গত ৭ই ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেল ‘কাগজ‘। মুভিটির পরিচালক সতীশ কৌশিক এবং প্রযোজক হিসেবে ছিলেন সালমান খান এবং নিশান্ত কৌশিক।
কাগজ একটি বায়োগ্রাফিক্যাল মুভি যেটির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে লাল বিহারী নামক এক ব্যান্ড মালিককে ঘিরে। যিনি তাঁর ব্যান্ডের দোকানের সম্প্রসারণের জন্য ব্যাংকে যান ঋণ নিতে।
ঋণ নেওয়ার শর্ত হিসেবে ব্যাংক থেকে জানানো হয় যে সিকিউরিটি হিসেবে তাঁকে কিছু জমা রাখতে হবে। লাল বিহারীর বাবার সম্পত্তি ছিলো। তিনি বলেন সেটাই জমা রাখবেন। কিন্তু যখন তিনি সম্পত্তির দস্তাবেজের জন্য বাড়িতে যান, তখন দেখেন সরকারী অফিসে ঘুষ দিয়ে তার চাচার পরিবার তাঁকে মৃত ঘোষণা করেছে এবং তার সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে। এরপরই শুরু হয় লাল বিহারীর সংগ্রাম, এই সংগ্রাম সিস্টেমের বিরুদ্ধে একজন সাধারণ মানুষের। যে সরকারীভাবে স্বীকৃতি পেতে চায় যে সে বেঁচে আছে। সিস্টেমের বিরুদ্ধে লাল বিহারীর সংগ্রামের ব্যাপারটিকে সতীশ কৌশিক তুলে ধরেছেন স্যাটায়ারিকভাবে। পদে পদে লাল বিহারী যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন, তার সাথে মানুষের যে আচরণ এবং তাদের আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যেমন আচরণ করেন; তাতে দর্শকরা পেয়ে যাবেন হাসির খোরাক।
পরিচালনার পাশাপাশি মুভিটির কাহিনীকারও সতীশ কৌশিক, অভিনয়ও করেছেন একটি চরিত্রে৷ এছাড়াও অভিনয়ে আছেন পঙ্কজ ত্রিপাঠী, মোনাল গাজ্জার, আমাল উপাধ্যায়, নেহা চৌহান এবং মিতা বশিষ্ঠ। সংগীত পরিচালনা করেছেন প্রবেশ মল্লিক এবং রাহুল জৈন। কিছু কবিতাংশের আবৃত্তি রয়েছে সিনেমায়৷ যেগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন সালমান খান।
১ ঘন্টা ৩৯ মিনিটের সিনেমাটি উপভোগ করা যাবে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম জিফাইভ এ। আর কিছু না হলেও পঙ্কজ ত্রিপাঠীর অনবদ্য পার্ফম্যান্সের জন্য দেখে নিতে পারেন এটি। যদি কেবল মুভি রিভিউ লিখতে বসতাম তবে এখানেই এই লেখা শেষ হয়ে যেত। কিন্তু আজকে লিখতে বসেছি লাল বিহারী আর তাঁর উত্তর প্রদেশ মৃত সংঘ সম্পর্কে। মুভিতে অনেক অংশই দৃশ্যায়নের জন্য কল্পিত রুপ দেওয়া হয়েছে। বাস্তবের লাল বিহারী ছিলেন একজন কৃষক। চলুন জেনে নিই লাল বিহারী এবং তাঁর সহচর জীবন্মৃতদের সংগ্রাম সম্পর্কে।
১৯৭৬ সালের কোন একদিন ২১ বছর বয়সী লাল বিহারী গেলেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে যে খবর শুনলেন, তাতে এই কৃষকের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।ঘটনা এমন না যে তার ঋণের আবেদন খারিজ হয়ে গেছে। ব্যাংকে গিয়ে তিনি জানতে পারলেন যে তিনি ইতোমধ্যেই মারা গিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তার নামে ডেথ সার্টিফিকেটও ইস্যু হয়ে গেছে। কিন্তু লাল বিহারীর মধ্যে কোন মৃত মানুষের লক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো না৷ উত্তর প্রদেশের এই কৃষক কোন জম্বিও নন। কিন্তু কেন তাকে মৃত ঘোষণা করে হয়েছে এই ভেবে হয়রান হয়ে গেল সবাই। লাল বিহারী এই রহস্যের সমাধানের উদ্দেশ্যে নেমে পড়লেন কোমর বেঁধে।
