হোয়াইট হাউজ, পেন্টাগন কিংবা ক্যাপিটল হলে চাইলে যে কেউই মার্কিন সরকারের অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন একটা অঞ্চল রয়েছে যেখানে কোনো মানুষেরই প্রবেশের অনুমতি নেই, প্রবেশ করতে পারবে না সাংবাদিকরাও। সেই এরিয়ার উপর দিয়ে যে কোনো ধরনের বিমান কিংবা হেলিকপ্টার উড়াও নিষিদ্ধ। সাংবাদিক কিংবা সরকারি কর্মকর্তা কেউই এখানে প্রবেশ করতে পারবে না। যদি কেউ গোপনে প্রবেশ করার চেষ্টা করে তাহলে স্বয়ংক্রিয় M16-এর গুলি খেয়ে নির্ঘাত প্রাণ হারাতে হবে। তাছাড়া এরিয়া ৫১ এর প্রহরীদেরও সে অনুযায়ী নির্দেশ দেওয়া আছে, দেখামাত্রই গুলি চালিয়ে যে কাউকে হত্যা করতে পারবে তারা।
আকাশ পথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই বেসের ১৫৫ কিলোমিটার উত্তরে বেলডে নামক পর্বতের চূড়ায় বসানো রয়েছে বিশাল এক ARSR-4 অত্যাধুনিক রাডার। আরো একটি রাডার বসানোর হয়েছে গ্রুম পর্বতের উত্তর দিকে। কোনভাবেই আকাশপথ ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। আকাশ পথে কোনো বস্তুর চিহ্ন দেখা মাত্রই তা ধ্বংস করতে সার্বক্ষণিক স্বয়ংক্রিয় SAM সিস্টেম প্রস্তুত।
বলছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা সমগ্র বিশ্বের সবচেয়ে গোপন ও রহস্যে ঘেরা ‘এরিয়া ৫১’ এর কথা। এরিয়া ৫১ এর চারপাশে বেড়া বা প্রাচীর নেই। কিন্তু সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বেড়াজালে ঘেরা হয়েছে সমগ্র অঞ্চলটি। সিসিটিভি ক্যামেরা, লেজার ডিটেক্টর, মোশন ডিটেক্টর, সাউন্ড ডিটেক্টর এমনকি সর্বাধুনিক প্রযুক্তিগত স্মেল ডিটেক্টরও বসানো আছে এখানে। কি আছে সেখানে? এত গোপনীয়তা রক্ষা করার কারণই বা কি? আসুন সে সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা স্টেটের দক্ষিনে লাস ভেগাস থেকে ১৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পাহাড়ে ঘেরা মরুভূমির মধ্যে এরিয়া ৫১ এর অবস্থান। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন এবং রহস্যময় স্থান। পাহাড়ে ঘেরা বিস্তৃত মরুভূমির মধ্যে প্রায় ৩০ লক্ষ বর্গ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে নেভাডা টেস্ট এন্ড ট্রেনিং রেঞ্জ। পৃথিবীর আধুনিক সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় পরীক্ষাগার। ধারণা করা হয় যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত এই স্থানে ৫০০টিরও অধিক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। যার মধ্যে প্রায় দেড়শ পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে ভূপৃষ্ঠের উপরে। রহস্যে ঘেরা এই স্থানটি যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ যান এবং অত্যাধুনিক ফাইটার জেটগুলো গবেষণা এবং নির্মাণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গোপনীয়।
এত নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা রক্ষার কারণ কি? এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বলে আসছে এরিয়া ৫১ হলো তাদের সবচেয়ে সুরক্ষিত বিমান ঘাঁটি। ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে এরিয়া ৫১ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত U-2 গুপ্তচর বিমান আকাশে উড়েছিল। তারপর থেকে A-12 Oxcart, D-21, SR-71 Blackbird, F-117 Nighthawk, Bird of Prey, F-117A এবং Tacit Blue নামের অত্যাধুনিক গুপ্তচর ও বোমারু বিমানগুলো এখান থেকেই উড়িয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু আমেরিকার এই যুক্তি কি বিশ্ববাসী আদৌ মেনে নিয়েছে। মোটেই না। অস্বাভাবিক মাত্রার নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা যুগ যুগ ধরে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য সন্দেহ, মিথ আর কল্পকাহিনীর। অবশ্য এগুলো নিছক শুধু কল্পকাহিনীই নয়, অনেক সময় বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে গোপন সব বার্তা।
তাহলে কি হয় এরিয়া-৫১ এর ভিতরে?
