পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের সূচনা ২ আগস্ট, ১৯৯০ সালে। ১৯৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এর আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম নামে সমধিক পরিচিত এই যুদ্ধের সংঘটিত হয় ইরাক এবং ৩৪টি দেশের জাতিসংঘ অনুমোদিত যৌথ বাহিনীর মধ্যে। ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে ইরাকের কুয়েত আগ্রাসন এবং কুয়েতি ভূ-খন্ড দখলের প্রেক্ষিতে ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে কুয়েতকে মুক্ত করাই ছিল এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য।
এই যুদ্ধটি আরও কিছু নামে পরিচিত । যেমন : পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধ (Persian Gulf War), প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ (First Gulf War), কুয়েত যুদ্ধ (Kuwait War) ইত্যাদি। ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট ইরাকের সেনাবাহিনী কুয়েত দখল করা শুরু করলে বিভিন্ন দেশ তার নিন্দা জানায়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরাকের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জর্জ এইচ. ডব্লিউ. বুশ সৌদি আরবে সেনা মোতায়েন করেন এবং অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোকেও তাদের সেনা পাঠাতে অনুরোধ করেন।
আপনারা অনেকেই জানেন যে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে ১৯৮৮ সালে শেষ হয়েছিল ইরান-ইরাক যুদ্ধ।৮ বছর ধরে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে বিপুল অংকের বৈদেশিক দেনার দায়ে ইরাকের অর্থনৈতিক দৈন্যতা শোচনীয় হয়ে পড়ে।
সাদ্দাম সরকার যুদ্ধের অজুহাতে মার্কিন ও পশ্চিমা সরকারগুলোর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ উন্নত সমরাস্ত্র পেয়েছিল এবং এমনকি অপ্রচলিত গণ-বিধ্বংসী অস্ত্রও পেয়েছিল আগ্রাসী এই সরকার।
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, ইরাকের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় দশ লাখ। যুদ্ধের সুবাদে দেশটির সামরিক শিল্প ব্যাপক মাত্রায় বিস্তৃত হয়েছিল। কিন্তু এই শিল্পকে দেশটির নড়বড়ে অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে এই বিপুল সংখ্যক সেনা ও অস্ত্র শিল্প বাথিস্ট সাদ্দাম সরকারের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধেই মারাত্মক হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। অন্যদিকে মার্কিন সরকার ও তার মিত্ররাও অস্ত্রের গুদামে পরিণত হওয়া ইরাককে তাদের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছিল। আর এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় ছিল নতুন কোনো সামরিক হঠকারিতা। এমন এক পরিস্থিতিতে সাদ্দামের বাহিনী ১৯৯০ সালের দোসরা আগস্ট কুয়েতে হামলা করে এবং মাত্র ১৩ ঘণ্টার মধ্যে দেশটির সমস্ত অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
ওই যুদ্ধে আনুমানিক ২,০০০,০০০ ইরাকি নিহত হন। যুদ্ধবন্দি হয় প্রায় ৮০,০০০ ইরাকি সেনা, কত হয় প্রায়ই ৭৫,০০০। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কোয়ালিশন বাহিনীর মাত্র।৩৫৮ জন সৈন্য নিহত হয়। আহত হন প্রায় ৭৭৬ জন। আর ৪১ জন যুদ্ধবন্দি হন। হতাহত কুয়েতির সংখ্যা অজানা।
মধ্যপ্রাচ্যের সংকট নিয়ে আলােচনা করলে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ নিয়ে আলােচনা করার প্রয়ােজন রয়েছে। ফিলিস্তিনি সংকটের সাথে এই যুদ্ধ (১৯৯০) সরাসরিভাবে সম্পর্কিত না থাকলেও, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে এই যুদ্ধ যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরাককে কেন্দ্র করে দু দুটো যুদ্ধ হয়েছে। প্রথম যুদ্ধ ইরাক শুরু করেছে। আর পরের যুদ্ধটি ইরাকের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে।
