সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প সমর্থকরা কংগ্রেস ভবন এবং ক্যাপিটল হলে ভারী অস্ত্র হতে যে নজিরবিহীন হামলা চালিয়ে তা মার্কিন ইতিহাসে বিরল হলেও একেবারেই নতুন নয়। তবে এবারের মতো একে-৪৭, এম-১৬, এআর-১৫ এর মতো আধুনিক অস্ত্রহাতে কংগ্রেস ভবনে গোলাগুলির ঘটনা ইতিপূর্বে এতটা বিপর্যয় সৃষ্টি করেনি। পাঠক, শিরোনাম দেখেই নিশ্চয় অনুধাবন করতে পেরেছেন আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে। হ্যাঁ, আজকে আমরা আলোচনা করব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এপর্যন্ত যতবার কংগ্রেস ভবনে হামলা হয়ে সেই সম্পর্কে। তার আগে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব ‘কিউএ্যানন’ নামে একদল কন্সপিরেসি থিওরিষ্ট বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীদের সাথে।
কিউএ্যানন কারা?
এই যে দেখুন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে যে ভয়ঙ্কর হামলা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ছে এর পেছনেও দায়ী গুজব। তাও সাধারণ মানের গুজব নয়, একেবারে অতিমানবীয় প্রকৃতির গুজব। এই গুজব সৃষ্টিকারীরা এক ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, তাই এদেরকে বলা হয় ‘কিউএ্যানন’ কন্সপিরেসি থিওরিষ্ট।
এটাই মূল গল্প, তবে এর বহু শাখাপ্রশাখা রয়েছে, এবং এর সাথে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গল্প যোগ হচ্ছে। প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন নতুন গুজব। এসব উদ্ভট গল্পে বিশ্বাস করে হাজার হাজার লোক। তাদের বিশ্বাস একদিন হিলারি ক্লিনটনের মত কিছু বিখ্যাত লোককে এসব অভিযোগে গ্রেফতার করে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।
তারা মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির এলিট শ্রেণীর নেতারা শিশু পাচারের একটা চক্র পরিচালনা করছেন। ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেনের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে শিশু নিপীড়নের অভিযোগ। তারা বিশ্বাস করেন জো বাইডেন একজন পিডোফাইল বা শিশুকামী।
কিউএ্যানন এর সদস্যারা বিশ্বাস করেন এখন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র রক্ষাকর্তা ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিভিন্ন পোস্টে দাবি করা হচ্ছে – ওই সব শিশু পাচারকারীদের হাত থেকে আমেরিকাকে রক্ষা করতে পারেন একমাত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিউএ্যানন হচ্ছে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। বিবিসির এক জরিপে দেখা গেছে, ফেসবুকে এ নিয়ে মন্তব্য, শেয়ার এবং লাইক হয়েছে ১০ কোটিরও বেশি।
ফেসবুকে সবচেয়ে বড় কিউএ্যানন গ্রুপটির লাইক, কমেন্ট ও শেয়ারের সংখ্যা ৪ কোটি ৪০ লাখ। তুলনা করে দেখা যায়, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের মতো বিশ্বব্যাপি সাড়া তোলা আন্দোলনের যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, কিউএ্যাননের প্রতিক্রিয়া তার প্রায় দু-তৃতীয়াংশ।
সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলো শুরুতে এটা ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু সমর্থকরা নানা কৌশলে, নতুন নতুন হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে আবার ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম আর টুইটারের সাধারণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আর এই গুজব জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ায় মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ এই আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি অসংখ্য কিউএ্যানন সদস্যদের উদ্ভট বেশভূষায় অস্ত্র হাতে কংগ্রেস ভবনে হামলা করতে দেখা গেছে।
কংগ্রেস ভবনে হামলার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। ইতিপূর্বেও বেশ কয়েকবার এমন হামলা সংঘটিত হয়েছে। নিচে কয়েকটি হামলার বর্ণনা দেয়া হলো।
১৮১৪ সালের হামলা
সমুদ্র বাণিজ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ১৮১২ সালে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ইউএস ক্যাপিটল হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির পরিচালক স্যামুয়েল হলিডে বলেন, এরকম অ-সংগঠিত না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের ওপর ২০০ বছর আগেও একবার হামলা চালানো হয়েছিল।
