লিখুন
ফলো

উপসাগরীয় যুদ্ধ: সাদ্দাম হোসাইনের কুয়েত দখল এবং এর পরিণতি (পর্ব-২)

সাদ্দামের কুয়েত আক্রমণের অনেকগুলাে কারণ ছিল। প্রথম থেকেই ইরাকের অভিযােগ ছিল কুয়েতের বিরুদ্ধে সীমান্ত প্রশ্নে এবং জন্মের বৈধতা নিয়ে। ১৯৭১ সালে এসে ইরাক কয়েকটি কুয়েতি দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ দাবি করে। আর সেই দাবিকে সামনে রেখেই ইরাক দেশটি দখল করে নিয়েছিল। ইরাকের যুক্তি ছিল ঐতিহাসিকভাবেই ওই অঞ্চলটি (অর্থাৎ কুয়েত) তাদের। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের কারসাজিতে দেশটিকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। কুয়েত স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৬১ সালের ১৯ জুলাই । কিন্তু ইরাক কুয়েতের উপর তার অধিকার কখনাে ছেড়ে দেয়নি।

image: wikipedia
১৯৭৯ সালে ইরাকে সাদ্দাম হােসেনের উত্থান ও ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে ইরাক একটি কট্টরপন্থী দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড়ে একটি চুক্তির বিনিময়ে মিসর ও ইসরাইল পরস্পর পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়।

কিন্তু ইরাক ওই চুক্তির বিরােধিতা করে কট্টরপন্থী দেশ হিসেবে আরাে বেশি পরিচিতি পায়। এরপর ইরাক ইরানের প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৮০-‘৮৮ সাল পর্যন্ত ইরাক ইরানের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে অবিচলভাবে। যুদ্ধের পরে পরেই সাদ্দাম হােসেন দেশ পুনর্গঠনের দিকে নজর দেবেন এটাই ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু তা হয়নি। ইরানের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইরাক শুধু জানমালেরই লােকসান দেয়নি, রবং তার অর্থনীতি প্রায় তেতে পড়ার সম্মুখীন হয়েছিল।



যুদ্ধের পর ইরাকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অর্থনৈতিক দৈন্য, চোরাকারবার ও অপ্রতুল খাদ্য সরবরাহের কারণে দেশের ভেতরে সাদ্দাম হােসেন তার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিলেন। তাই নিজের সংকট কাটিয়ে ওঠা এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের পুনর্গঠনের জন্য সাদ্দাম মরিয়া হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি বলতে থাকেন তার দেশ আরবদের স্বার্থেই ‘আত্মােৎসর্গিকৃত’ যুদ্ধ করছে। অথচ আরব ধনী দেশগুলাে তখন তার পুনর্গঠনে কোনাে সাহায্য দেয়নি। অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে সাদ্দামের প্রয়ােজন ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলার। যা তিনি প্রতিবেশী ধনী আরব আমীর ও বাদশাহদের কাছে সাহায্য হিসেবে চেয়েছিলেন।

কুয়েতের বিমান বহর; image: wikipedia

যে কুয়েতকে ইরাক তার অংশ বলে দাবি করছিল, তার প্রাচুর্য ও সম্পদের উপর সাদ্দাম সম্ভবত লােভ সামলাতে পারেননি। ইরাকের ভৌগােলিক অবস্থান কুয়েতের কারণে বেশ সংকটজনক ছিল। বিশাল সীমান্ত জুড়ে বহু তেলক্ষেত্র ছিল। ১৯৯০ সালের জুলাই মাসে এসে সাদ্দাম হােসেন সীমান্তবর্তী ইরাকি স্থাপনাগুলাে থেকে কুয়েতিদের বিরুদ্ধে বিপুল অর্থের তেল চুরির অভিযােগ উত্থাপন করেন। কুয়েতের নিকট সাদ্দাম হােসেন ১৮ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। কুয়েত তাতে সম্মত হয়নি।



