩ সালে জেনেভায়। এই আলােচনার সূত্র ধরেই ক্যাম্প ডেভিডে ১৯৭৮ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেগিন একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, যার বিনিময়ে মিসর ফিরে পেয়েছিল সিনাই এলাকা। মিসর তার হারানাে জমি ফিরে পেয়েছিল সত্য, কিন্তু দীর্ঘদিন তাকে আরব বিশ্বে একলা চলতে হয়েছিল। এমনকি সাদাতকে তাঁর জীবন দিয়েই এর মূল্য পরিশােধ করতে
হয়েছিল।
১ নভেম্বর, ১৯৯২ সালে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ও সাবেক সােভিয়েত নেতা গরবাচেভের উপস্থিতিতে যে শান্তি আলােচনা শুরু হয়েছিল, তা ছিল মূলত মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক শান্তি আলােচনারই ধারাবাহিকতা।
ইসরাইলের ব্যাপারে আরব রাষ্ট্রগুলাে বিভিন্ন সময়ে কিছু কিছু নমনীয় মনােভাব গ্রহণ করলেও ইসরাইল কখনাে তার একগুঁয়ে মনােভাব পরিত্যাগ করেনি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ ও ৩০৮ নং প্রস্তাব অনুযায়ী ইসরাইলের অধিকৃত আরব এলাকা ফিরিয়ে দেবার কথা। কিন্তু ইসরাইল নিরাপত্তা পরিষদের সেই সিদ্ধান্ত কখনাে কার্যকর করেনি।
অথচ ১৯৯১ সালে ইরাকের ব্যাপারে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে সেখানে সেনাবাহিনী পাঠানাে হয়েছিল ও ইরাককে বাধ্য করা হয়েছিল সেই সিদ্ধান্ত মানতে। আর এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিল আমেরিকান প্রশাসন।
একই সাথে ইহুদিবাদকে ‘বর্ণবাদ’ বলে যে সিদ্ধান্ত প্রায় ত্রিশ বছর আগে জাতিসংঘে গৃহীত হয়েছিল ১৯৯২ সালে সেই প্রস্তাব বাতিল ঘোষণা করে আমেরিকা প্রশাসন জাতিসংঘে নতুন প্রস্তাব এনেছিল এবং জাতিসংঘে তা গৃহীতও হয়েছিল। অথচ মার্কিন প্রশাসন কখনাে ইসরাইলকে বাধ্য করেনি কিংবা জাতিসংঘ ইসরাইলকে বাধ্য করার কোনাে উদ্যোগ নেয়নি আর এলাকা ফিরিয়ে দিতে।
ইসরাইলের ভূমিকার কারণে ফিলিস্তিনিদের মাঝে ইসারাইল বিরােধী জনমত দিনে দিনে বাড়ছিল। ১৯৮৭ সালে ফিলিস্তিনিরা অধিকৃত গাজা ও পশ্চিম তীরে ইন্তিফাদা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৮ সালে আলজিয়ার্স সম্মেলনে ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্বকারী পিএলও ইসরাইল অধিকৃত গাজা ও পশ্চিম তীরে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষণা করেছিল।
ইয়াসির আরাফাত
ফিলিস্তিনি আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত। ২০০৪ সালের নভেম্বর মাসে তিনি প্যারিসে মারা যান। কিন্তু আরাফাত দীর্ঘদিনের শত্রু ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে কিংবা স্বায়ত্তশাসিত ফিলিস্তিনি এলাকা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের ইতিহাসে কিভাবে চিহ্নিত হবেন? একজন বিশ্বাসঘাতক’ নাকি একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক?
আরাফাত নােবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছিলেন ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাবিন ও পেরেসের সাথে। ফিলিস্তিন সম্প্রদায়ের ভেতরে ও বাইরে আরাফাত ছিলেন অন্যতম আলােচিত ব্যক্তিত্ব। পশ্চিমাবিশ্বে আরাফাতের এই ভূমিকা প্রশংসা কুড়ালেও স্বীকৃতি দিয়ে আরাফাত যে ঝুঁকিপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
প্রথমদিকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি ও ইসরাইলের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সিদ্ধান্ত পিএলও’র মাঝে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু আরাফাতের দৃঢ়চেতা মনােভাবের কারণে পিএলও’র নির্বাহী কমিটি শেষপর্যন্ত ওই সিদ্ধান্ত মেনে নেয় এবং আরাফাতের অবস্থানকে সমর্থন করে। এটা আরাফাতের জন্য ছিল একটা বড় ধরনের বিজয় । তাঁর ওই ভূমিকাকে সমর্থন করেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। তিনি সমর্থন পেয়েছিলেন ইউরােপীয় রাষ্ট্রগুলাের কাছ থেকেও।
মডারেট আরব রাষ্ট্রগুলােও তাকে সমর্থন করেছিল। তার সিদ্ধান্তকে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সবাই। কিন্তু আরাফাত, যার পিতৃপ্রদত্ত নাম’ আবু আমার, তার একটা বড় দুর্বলতা ছিল পুরাে ফিলিস্তিনি আন্দোলনের কাছ থেকে নিরঙ্কুশ সমর্থন না পাওয়া। তাঁর নিজের দল ফাতাহ’ ভেঙে যায়। ফাতাহ’র একটা অংশ, যার নেতৃত্বে রয়েছেন আবু মউসা, তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি ফিলিস্তিনিদের বিকিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযােগ করেছেন।