এই ব্যাপারে অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে জানতে পারলেন যে অফিসিয়ালভাবে তাঁর এই যে মরে যাওয়া, এটি কোন ভুলের কারণে হয় নি৷ বরং তাঁর এই ‘মরে’ যাওয়া একটি চক্রান্ত বা প্রতারণার অংশ।
মূল ঘটনাটি এমন : লাল বিহারীর চাচা তাঁর চাষের জমি দখলে নেওয়ার জন্য সরকারীভাবে মৃত ঘোষণা করেছেন একজন সরকারী কর্মচারীকে ঘুষ দিয়ে। মাত্র ৩০০ রুপির বিনিময়ে অফিসিয়ালি তাঁকে মেরে ফেলেছেন তাঁর চাচা। এছাড়া স্থানীয় ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসারকেও ঘুষ দেন তাঁর চাচা। সরকারীভাবে মৃত হওয়ার কারণে জমিজিরাতে লাল বিহারীর আর কোন দাবী থাকলো না। ফলে ১ একরের পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেন লাল বিহারী।
এই অবস্থায় লাল বিহারী দৃঢ় সংকল্প করলেন তিনি যে বেঁচে আছেন সেটির সরকারী স্বীকৃতি আদায় করে তবেই ছাড়বেন। এরই সাথে সাথে শুরু হলো লাল বিহারীর সংগ্রামের। তিনি বিভিন্ন জনের কাছে গেলেন, তাদের কাছ থেকে নানা ধরনের পরামর্শ নিলেন। সরকারী এই অফিস, ঐ অফিসে ধরনা দিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। বিভিন্ন অফিসে গিয়ে ব্যর্থতার পাশাপাশি তাঁর কপালে জুটছিলো বকাঝকা আর উপহাস। সরকারী দপ্তরে তাঁর সশরীরে উপস্থিত হওয়াটা সরকারীভাবে তাঁর জীবিত থাকার প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট নয়। একটা সময় তিনি নিজেকে জীবিত প্রমাণের এই লড়াইয়ে বসতবাড়ীও হারান। কিন্তু লাল বিহারীও দমে যাওয়ার পাত্র নন। একবার যে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন, তাতেই অটল থাকবেন তিনি। সরকারকে স্বীকার করে নিতেই হবে যে তিনি এখনো জীবিত।
সংগ্রামের এক পর্যায়ে গিয়ে লাল বিহারী দেখেন জীবিত মানুষকে কাগজপত্রে মেরে ফেলার এই যে প্রতারণা, তার শিকার কেবল তিনি একাই নন। পুরো উত্তর প্রদেশজুড়েই এমন অসংখ্য মানুষ আছেন যাদেরকে তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরা মেরে ফেলেছেন সম্পত্তি দখলের লোভে। সম্পত্তি দখলের পাশাপাশি এইসব অফিসিয়ালি মৃত মানুষদেরকে প্রতিনিয়ত চক্রান্তকারীদের হুমকি-ধমকির মুখোমুখিও হতে হতো। এমনকি সত্যি সত্যি মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হতো। মহা প্রসাদ নামে ৬ বছর ধরে পুলিশ কনস্টেবলের দায়িত্ব পালন করছেন এক ব্যক্তিকেও কাগজপত্রে মৃত ঘোষণা করা হয়। মোট কথা, চক্রান্তকারীদের হাত থেকে কেউই নিরাপদ ছিলেন না। তিনি এদের সবাইকে একত্র করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফলশ্রুতিতে জন্ম নিলো ‘উত্তর প্রদেশ মৃত সংঘ‘।
এই রাজনৈতিক দল বা প্রেশার গ্রুপের লক্ষ্য ছিলো অফিসিয়ালি মৃত লোকদের জীবিত করার জন্য সরকারকে বাধ্য করা। এক পর্যায়ে গিয়ে লাল বিহারী নিজের নামের সাথে ‘মৃতক’ (মৃত) শব্দটি জুড়ে নেন। নিজেকে জীবিত প্রমাণের জন্য লাল বিহারীর পন্থাগুলো ছিলো অভিনব এবং বুদ্ধিদীপ্ত।