ব্রিটিশদের সাথে আমেরিকানদের যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ব্রিটিশরা আমেরিকানদের ধরাশায়ী করে ফেলে। ১৮১৪ সালে ব্রিটিশ বাহিনী ওয়াশিংটন ডিসির প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেদ করে এবং এবং অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে শহরে প্রবেশ করতে থাকে। তারা ক্যাপিটল ভবন ও অন্যান্য কিছু ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। অ্যামেরিকানদের চোখের সামনেই পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয় কংগ্রেস ভবন। ক্যাপিটাল হিল এবং কংগ্রেস ভুবনে তুমুল ভাঙচুরও চালানো হয়।
১৯১৫ সালের হামলা
প্রথম হামলার পর দ্বিতীয় হামলাটি ঘটে প্রায় ১০০ বছর পরে। ১৯১৫ সালের ২রা জুলাই মধ্যরাতের কিছু আগে সেনেট রিসেপশন চেম্বারে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এতে কেউ হতাহত হয়নি। তবে ভবনের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মান বিভাগের একজন সাবেক অধ্যাপক এরিখ মেনটার ডায়নামাইট ব্যবহার করে এই বিস্ফোরণ ঘটান। তিনি লিখেছিলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঝংকারের বিরুদ্ধে তিনি এই কাজ করেছেন, “যাতে শান্তির বাণী যুদ্ধে নিনাদকেও ছাপিয়ে ওঠে।” গ্রেফতারের কিছুদিন পর কারাগারের মধ্যেই এরিখ মেনটার আত্মহত্যা করেন। ধারণা করা হয় জার্মানদের সাথে তার আঁতাত ছিল।
গত এক শতাব্দী ধরেই পুয়ের্তো রিকো শাসন করছে মার্কিনীরা। যুগে যুগে পুয়ের্তো রিকো স্বাধীনতার জন্য অনেক আন্দোলন করেছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ফল না পাওয়ায় কিছু দল বেছে নিয়েছে বিচ্ছিন্নতার পথ।
১৯৫৪ সালের ১লা মার্চ মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড পুয়ের্তো রিকোর স্বাধীনতাকামীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কংগ্রেসের নিম্ন কক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের গ্যালারিতে ঢুকে পড়ে। হাউস হিস্ট্রি ওয়েবসাইটের খবর অনুযায়ী, পুয়ের্তোরিকান ন্যাশনালিস্ট পার্টির সদস্যরা “কংগ্রেস কক্ষ লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায় এবং গ্যালারিতে পুয়োর্তোরিকোর পতাকা উড়িয়ে দেয়।” পুড়িয়ে ফেলে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা।
ঐ ঘটনায় পাঁচজন কংগ্রেস সদস্য – অ্যালভিন বেন্টলি, বেন জেনসেন, ক্লিফোর্ড ডেভিস, জর্জ ফ্যালন এবং কেনেথ রবার্টস আহত হন। সংসদের কর্মকর্তারা হামলাকারী চারজনকে আটক করেন এবং বাকি একজন পালিয়ে গেলেও পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৭১ সালের হামলা
১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হলে বোমা হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় ভবনটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেউ হতাহত হয়নি। ওই হামলার মূল বিষয়বস্তু ছিল লাওসে মার্কিন সমর্থিত অভিযান।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ লাওসে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরো বেশ কিছু দেশ মিলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে। এর ফলে সেখানে কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে খোদে আমেরিকার মাটিতে কংগ্রেস ভবনে হামলা চালিয়ে তার প্রতিশোধ গ্রহণ করে তারা। ‘দ্য ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড’নামের একটি সশস্ত্র সংগঠন ওই হামলার দায় স্বীকার করে।
এই হামলার ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৩ সালের ৭ই নভেম্বর। রাত প্রায় ১১টার দিকে ক্যাপিটল ভবনের উত্তর শাখার তিন তলায় এক বিস্ফোরণে ব্যাপক ক্ষতি হয়। এতে কেউ হতাহত হয়নি। এই বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ আগে এক ব্যক্তি ক্যাপিটলের টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ফোন করে এই বোমার কথা জানায়। সে নিজেকে ‘সশস্ত্র প্রতিরক্ষা ইউনিট’ নামে এক গোপন সংগঠনের সদস্য বলে দাবি করে। গ্রেনাডা এবং লেবাননে মার্কিন অভিযানের প্রতিশোধ হিসেবে এই হামলা চালানো হয়েছে বলে ঐ ব্যক্তি জানায়।
১৯৯৮ সালের হামলা
সংসদ ভবনের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে যাওয়ার সময় এক সশস্ত্র হামলাকারীর গুলিতে ক্যাপিটল পুলিশের দুজন কর্মকর্তা – অফিসার জেকব চেস্টনাট এবং ডিটেকটিভ জন গিবসন – নিহত হন। হামলাকারী রাসেল ইউজিন ওয়েস্টনকে আটক করা হলেও মানসিক ভারসাম্যহীনতার জন্য তার বিচার করা যায়নি।
This is a bengali article. It’s about ‘Qanon’ and history of attack on the us congress building