অন্যদিকে সিরিয়া সমর্থনপুষ্ট আহমেদ জিবরিলের নেতৃত্বাধীন ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দি লিবারেশন অফ ফিলিস্তিনি জেনারেল কমান্ড’ ইসরাইলের সাথে যে কোনাে ঐক্যের বিরােধিতা করছে। তারা ১০ সেপ্টেম্বরকে (যেদিন ইসরাইল ও পিএলও পরস্পর পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়) ফিলিস্তিনিদের ইতিহাসে একটি ‘কৃষ্ণ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ডেমােক্র্যাটিক ফ্রন্ট ফর দি লিবারেশন অফ ফিলিস্তিনি’ -এর নেতা তেসির খালেদ এবং পপুলার ফ্রন্ট ফর দি লিবারেশন অফ ফিলিস্তিনি’-এর নেতা আবদুল রাজিস মালেডি পিএলও’র নির্বাহী কমিটি থেকে ইসরাইলকে স্বীকৃতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন।
মার্কসিস্ট নেতা প্রয়াত জর্জ হাবাসও ওই চুক্তির বিরােধিতা করেছিলেন। কিন্তু এ ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়া আরাফাতের কাছে আর কী বিকল্প কিছু ছিল? আরাফাত কী পারতেন ইসরাইলের সাথে কোনাে সহাবস্থান ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে চিরস্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করতে? গত ৭৩ বছরের ইতিহাস বলে পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাবে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বৈরিতা বেড়েছে, কমেনি।
বর্তমানে ফিলিস্তিনের অবস্থা করুণ। তার স্বজাতি আরবারাই ইসরায়েলের সাথে বন্ধুত্ব করছে। ইতিহাসে স্বজাতির সাথে এর চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা আর কি হতে পারে!
গতবছর ১৪ই আগস্ট ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিয়ে চুক্তি করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিছুদিনের মধ্যেই আমিরাতের দেখানো পথে পা বাড়ালো বাহরাইন ও সুদান। তারপর ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা দিল মরক্কো। সৌদির সাথেও ইসরায়েলের গোপন আতাঁত আছে বলে খবর রটেছে।
সব মিলিয়ে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে একটা শক্ত অবস্থানে আছে। একটা যাযাবর জাতি শুধুমাত্র কূটকৌশল আর ষড়যন্ত্রের জাল বুনে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসল। তুরস্ক, মিশর, মরক্কো, আমিরাত, বাহরাইন, সুদান, সৌদি আরবসহ মুসলিম পরাশক্তিগুলো বর্তমানে ইসরায়েলের মিত্র। নিরীহ ফিলিস্তিনিদের কথা ভাববার তাদের সময় কোথায়!
কিন্তু তা বলে ফিলিস্তিনিরা থেমে নেই। যা আছে তা নিয়েই দশকের পর দশক ধরে শত্রুর মোকাবেলা করে যাচ্ছে। যুবক, বৃদ্ধা, নারী, শিশু অবলীলায় বিলিয়ে দিচ্ছে প্রাণ। একখণ্ড স্বাধীন ভূখণ্ডের আশায়। হয়ত সেটা আর কখনও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। ক্ষমতার আর স্বার্থের কাছে বিক্রি হওয়া স্বজাতির দেশগুলোর প্রতি কতটা অভিমান জমা হয়ে আছে তাদের? স্রস্টা ছাড়া বিচার চাওয়ার সব জায়গায় আজ তাদের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।
সারা পৃথিবী যখন দখলদার ইসরায়েলের বারুদের ভয়ে নিরব তখন হাদিল সালাহ আল-হাশলামুনের মতো কিশোরীরা অকাতরে নিজের প্রাণটা দিয়ে যাচ্ছে। আর মুসলিম যুবকদের নিঃশব্দে বলে যাচ্ছে,,
দেখো, তোমাদের রক্ত যখন শীতল হয়ে যায়, তোমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ো, বন্দুকের নলে যখন তোমরা মৃত্যু দেখো, আমরা মুসলিম মেয়েরা তখন নিজেদের হেফাজতের জন্য জেগে উঠি। জীবন দিয়ে হলেও নিজেদে সম্ভ্রমের এতটুকু ক্ষতি করতে দিই না। যে সম্ভ্রম রক্ষার দায়িত্ব প্রভু তোমাদের উপর দিয়েছিল…
এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলো পড়ুন:
২. ক্রুসেডারদের নৃশংসতা এবং সালাউদ্দিন আইয়ুবীর মহাবিজয়
৩. বেলফোর ঘোষণা এবং এক নতুন ষড়যন্ত্র
৪. ফিলিস্তিনের বুকে দখলদার ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা
৫. বিশ্ব রাজনীতিতে ফিলিস্তিনের পরাজয়
This is a Bengali article. This is the sixth episode of ‘The History of Zionist Israel’.
Necessary references are hyperlinked inside the article.
Featured Image: Getty Image