ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ব্যাপারটা ঘটেছিলো ১৯৭২ সাল নাগাদ। এক অস্থির রাজনৈতিক বিযয়ে হুট করেই যেনো সারা বিশ্বের মানুষ হতবাক হয়ে গেলো। নির্বাচন নিয়ে ঘটে গেছে এক অভাবনীয় নাটক, যার পেছনে জড়িত ছিল স্বয়ং প্রেসিডেন্ট! এ এক অদ্ভুত ইতিহাস, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ইতিহাস।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি যা ১৯৭০ দশকের দিকে একটি চলমান রাজনৈতিক অবস্থা হিসেবে গণ্য করা হতো। সারা বিশ্বে এটি বেশ সাড়া জাগানো একটি ঘটনা ছিল। যদিও রাজনৈতিক ইস্যু হলেও এই কাহিনীর পেছনে বেশ কিছু সাজানো গল্পও জড়িত ছিল।
ইতিহাসের পাতায় অনেক ঘৃণিত গল্পের কথাই আমরা জানি। এমন হাজার হাজার অজানা ইতিহাসের মধ্যে এই ইতিহাসও বেশ প্রভাব ফেলেছিলো সারা বিশ্বে। ১৯৭২ সালের ১৭ জুন ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দল এবং প্রশাসনের পাঁচ ব্যক্তি ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াটারগেট ভবনস্থ বিরোধী ডেমোক্রেট দলের সদর দফতরে এক গোপন যন্ত্র বসায়। কিন্তু ব্যপার হচ্ছে যে, নিক্সনের প্রশাসন সেই কেলেঙ্ককারি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। ঠিক এই ঘটনার ফলে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন ৯ই আগস্ট ১৯৭৪ সালে তার পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হোন। আমেরিকান সমাজ, রাজনীতিতে তৈরি হয়েছিল গভীর বিভক্তি। যার কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি, সংকট চলছিলো অর্থনীতিতেও। তীব্রভাবে এই ঘটনার জন্য আসলে দায়ী করা যাবে কাকে?
এই কেলেঙ্কারির ঘটনায় নিক্সনের যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগের ঘটনাটি প্রথম ঘটনা হিসেবে গণ্য করা হয়। এরপর এই ঘটনার বিচার ও দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ৪৩ জনকে কারাগারে দেয়া হয় যার মদ্ধে কয়েকজন ছিলেন নিক্সন প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা! এই ঘটনাটি শুরু হয়েছিলো ৫ জন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের মাধ্যমে যারা সেদিন ওয়াটার গেট ভবনস্থ বিরোধী ডেমোক্রেট দলের সদর দফতরে চুরি করে প্রবেশ করেছিলেন। তৎকালীন এফবিআই অর্থাৎ ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রচারণের কাজে নিয়োজিত সরকারী প্রতিষ্ঠানের পুনরায় নির্বাচনের জন্য গঠিত হয়। এবং সেখানে গঠিত কমিটির সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়। ১৯৭৩ সালের জুলাইয়ের সিনেট ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি তদন্ত কমিটির সাবেক সদস্যরা রাষ্ট্রপতির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সহ তথ্য উপস্থাপন করেন। সেখানে উল্লেখ ছিল যে, রাষ্ট্রপতি নিক্সনের অফিসে এক টেপরেকর্ডারের সাহায্যে তিনি অনেক কথা রেকর্ড করেছিলেন। পরবর্তীতে এই রেকর্ড থেকেই জানা যায় যে, রাষ্ট্রপতি নিজেই এসব কিছু ধামাচাপা দিতেন। এবং এরপরেই আদালতের সাথে একটি জটিল লড়াইয়ের পর উচ্চ আদালত রাষ্ট্রপতিকে এসকল রেকর্ড আদালতে জমা দেয়ার নির্দেশ দেন। নিক্সন সেটা মেনেও নেন। নিক্সনের বেশ কিছু পদক্ষেপ পরবর্তীতে তাকে ক্ষমতায় থাকার জন্য জটিল করে ফেলে।
হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টিটিভ দ্বারা অভিশংসন এবং সিনেট দ্বারা অভিযুক্ত হওয়ার দরুন মুখোমুখি হওয়ার সময় তিনি ৯ই আগস্ট ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে তার জায়গায় গ্যারাল ফোরড ক্ষমতায় এসে তাকে ক্ষমা করে দেন। এই ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি গণমাধ্যমে ফাঁস ক্রেন কার্ল বার্নস্টেইন নামের এক সাংবাদিক। এছারা প্রত্যক্ষদর্শী আরেক সাংবাদিক টম ডে ফ্র্যাংক নামের এক সাংবাদিকও এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন, যিনি নিউজউইকের হোয়াইট হাউস সংবাদদাতা। তিনি জানান, আগস্টের পাঁচ তারিখ সোমবার সেদিন হোয়াইট হাইসে তিনটি টেপ রেকর্ডকরা কথোপকথনের হুবহু বিবরণী প্রকাশ করেন। যদিও নিক্সন সেগুলো গোপন রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার আগেই সুপ্রিমকোর্ট রায় দেন তাকে সব প্রকাশ করতে হবে। টম জানান, নিক্সনের ঘোষণার পর হোয়াইট হাউসের সামনে সমবেত জনতার মধ্য থেকে এক বিপুল হর্ষধ্বনি শোনা যায়। তখন তার যেন অনে হলো হয়ত স্বয়ং প্রেসিডেন্টও সেটা শুনতে পেরেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন ২৯ এপ্রিল ১৯৭৪ সালে টেপ এর উপর সম্পাদিত মুক্তির ব্যখ্যা করে একটি ভাষণ দেন। মূলত সে ভাষণ ছিল তার পদত্যাগ নিয়ে। এবং সবশেষে তাই হয়েছিলো। নিক্সন বিদায় নিবে সেই ঘোষণা শোনার পর জনগণ সত্যিই খুশি হয়েছিলো। এমনকি স্বস্তিবোধও করেছিলেন। নিক্সন তার ভাষণ দেয়ার পরেরদিনই হোয়াইট হাউস ছেড়ে যান। ১৯৭২ সালের এই ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বহুল আলোচিত ঘটনা। জানা যায়, নিক্সন পদত্যাগ করার পরই একজনকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হয়। প্রখ্যাত এই ঘটনাটির জন্মস্থান যুক্তরাষ্ট্রের এবন সেটি ওয়াশিংটনের একটি হোটেলের নাম। সাংবিধানিক যে একটা সংকট শুরু হয়েছিলো মূলত ওয়াটার গেট রাজনৈতিক ঘটনাটি জড়িয়ে আছে। ১৯৭২ সালের অনেক দিন পরে ২০১৬ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এবার সেই নির্বাচনে আক্রান্ত হয় ডেমোক্রেট দলের ন্যাশনাল কমিটি। মার্কিন তদন্তকারীরা জানিয়েছেন তাদের সার্ভার হ্যাকিং এর শিকার হয়েছেন এবং এর পেছনে রুশ দায়ী বলেও জানিয়েছেন তারা। মার্কিন আইনজীবী জন ডিন ওই দুই নির্বাচনই প্রত্যক্ষ করেছিলেন। বিবিসি রেডিওকে তিনি জানান, নিক্সন ও ট্রাম্প দুজনই কর্তৃত্বপরায়ণ লোক। কেবল পার্থক্য হচ্ছে, নিক্সন প্রকাশ্যে সে আচরণ কাউকে দেখাতেন না। কিন্তু ট্রাম্প সেটা সরাসরি দেখাতে চান।
জন ডিন আরও বলেন যে, এটি হয়তোবা দ্বিতীয় ওয়াটার গেট হচ্ছে না কিন্তু সেই একই ধাঁচ যেন ফুটে উঠছে। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া এই রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির ঘটনাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক ইতিহাস হয়ে থাকবে আজীবন এটা সে দেশের নাগরিক সহ সারা বিশ্বের জনগণ মগজে আয়ত্ত করে নিয়েছে।
