শুভ্র আর সাদা বরফে আচ্ছাদিত হিমালয় পর্বতশ্রেণীর দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বতটির নাম কাঞ্চনজঙ্ঘা। উচ্চতা বিবেচনায় মাউন্ট এভারেস্ট এবং কে২ এর পরেই কাঞ্চনজঙ্ঘার অবস্থান। মেঘমুক্ত নীল আকাশে সাদা বরফে আচ্ছাদিত পাহাড়ের চূড়ার এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে কার না মন চায়! তাইতো প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমান ভারত এবং নেপাল সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলে।কাঞ্চনজঙ্ঘা পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। এর উচ্চতা ৮,৫৮৬ মিটার বা ২৮,১৬৯ ফুট। এটি ভারতের সিক্কিম রাজ্যের সঙ্গে নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে অবস্থিত। হিমালয় পৰ্বতের এই অংশটিকে কঞ্চনজঙ্ঘা হিমাল বলা হয়। এর পশ্চিমে তামূর নদী এবং জংসং লা শৃঙ্গ, এবং পূর্বদিকে তিস্তা নদী অবস্থিত। মাউন্ট এভারেস্টের মত কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করাও বেশ দুরূহ কাজ। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্র সাদা রূপ পর্বত আরোহীদের ভুলিয়ে দেয় দুনিয়ার মায়া। তাই প্রতিবছর হাজার হাজার পর্বত আরোহী পৃথিবীর তাবৎ কুৎসিতকে ভুলে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ছুটে আসেন কাঞ্চনজঙ্ঘা জয় করতে। কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করতে যেয়ে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতর বেশি মানুষ জান কুইয়েছেন। আক্ষরিক অর্থে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় আজ পর্যন্ত কেউ পা রাখতে পারেনি বা রাখেনি। অবশ্য এর একটি ব্যাখ্যা আছে।
নেপাল আর সিকিমের অনেক মানুষ এই পর্বতকে পূজা করে। প্রথম এর চূড়ায় যে দলটি পদার্পণ করে, তারা সিক্কিমের রাজা এবং ধর্মগুরুকে কথা দিয়ে এসেছিল যে, কাঞ্চনজঙ্ঘার সর্বোচ্চ চূড়ায় কেউ পা রাখবে না। সেই থেকে এ পর্যন্ত সকল অভিযাত্রী দল এই নিয়মটি মেনে এসেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার নিচে বাস করা লেপচারা বিশ্বাস করে, এই পর্বতে ইয়েতি থাকে। অমরত্বের রহস্যও নাকি এর শ্বেতশুভ্র শৃঙ্গের নীচে লুকানো আছে। ১৮৫২ সালের আগপর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘাই পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ বলে পরিচিত ছিল।
স্বাভাবিকভাবেই আমরা জানি যে হিমালয় পর্বতশ্রেণীতে শীতকালে আরোহণ করা সবচেয়ে দুরুহ এবং বিপদজনক কাজ। সেজন্য গ্রীষ্মকালে কিংবা বছরের অন্যান্য সময় যখন বরফের পরিমাণ কম থাকে তখন পর্বতশৃঙ্গ আরোহন করা হয়ে থাকে। ২৫শে, মে ১৯৫৫ সালে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ অভিযাত্রী জো ব্রাউন এবং জর্জ ব্যান্ড কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় আরোহণ করতে সক্ষম হন। তবে এটা শীতকালীন আরোহণ ছিল না। ১৯৮৬ সালের ১১ই জানুয়ারি সর্ব প্রথম শীতকালীন আরোহন সম্পন্ন করেন ব্রিটিশ পর্বত আরোহী জের্জি কুকুচজকা এবং ক্ৰিজটোভ উয়িলিকি।
কাঞ্চনজঙ্ঘা মাউন্ট এভারেস্টের ১২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এর পাঁচটি মূল শৃঙ্গের মধ্যে তিনটা–মুখ্য, কেন্দ্ৰীয় এবং দক্ষিণ- ভারতের উত্তর সিক্কিম জেলায়, এবং নেপাল সীমান্তে অবস্থিত। বাকী দুটি শৃঙ্গ নেপালের তাপ্লেজুং জেলায় অবস্থিত। কাঞ্চনজঙ্ঘা-মুখ্য ভারতের সৰ্বোচ্চ শৃঙ্গ। পাঁচটি পর্বতচূড়ার কারণে একে “তুষারের পাঁচটি ঐশ্বৰ্য” বলা হয়। সিক্কিম এবং দার্জিলিংয়ের স্থানীয় লোকেরা একে পবিত্র মনে করে পূজা করে।।