ইরাক আরাে অভিযােগ করে যে, কুয়েত নির্ধারিত ওপেক কোটার অতিরিক্ত তেল উৎপাদন করার ফলে ইরাকের লােকসান হয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলার। কারণ তখন এর ফলে তেলের দাম হ্রাস পায়। ওপেক যদিও তেলের মূল্য ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ ডলার করতে রাজি ছিল, কিন্তু ইরাকের দাবি ছিল ২৫ ডলার। এসব ব্যাপার নিয়ে দু-দেশের
মধ্যে প্রাথমিক তৎপরতা ব্যর্থ হলে সৌদি আরব মধ্যস্থতার জন্য এগিয়ে আসে। কিন্তু তাও ব্যর্থ হয়। ঠিক ওই সময় ইরাক কুয়েত সীমান্তে কয়েক ডিভিশন সৈন্য মােতায়েন করে।

কুয়েতের ট্যাংক বহর; image: wikipedia

বিশ্লেষকরা তখন মনে করেছিলেন যে হয়তােবা কূটনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য ইরাক এমনটি করছে। ইরাকের অর্থনৈতিক অবস্থা সত্তরের দশকের দিকে বেশ শক্ত অবস্থানে ছিল। কিন্তু দীর্ঘ ৮ বছরের যুদ্ধ তাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। কৃষি ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাহায্য সহযােগিতা করার পরও কোনাে কাজ হচ্ছিল না। এরপর যখন
তেলের দাম কমতে শুরু করে তখন পরিস্থিতি আরাে জটিল হয়ে পড়ে।



ওই সময় ইরাকের মধ্যে অনেকগুলাে গােষ্ঠী ছিল। বড় অংশ হচ্ছে ‘আরব’ সম্প্রদায়ভুক্ত। এরা ছিল জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ। আর কুর্দিরা ছিল ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। সাদ্দামের জন্য তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল ওই কুর্দিদের নিয়ে তারা হঠাৎ আলাদা রাষ্ট্রের দাবি করে বসতে পারে। অতীতে সাদ্দাম তাদের দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে। ফলে কুর্দিরা সাদ্দামের জন্য এক ধরনের হুমকি ছিল।

মার্কিন সৈন্যদের সাথে সৌদি আরবে সাক্ষাৎ করছেন প্রেসিডেন্ট বুশ; image: wikipedia

অন্যদিকে, ইরাকে শিয়া-সুন্নি সমস্যাও প্রকট ছিল। শতকরা ৫২ ভাগ লােক ছিল শিয়া, অথচ সরকার ছিল সুন্নি নিয়ন্ত্রিত। ফলে শিয়ারা সুন্নি নিয়ন্ত্রিত সাদ্দাম সরকারের জন্য হুমকি ছিল। এজন্য ইরাকের রাবার পার্লামেন্ট সাদ্দাম হােসেনকে সারা জীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট ঘােষণা করেছিল। এর ফলে শিয়ারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে শুরু করে, তাদের
এ মনােযােগকে অন্যদিকে সরিয়ে নেয়ার জন্য সাদ্দাম কুয়েত আক্রমণ করেছিলেন বলে কারও কারও ধারণা।

আরো পড়ুনঃ

উপসাগরীয় যুদ্ধঃ সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত দখল এবং এর পরিণতি (পর্ব ১)

উপসাগরীয় যুদ্ধঃ সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত দখল এবং এর পরিণতি (পর্ব ৩)

যে সময়টা সাদ্দাম হােসেন কুয়েত আক্রমণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন, ওই সময়টা তার জন্য অনুকূলে ছিল না। ততদিনে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পূর্ব ইউরােপে সমাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান হয়েছিল, বিশেষ করে রুমানিয়াতে স্বৈরশাসক চসেস্কুকে ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রাণ দিতে হয়েছিল। বাকিদের (সিভকভ, হুসাক, হােনেকার) সবাইকে পূর্ব ইউরােপে গণঅভ্যুত্থানের কারণে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। সেখানে শুরু হয় তথাকথিত গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া। এর ঢেউ এসে লাগে আরব বিশ্বেও। আরব বিশ্বে ইরাক ও অন্য কয়েকটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রায়নের ক্ষেত্রে বিতর্ক শুরু হয়।

সাদ্দাম
ইরাকের করুণ পরিণতি; image: wikipedia

অতীতে সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও সাদ্দাম হােসেন তাদেরকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তিনি বৈরী আচরণ শুরু করেন। তিনি উপসাগর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানান, সাথে আরব রাষ্ট্রগুলােকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বয়কটের আহ্বান জানান। অন্যদিকে ওপেক কোটা থেকে বেশি তেল উৎপাদন করে কুয়েত তেলের দাম কমিয়ে আমেরিকাকে সাহায্য করছে, এই অভিযােগ উপস্থাপিত হয় সাদ্দাম হােসেনের পক্ষ থেকে।