ওয়াটারগেটের উৎপত্তি যেভাবে
১৯৭২ সালের রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মাধ্যমে ওয়াটারগেটের উৎপত্তি ঘটে। সেসময় রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিচারড নিক্সন পুনঃনির্বাচনের জন্য যখন প্রচার চালাচ্ছিলেন তখন আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পরে এবং এই যুদ্ধের কারণেই পুরো দেশ বিভক্ত হয়ে যায়। এক সময় এই পরিস্থিতে কিছু লোকজনের প্ররোচনায় অবৈধ গুপ্তচরবৃত্তির কৌশল খাটানোকে কাজে লাগাতে শুরু করে আমেরিকান রিপাবলিকান। সেই বছরের মে মাসেই নিক্সনের কমিটির সদস্যরা তাকে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার জন্য বিরোধী দলের ডেমোক্রেট দলের ওয়াটারগেট সদর দপ্তরে অনুপ্রবেশ করে। গোপনে নথি চুরি করে এবং ফোনে আড়িপাতার যন্ত্র বসান। কিন্তু তাদের ফোনে আড়িপাতার যন্ত্র কাজ করছিলো না বলে জুন মাসে ৫ জন সেই বিল্ডিঙে ফেরত আসে। চোরেরা যখন নতুন করে ফন্দি আঁটে আবার তারা যন্ত্র বসাবে, ঠিক তখন সেই বিল্ডিঙের গার্ড খেয়াল করতে পারেন সেখানে বেশ কিছু তালা নষ্ট করে ফেলেছেন। তখন সেই গার্ড পুলিশে খবর দেন তাৎক্ষনিক। বেশ অভিজ্ঞতার সাথেই পুলিশ হাতেনাতে সেই লোকদের আটক করতে সক্ষম হন। এই ঘটনার পেছনে যে আরও বেশ কিছু মানুষের হাত আছে তা নিয়ে আর কোন সন্দেহ বাকি ছিল না। তদন্তেও এটাই উঠে আসে। এদের মধ্যে ওয়াশিংটনের রিপোর্টার বব উডওয়ারড এবং কার্ল বার্নস্টেইন, জজ জন যে সিরিকা সেই সন্দেহের তালিকা করা করতে থাকেন। তাদের মতে, এই ঘটনার পেছনে সূক্ষ্ম কোন ঘটনা জড়িয়ে আছে, এখানে আরও ষড়যন্ত্র আছে বেশ কিছু। তখন আড়াল হয়ে থাকা চক্রান্তকারীদের উপর বেশ চাপ পড়তে থাকে। এক সময় নিক্সনের পক্ষে বেশ কয়েকজন অবস্থান করলেও কাজ হয়নি। তাদের সেই রেকর্ডিংগুলো যেন কারো সামনে প্রকাশ না পায় তার জন্য নক্সন অনেক চেষ্টা করেছিলেন। নিক্সনের উকিল তখন নিক্সনের পক্ষ নিলেও সিরিকা এবং আর্কিবল্ড এর সিদ্ধান্তে তারা হার মানতে বাধ্য হয়।
আরো পড়ুনঃ
দ্বিচক্রযান : যেভাবে ইতিহাসের পথে চলতে চলতে বর্তমান রুপ পেলো সাইকেল [পর্ব : ১]
এই ঘটনার পেছনে যে আরও বেশ কিছু মানুষের হাত আছে তা নিয়ে আর কোন সন্দেহ বাকি ছিল না। তদন্তেও এটাই উঠে আসে। এদের মধ্যে ওয়াশিংটনের রিপোর্টার বব উডওয়ারড এবং কার্ল বার্নস্টেইন, জজ জন যে সিরিকা সেই সন্দেহের তালিকা করা করতে থাকেন। তাদের মতে, এই ঘটনার পেছনে সূক্ষ্ম কোন ঘটনা জড়িয়ে আছে, এখানে আরও ষড়যন্ত্র আছে বেশ কিছু। তখন আড়াল হয়ে থাকা চক্রান্তকারীদের উপর বেশ চাপ পড়তে থাকে। এক সময় নিক্সনের পক্ষে বেশ কয়েকজন অবস্থান করলেও কাজ হয়নি। তাদের সেই রেকর্ডিংগুলো যেন কারো সামনে প্রকাশ না পায় তার জন্য নক্সন অনেক চেষ্টা করেছিলেন। নিক্সনের উকিল তখন নিক্সনের পক্ষ নিলেও সিরিকা এবং আর্কিবল্ড এর সিদ্ধান্তে তারা হার মানতে বাধ্য হয়।
কে এই নিক্সন?