মৃত সংঘ গঠনের পূর্বে লাল বিহারী তাঁর চাচার ছেলেকে অপহরণ করেন, মারামারিতে জড়ান, স্ত্রীকে বিধবা ভাতা নেয়ার জন্য পাঠান, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে অপমান করেন, পুলিশ এমনকি বিচারককেও অপমান করেন। এইসব কিছুর পেছনে উদ্দেশ্য ছিলো একটাই, এসব কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে যেন গ্রেফতার করা হয় এবং এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়ে যাবে যে তিনি জীবিত। এমনকি তিনি সংসদে গিয়ে মন্ত্রীদের গালমন্দ করেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে লিফলেট ছুঁড়ে মারেন। কিন্তু তার কোন পরিকল্পনাই কাজে আসে না। তাকে গ্রেফতার করা হয় না। বরং এসব কর্মকাণ্ডের জন্য পুলিশের প্রহার সহ্য করতে হয়।
মৃত সংঘের কার্যক্রমও ছিলো বেশ অভিনব। সংঘ থেকে গণসৎকারের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এই সৎকারের জন্য যাদেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তাদের সবাই ছিলেন জীবিত। এছাড়াও পুরো উত্তর প্রদেশজুড়ে এই সংঘের আয়োজনে মিটিং, মিছিল, সভা করা হয়। এসব কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ছিলো এই সংঘ এবং অফিশিয়ালি ‘মৃত’দের দিকে জনগণ, সরকার এবং মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এই উত্তর প্রদেশ মৃত সংঘের সদস্য সংখ্যা কত ছিলো তা সঠিকভাবে জানা যায় না। কারো কারো মতে ১০,০০০; আবার কারো কারো মতে ২০,০০০। তবে মিডিয়ার কল্যাণে লাল বিহারী এবং তাঁর মৃত সংঘ বিদেশেও আলোচিত হয়। বেঁচে থাকার স্বীকৃতির আদায়ের জন্য লাল বিহারী সাধারণ নির্বাচনেও লড়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রাজীব গান্ধী এবং বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং।
অবশেষে ১৯৯৪ সালে লাল বিহারীর নিজেকে জীবিত প্রমাণের ১৮ বছরের সুদীর্ঘ সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটে। এবছর তাঁর জেলা আজমগড়ের ম্যাজিস্ট্রেট হসলা প্রসাদ ভার্মা তাঁকে জীবিত বলে স্বীকৃতি দেন এবং তাঁর ডেথ সার্টিফিকেট বাতিল করে দেন।
যে জমির দখল নিয়ে এত সমস্যা, সেই জমি কিন্তু লাল বিহারী দখল করেন নি। তাঁর চাচাকে তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং নিজের জমিটিও তাকে দিয়ে দিয়েছেন।
নিজে বেঁচে থাকার স্বীকৃতি পেয়ে গেলেও এখনো এমন অফিসিয়ালি মৃতদের জীবিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন লাল বিহারী। পাশাপাশি সমাজের উন্নয়নেও অবদান রাখার চেষ্টা করছেন। বাচ্চাদের শিক্ষার সুব্যবস্থা করার জন্য স্কুল স্থাপন করেছেন। ২০০৩ সালে আরো একবার নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এছাড়া মৃত সংঘের কেউ নির্বাচনে লড়তে গেলে তাঁদেরকেও সহায়তা করেন তিনি।
১৯৯৯ সালে তিনি একবার জানিয়েছিলেন, কোন ফান্ড ছাড়া কিভাবে মৃত সংঘ এতদূর এলো তা তিনি জানেন না। ২০০৩ সালে তিনি শান্তিতে ইগ নোবেল পুরষ্কার পান। এটি নোবেল পুরষ্কারের একটি প্যারোডি ভার্সন৷ কর্তৃপক্ষ মজা করে বলেছিলো লাল বিহারীর ‘মরণোত্তর’ কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে এই পুরষ্কার প্রদান করা হয়েছে।
আরো পড়ুনঃ
জহির রায়হানের প্রথম ছবি সম্পর্কে জানতে পড়ুন
কখনো আসেনি (১৯৬১) : পরিচালনায় জহির রায়হান নামক জিনিয়াসের আবির্ভাব
আলফ্রেড হিচককের অ-হিচককীয় “দ্যা বার্ডস”
দ্যা বার্ডস (১৯৬৩) : আলফ্রেড হিচককের অ-হিচককীয় সিনেমা
This is a Bangla Article. Here, everything is written about “The Kaagaz Movie”.
All links are hyperlinked.
The featured image is taken from Google