১৮৫২ সালের আগ পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘাকে পৃথিবীর সৰ্বোচ্চ শৃঙ্গ বলে ধারণা করা হত, কিন্তু ১৮৪৯ সালে ভারতের বৃহৎ ত্রিকোণমিত্রিক জরীপে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল যে মাউন্ট এভারেস্টই হচ্ছে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। আরো কিছু পুনঃনিরীক্ষণ করার পর ১৮৫৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় যে কাঞ্চনজঙ্ঘা পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। এ কাজে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছিলেন ভারতের কালজয়ী গণিতবিদ রাধানাথ শিকদার।
বাংলাদেশ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা
শরতের শেষ সময়ে সচরাচর আকাশে মেঘের আনাগোনা থাকেনা। তাছাড়া শিশির ভেজা হেমন্তের শুরুতে কুয়াশারও খুব একটা প্রকোপ দেখা যায় না। সে কারণে আকাশ থাকে নির্মল এবং স্বচ্ছ। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর করোনা মহামারীর কারণে প্রকৃতি একটু বেশিই নির্মল। যার কারণে দূরের সৌন্দর্যকে এবার একটু বেশি স্পষ্টরূপে দেখা গিয়েছে।
কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম ভাবে ফুটে ওঠে। যেমন সকালের দিকে তুষারধবল পর্বতকে নীল আকাশে মেঘমালার মত ভেসে থাকতে দেখা যায়। বেলা বাড়তে থাকলে কিছুটা ঝাপসা হয়ে ওঠে। আবার শেষ বিকেলে সূর্যকিরণ যখন তির্যক হয়ে পড়ে তখন অপূর্ব মহিমায় অন্যরূপে ধরা দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। রক্তিম দ্যুতি ছড়ানো তুষারধবল পর্বতকে তখন ওপারের স্বর্গ বলে মনে হয়। পর্বতশৃঙ্গটি পর্যটকদের অবাক করতে থাকে তার দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যে।
কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখতে সারাবিশ্ব থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ভারতের দার্জিলিংয়ের টাইগার হিলে ছুটে যান। ভোরে ঊষার সময় কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর রোদ পড়ে সেই রোদ যেন ঠিকরে পড়ে পর্যটকের চোখে। দার্জিলিং-এর টাইগার হিলই কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখার জন্য সবচেয়ে আদর্শ জায়গা। কিন্তু যদি পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই সেই দৃশ্য দেখতে পারেন তবে কেমন হয়? হ্যাঁ এমন সুযোগই রয়েছে।
পঞ্চগড়ে হালকা এই শীতের সময়ই কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য দর্শনের সবচেয়ে ভালো সময়। এখন অনেক পর্যটক পঞ্চগড়ে ছুটে আসছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে। এ বছর আকাশ বেশি নির্মল হওয়ায় তেতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার তলদেশের শহরের ঘরবাড়ি এবং গাড়ীর লাইটের আলোও প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব মাত্র ১২২ কিলোমিটার।
এই বছরে শুধু পঞ্চগড়ই নয়, নীলফামারী ও ঠাকুরগাঁও জেলার কয়েকটি এলাকা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গিয়েছে। এসব জেলা থেকে এর আগে এই পর্বতশৃঙ্গটি দেখা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। বিবিসির একটি প্রতিবেদনে এমনটাই জানানো হয়েছে। তেতুলিয়া আবহাওয়া কর্মকর্তা জানান-
বছরের এই সময়ে বৃষ্টি হওয়ায় আর বাতাসে ধুলা, মেঘ-কুয়াশামুক্ত থাকায় অনেক দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। অন্য বছরেও এই সময়ে এখান থেকে এই পর্বত দেখা যায়। তবে এই বছরে আবহাওয়া বেশি পরিষ্কার থাকার কারণে অনেক ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে।
This is a Bengali article. It is written about Kanchenjunga, the third highest mountain peak in the world.