আমেরিকান রিপাবলিক সদস্য রিচারড নিক্সনের জন্ম ৯ জানুয়ারি ১৯১৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়া শহরে। বেশ দারিদ্র্যতার মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠতে হয় তাকে। ছোটবেলায় তাকে তার বাবার মুদি দোকানে সাহায্য করতে হয়েছিলো। তিনি যখন কৈশোরে পা রাখে ন তখন তার দুই ভাই যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তীব্র অভাব থাকা স্বত্বেও নিক্সন স্কুলে প্রবেশ করেছিলেন। একসময় ১৯৩৪ সালে হুইটিয়ার কলেজে পড়েন এবং সেখান থেকে ইতিহাস ডিগ্রী নিয়ে স্নাতক হন। পারিবারিকভাবে নিক্সন প্যাট রায়ানকে বিয়ে করেন এবং তার দুটি কন্যাও ছিল যাদের নাম প্যাট্রিসিয়া এবং জুলি।
নিক্সন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭তম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার দায়িত্বকাল ছিল ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করার আগে তিনি রিপাবলিকান ইউএসের সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে নিক্সন আইন অনুশীলন শুরু করেছিলেন ১৯৩৭ সাল নাগাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নৌবাহিনীতে যোগদান করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে তিনি ব্যবসায়িক মালিকানায় হাত দেয়ার চেষ্টা করেন। এক সময় লেফটেনেন্ট কমান্ডার হয়ে উঠেন। কিন্তু সেখান থেকেও ১৯৪৬ সালে পদত্যাগ করেন। জানা যায়, ১৯৬২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নরশিপও হারিয়েছিলেন তিনি।
সাধারণত অফিসে থাকা টেলিফোনে ছোট ছোট মাইক্রোফোন লাগানোর মাধ্যমে এই আড়িপাতার কাজটি শুরু করেন নিক্সন দলেরা। এর মাধ্যমেই নজরদারি করা হতো ডেমোক্রেট নির্বাচনী কৌশলের উপর। এর পাশাপাশি অফিসে থাকা দরকারি কাগজের ছবি তুলতে গিয়ে পুরো অফিসের ক্যাবিনেট তছনছ করে ফেলেন তারা। ছয় তলায় যখন গেলেন তখন খেয়াল করলেন সেই কমিটির অফিসের দরজায় লক ডাক্ট টেপ লাগানো। এই টেপ লাগানো থাকলে দরজা এমনভাবে বন্ধ হয় যে যাতে করে লক আটকে না যায়। এটা দেখে বেশ সহজেই বোঝা যায় ভেতরে কেউ আছেন কিনা। সেই দরজার লকে গোলযোগ দেখার পরেই পুলিশে খবর দেয়া হয়। আর এরপরই পুলিশ সেই দলকে আটক করে। পুরো কেলেঙ্কারিতে ভরা এই ঘটনায় পুরো বিশ্ব তাকিয়ে ছিল নিক্সনের দিকে। আর এক সময় এই প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করে, পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে থাকে এই ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির গল্প!
This is a Bangla Article. Here, everything is written about the WATERGATE SCANDAL
links are hyperlinked
Featured image taken from Google