এরিয়া ৫১ এর নিরাপত্তা ভাঙা আজও সম্ভব হয়নি। তাই এর মূল রহস্য উদঘাটন করাও সম্ভব না। এরিয়া ৫১ এর কাজ সম্পর্কে অসংখ্যবার জানতে চাওয়া হয়েছে মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু কখনোই সন্তোষজনক কোন উত্তর পাননি সাংবাদিকরা। আর এই রহস্য থেকেই জন্ম নিয়েছে অসংখ্য কন্সপিরেসি থেওরি (Conspiracy Theory) বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। আর এই পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ আছেন যারা এ কন্সপিরেসি থেওরি বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। আজকে আমরা এরিয়া ৫১ সম্পর্কে এমন কয়েকটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব।
এখানে এলিয়েন স্পেসক্রাফট বানানো হয়
বব লাজার নামক একজন ব্যক্তি কিছু দিনের কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন এরিয়া ৫১ এর মধ্যে। ওই প্রকল্পের নাম ছিল এস-৪। ওই জায়গাটি এতটাই গোপনীয় ছিল যে তাদেরকে বহনকারী যে বাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার সবগুলো জানালা বন্ধ ছিল, যাতে করে তারা যেনন কোন রাস্তা চিনে রাখতে না পারে। কিন্তু ১৯৮৯ সালে তার দাবির প্রেক্ষিতে গোটা বিশ্বব্যাপী আলোচনার ঝড় ওঠে।
লাজার দাবি করে বসেন তিনি এস-৪ প্রকল্পের ছাউনিতে এমন একটি মহাকাশযান দেখেছেন যা কোনোভাবেই এই পৃথিবীতে তৈরি করা সম্ভব নয়। তিনি দাবি করেন এটি একটি সসার এবং ভিনগ্রহে তৈরি কোন ইউএফও (Unidentified Flying Object)। সেগুলোর শক্তি সরবরাহ করা হচ্ছিলো এন্টিম্যাটার রিঅ্যাক্টরের মাধ্যমে, জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিলো লালচে-কমলা বর্ণের একটি পদার্থ যার নাম ‘এলিমেন্ট-১১৫’। সসারটি এতটাই শক্তিশালী গ্র্যাভিটি ওয়েভ তৈরি করছিলো যে, সেটার উদ্দেশ্যে কোনো গলফ বল ছুঁড়ে মারলে সেটাও ফিরে আসছিলো!
লাজার দাবি করেন এলিয়েনদের সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে সামরিক খাতে এমনসব সসার তৈরি করছে। দুর্ভাগ্যবশত বন্ধুদের নিয়ে একবার সসার দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে যান লাজার। ফলে তার চাকরি চলে যায়।
এলিয়েনদের আটকে রাখা হয়েছে এখানে
এলিয়েন হচ্ছে ভিনগ্রহের প্রাণী। ষড়যন্ত্রে তত্ত্বে বিশ্বাসীদের আরেকটি প্রধান দাবি হলো এরিয়া ৫১ এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিনগ্রহের প্রাণীদের ধরে নিয়ে এসে আটকে রেখেছে। আর এই এলিয়েনদের নাকি জেলখানার কয়েদির মতোই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এমনটাই দাবি করেছেন ঐ ইউএফও তত্ত্বের প্রবক্তা বব লাজার। তিনি নাকি অসংখ্যবার এলিয়েনদের সাথে দেখাও পেয়েছেন।
লাজার দাবি করেন তিনি যখন এস-৪ প্রকল্পের একটি হল ঘরের রুম ধরে যাচ্ছিলেন তখন পাশের একটি ঘরের ছোট জানালা দিয়ে সামান্য সময়ের জন্য উঁকি দেন। তখন ঘরের ভেতরে ছোট, ধূসর বর্ণের একটি প্রাণীকে সাদা কোট পরিহিত দুজন মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন তিনি! পরে অবশ্য তার পেছনে আসা প্রহরীর ঝাড়ি খেয়ে বেচারা সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। এমন দাবি লাজার একাই করেননি। ১৯৯৭ সালে এই একই দাবি করেছিলেন ভিক্টর নামে আরেকজন ব্যক্তি। তিনিও এরিয়া ৫১ এর মধ্যে একটি প্রকল্পে কাজ করেছিলেন।
তিনিও এলিয়েনদের জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারটি দেখেছিলেন বলে জানান। এমনকি তিনি একটি ঝাপসা ভিডিও করেছিলেন যেখানে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর হাতে গুলি খাওয়া এক বহির্জাগতিক পাইলটের সাথে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছেন এরিয়া ৫১ এর একজন অফিসার।
নীল আর্মস্ট্রংয়ের চাঁদে অবতরণ একটি সাজানো নাটক
ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিশ্বাসীদের আরেকটি জনপ্রিয় দাবী হলো নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পৌঁছাননি। অ্যাপোলো-১১ দিয়ে চাঁদে অবতরণের ঘটনাটি স্রেফ ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই না! এই ধারণার সবচেয়ে বড় প্রবক্তা হলেন লেখক বিল কেসিং। ১৮৭৪ সালে তিনি তার We Never Went To The Moon: America’s Thirty Billion Dollar Swindle বইয়ে এই তথ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন।
এই বইয়ে তিনি বিভিন্ন ভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে নীল আর্মস্ট্রং কোনভাবেই চাঁদে পা রাখেননি। বরং তিনি পৌঁছেছিলেন নেভাডা স্টেটের এরিয়া ৫১ এর মাটিতে। তার মতে, ষাটের দশকের শেষের দিকে নাসার বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে, তীব্র তেজষ্ক্রিয়তার জন্য চাঁদের বুকে অবতরণ করা কোনো মানুষ আর বেঁচে ফিরতে পারবে না! কিন্তু এতদিন ধরে চালানো এই প্রোগ্রামও বাতিল করা সম্ভব ছিলো না। তাই তারা আশ্রয় নেয় ইতিহাসের অন্যতম সেরা জালিয়াতির!