তিনি অভিযােগ করেন আমেরিকা ইসরাইলকে লেলিয়ে দিচ্ছে প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধে। সাদ্দাম হােসেন কুয়েত আক্রমণ করে দাবি করেন ফিলিস্তিনিকে রক্ষার জন্য তিনি কুয়েতকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। সাদ্দামের কুয়েত আক্রমণের আরও একটি গভীরতর ব্যাখ্যা আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলাের আচরণবিধি যদি লক্ষ্য করা যায়, তাহলে একটা জিনিস দেখা যায়, তৃতীয় বিশ্বে যারা সম্পদ সমৃদ্ধতার কারণে কিছুটা স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে, তাদের প্রধান লক্ষ থাকে পরাশক্তির বিপরীতে নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করা।



একে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা বলেন Autonomy Assertion। এই Autonomy Assertion-এর অন্যতম পথ হলাে সামরিক শক্তি বাড়ানাে। সামরিক শক্তির কারণে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে এসব রাষ্ট্র স্বতন্ত্র ভাবমূর্তি দৃঢ় করার প্রয়াসী হয়। এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে গিয়ে কোনাে না কোনাে সময় ওইসব রাষ্ট্র পরাশক্তিগুলাের সাহায্য পেতে শুরু করে। আমরা এক্ষেত্রে বেশ কিছু উদাহরণ দিতে পারি। রেজাশাহ পাহলভীর ইরান, ভারত বা লিবিয়ার কথা বলা যেতে পারে।

image: wikipedia

ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যপুষ্ট হয়ে তার নিজের অবস্থানকে আরব বিশ্বে সুদৃঢ় করে ফেলেছিল। লিবিয়া আর ভারতের উত্থানে সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। আর ইরাকের সামরিক শক্তি হিসেবে আবির্ভাবের পেছনে অবদান ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মতাে পরাশক্তির। ইরানের সাথে যুদ্ধ করে সুবিধা করে উঠতে পারেননি সাদ্দাম হােসেন, বরং নিজের দেশে বীর রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার যে ভাবমূর্তি ছিল তার অবনতি ঘটেছিল। ফলে বীরত্ব ধরে রাখার স্ট্রাটেজি হিসেবে সাদ্দাম কুয়েত দখল করেছিলেন।

তার এই বীরত্বের সম্প্রসারণের জন্য বুদ্ধিমান সাদ্দাম ইসরাইল বিরােধী একটি অবস্থানের কথা উল্লেখ করলে পরিস্থিতি বেশ জমে উঠেছিল। ইসরাইলের দখল করা আরব ভূমিমুক্ত করার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল কুয়েত ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি।


This is a Bengali article. It’s About 2nd episode of ‘Gulf War’.

Necessary reference are hyperlinked inside article.

Featured Image: Middle East Eyes

Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous Article

উপসাগরীয় যুদ্ধ: সাদ্দাম হোসাইনের কুয়েত দখল এবং এর পরিণতি (পর্ব-১)

Next Article

উপসাগরীয় যুদ্ধ: সাদ্দাম হোসাইনের কুয়েত দখল এবং এর পরিণতি (পর্ব-৩)

Related Posts

ইসরায়েলি ষড়যন্ত্রের হাজার বছরের ইতিহাস

ইহুদিদের আবির্ভাব মানব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহল কোনাে যুগেই কম ছিল না। আজকের…

ইহুদী বাদী ইসরায়েলের ইতিহাস (৪র্থ পর্ব): ফিলিস্তিনের বুকে দখলদার ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা

ফিলিস্তিনি আরব মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানাের কারণে ইহুদিরা যখন বিশ্ব বিবেকের কাছে সমালােচিত হচ্ছিল, তখন জনমত নিজেদের পক্ষে…

যেভাবে আমেরিকা পরিণত হলো বৈশ্বিক সুপার পাওয়ারে (পর্ব -২) : (ব্রেটন উডস কনফারেন্স থেকে বর্তমান)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই মূলত বিশ্বজুড়ে আমেরিকার প্রভাব স্থায়ী রুপ লাভ করে। ১৯৪৫ সালে ২৪শে অক্টোবর ৫১টি দেশের অংশগ্রহণে…

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন

Total
0
Share