দু দুটো যুদ্ধের ব্যবধান ছিল মাত্র তেরো বছর। নায়ক ছিলেন একই ব্যক্তি সাদ্দাম হােসেন। তেল সম্পদ দু দুটো যুদ্ধের কারণ হলেও, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ (১৯৯০) জাতিসংঘ অনুমোদন করেছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি বহুজাতীয় বাহিনী ইরাকের বিরুদ্ধে ওই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। অন্যদিকে, দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধে (২০০৩) জাতিসংঘের কোনাে অনুমােদন ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র একক উদ্যোগে ওই যুদ্ধের সূচনা করলেও, পরবর্তীকালে বহুজাতীয় বাহিনী ওই যুদ্ধে অংশ নেয়। তবে নানা কারণে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ বিংশ শতাব্দীর একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা।
নিয়ম-নীতির তােয়াক্কা না করেই সাদ্দাম হােসেন কুয়েত আক্রমণ করেছিলেন। উপসাগরীয় সংকটের বিস্ফোরনােন্মুখ অবস্থার সৃষ্টি সেখানেই। এই সংকটকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালীন সব থেকে বড় সংকট বললে ভুল বলা হবে না। কোরিয়া বা ভিয়েতনাম যুদ্ধ কিংবা কিউবার ‘বে অফ পিগস’-এর ঘটনা, কোনােটার সাথেই তুলনা
করা যাবে না, কেননা ওই যুদ্ধ সবগুলাে থেকে পৃথক ছিল।
আরো পড়ুনঃ
উপসাগরীয় যুদ্ধঃ সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত দখল এবং এর পরিণতি (পর্ব ২)
উপসাগরীয় যুদ্ধঃ সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত দখল এবং এর পরিণতি (পর্ব ৩)
জাতিসংঘের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতাে একটি স্বাধীন সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নিছক আক্রান্তই হলাে না বরং দেশটিকে দখল করে নিজের ‘উপগ্রহে’ পরিণত করার মতাে ঘটনা ঘটল। দুটো প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশ, যাদের নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের ২০ ভাগ তেলভাণ্ডার তাদের মধ্যকার এই সংকট বিশ্ববাণিজ্যকে এক নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল ।
যুক্তরাষ্ট্র ওই সংকটে কিন্তু বসে থাকেনি বরং কূটনৈতিক সাফল্যকে পুঁজি করে একটা যৌথবাহিনী গঠন করে ইরাকের কুয়েত আক্রমণের যথাযথ সাড়া প্রদান করে। কুয়েতমুক্ত অভিযানের নামকরণ করা হয় প্রথমে ‘Desert Shield’, পরে ‘Desert Storm’। যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় এলাকায় ৬ লাখের মতাে সৈন্য মােতায়েন করেছিল। অপারেশন ‘ডেজার্ট স্টর্মে’ প্রাণহানি অন্য যে কোনাে যুদ্ধ থেকে কম ছিল। যেখানে কোরিয়া যুদ্ধে ৪.৫ মিলিয়ন, ভিয়েতনাম যুদ্ধে ২ মিলিয়নের উপর, লেবাননে ২.৫০,০০০, ইরান-ইরাক যুদ্ধে ৫,০০,০০০ লােকের প্রাণহানি ঘটে সেখানে এই যুদ্ধে
প্রায় ১,০০,০০০ লােকের প্রাণহানি ঘটে।
তবে যুদ্ধোদ্যোগ আর আধুনিক সমরাস্ত্রের
ব্যবহারের দিক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কোরিয়ার পরেই এর অবস্থান ছিল। নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব অন্য যুদ্ধগুলাে থেকে এই যুদ্ধকে সামরিক দিক থেকে পৃথক করেছিল। তিনটি বৈশিষ্ট্য আমরা উল্লেখ করতে পারি।
১. উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকিদের প্রাণহানি যেখানে প্রায় লাখের কাছাকাছি সেখানে যৌথবাহিনীর প্রাণহানি মাত্র কয়েক ডজন। এই যুদ্ধকে অধ্যাপক ফ্রেড হলিডে, ১৯১৪ এর পূর্বেকার ঔপনিবেশিক যুদ্ধগুলাের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