এজন্য অ্যাপোলো-১১ জনগণের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাওয়ার পরই গোপন একটি মিলিটারি এয়ারক্রাফটে করে ক্রুদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো পূর্বপ্রস্তুত একটি মুভি স্টেজে! এর কিছুদিন পরে সেখানেই স্থাপন করা সব ক্যামেরার সামনে অভিনয় করেন নীল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন। এরপর সেই ভিডিওই বিশ্বজুড়ে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয় নাসার পক্ষ থেকে।
মাটির তলায় ৪০ তলা বাঙ্কার
এরিয়া ৫১ এর রহস্য এবং গোপনীয়তার কারণেই বিভিন্ন সময় কল্পকাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে। যেহেতু এরিয়া ৫১ সম্পর্কে তথ্য একেবারেই কম, তাই এই কাহিনীগুলোও হালে বাতাস পেয়েছে।
কন্সপিরেসি তত্ত্বে বিশ্বাসীদের আরেকটি মতামত হলো এরিয়া ৫১ এর মাটির নিচে বিশাল বাঙ্কার গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। আর সেখানেও রয়েছে প্রযুক্তির অত্যাধুনিক আশীর্বাদপুষ্ট বিমানের আনাগোনা। সেই বিমানগুলোকে সেখানে লুকিয়ে রাখা হয় যাতে করে স্যাটেলাইটের মাধ্যমেও সেগুলোর কোনো হদিস কেউ না পায়। কারো মতে সেই বাঙ্কারগুলো ৪০ তলা ভবনের সমান উঁচু!
টাইম মেশিন আবিষ্কার করেছে যুক্তরাষ্ট্র
‘টাইম মেশিন’ এর কথা আমরা কমবেশি সবাই শুনেছি। এটি এমন একটি কাল্পনিক যন্ত্র যার মাধ্যমে মানুষ সময় পরিভ্রমণ করতে পারে। অর্থাৎ চাইলে অতীতে চলে যেতে পারে, আবার ভবিষ্যতেও চলে যেতে পারে। এটা শুধুই বৈজ্ঞানিক কল্পনা, বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব নেই। যা শুধু সায়েন্স ফিকশন মুভিতেই মানায় তবে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীরা যেন একে বাস্তব বানিয়েই ছাড়বেন।
আবহাওয়া পরিবর্তনের পরীক্ষানিরীক্ষা
আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের তথ্য মোতাবেক, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মেঘের পরিবর্তন করে বৃষ্টিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিনা তা নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছিলো। আবার ১৯৬২ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ন্যাশনাল ওশানিক এন্ড অ্যাটমস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ কমানোর জন্য কাজ করেছিলো, যদিও তাদের সেই গবেষণা ততটা ফলপ্রসূ হয়নি। এ থেকেই অনেকে ধারণা করে থাকে যে, আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য এমন বিভিন্ন পরীক্ষাও চলে এরিয়া ৫১ এ।
এরিয়া ৫১ একটি রহস্যের নাম। দশকের পর দশক ধরে এই স্থানের রহস্য আজও ভেদ করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সমরাস্ত্র এবং প্রযুক্তিগত কাজগুলো এখানে সম্পাদন করা হয়। যার কারণে এখানে এত বেশী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়েছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য রকমের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার কারণেই বারবার জন্ম দিয়েছে অসংখ্য কল্পকাহিনীর। তবে সত্য কি মিথ্যা তা যাচাই করার জন্য বাহ্যিক তথ্য খুবই কম।
This is a bengali article. It is described in mysterious ‘area 51’
All the references are hyperlinked within the article.
Featured Image: the independent