২. এই যুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যুদ্ধের ব্যাপ্তি না বাড়ানাে। যেখানে বাগদাদকে যৌথবাহিনী পুরাে দখল করতে পারত, সেখানে তা না করে প্রেসিডেন্ট বুশ যুদ্ধ বন্ধ ঘােষণা করেছিলেন,
৩. এই যুদ্ধের আর একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়। এটা ঠিক যে অন্য যে কোনাে যুদ্ধেই পরিবেশের বিপর্যয় ঘটে। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপকভাবে কৃষিভূমি ও বনভূমি ধ্বংস হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বােমার বিস্ফোরণ, ভিয়েতনামে ব্যাপক রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার
উপসাগরীয় যুদ্ধ থেকে ভয়াবহ ছিল। তবে পার্থক্যটা হলাে ইরাকিরা পিছু হটার সময়
তেলকূপগুলােতে যে বিস্ফোরণ ঘটায় তাতে সমস্ত উপসাগরে চরম পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছিল এবং এই প্রথম জলচর জীবদের সব থেকে বেশি ক্ষতি সাধিত হয়েছিল।
ইরাক কুয়েত দুটো দেশই অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। অটোমান শাসকরা কুয়েতকে বসরার সাথে সংযুক্ত করেছিল। ১৭৯৬ সালে কেন্দ্রীয় আরব ভূমির দেশত্যাগী লােকেরা ধীরে ধীরে কুয়েতে এসে স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করে। পরবর্তীকালে এরা যখন শাসকে পরিণত হয় তখন বসরার অঙ্গরাজ্য হিসেবে থাকতে অস্বীকৃতি জানায়। বসরার অধীনে কুয়েতের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয় ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত।
এদিকে উপসাগরীয় অঞ্চলে গ্রেট ব্রিটেনের উত্থান ঘটতে শুরু করে। ফলে তুর্কিদের বেশ উপকার হয়। তার ব্রিটিশদের সহযােগিতায় অটোমানদের দমিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। ১৯২২ সালে এসে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তিতে বলা হয়, অর্ধেক করে কুয়েতি এলাকা সৌদি আরব ও ইরাকের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হবে। এর পর ব্রিটিশরা যখন এই এলাকা থেকে চলে যায় তখন কুয়েতকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘােষণা দেয় এবং ১৯৬৩ সালে জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে কুয়েত স্বীকৃতি লাভ করে।
এখানে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, কুয়েতকে ইরাক থেকে পৃথক করার ফলে ইরাকের ভৌগােলিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায়। কুয়েতের অবস্থানের কারণে উপসাগরে ইরাকের প্রবেশদ্বার শুধু রুদ্ধই হয়নি, উপরন্তু ইরাকের একমাত্র বন্দর ‘উম্ম কসর’ (Ummqasr) এর ব্যবহার হয়ে ওঠে অসুবিধাজনক। এ কারণে ইরাক কুয়েতকে তার দুটো ছােট দ্বীপ লীজ দেয়ার জন্য দাবি জানিয়ে আসছিল।
কিন্তু কুয়েত তাতে রাজি হয়নি। ইরাকের বারবার নিয়ন্ত্রণ দাবি সত্ত্বেও কুয়েত আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করে মূলত ব্রিটিশদের সহায়তায়। তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হলাে ইরাক-কুয়েত সম্পর্ক কিন্তু সবসময় টানাপােড়েনের মধ্যে ছিল না বরং স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। বিগত ১৯৮০-‘৮৮ সালের ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় কুয়েত ইরাককে ১৫ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছিল। অথচ যুদ্ধ শেষে সাদ্দাম হােসেন সবকিছুই ভুলে যান এবং কুয়েত আক্রমণ করে বসেন।
This is a Bengali article. It’s About 1st episode of ‘Gulf War’.
Necessary reference are hyperlinked inside article.
Featured Image: Middle East Eyes