প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ তার অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে অজানাকে জানার আশায়, নিত্যনতুন আবিষ্কারের নেশায় কত কিছুই না আবিষ্কার করছে। পাখিরা মুক্ত মনে আকাশে উড়ে ছুটে যায় ডানা মেলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। মানুষের কৌতূহলী মন ও আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখতে লাগলাে। তারপর নানা চড়াই উতরাই পার করে মানুষ উড়ােজাহাজ আবিষ্কার করলাে। কিন্তু স্রষ্টার সৃষ্টি এই পৃথিবীর সবকিছুই মানব জাতিকে মুগ্ধ করে। সুন্দর সব জিনিসগুলাে মানুষ আরাে কাছ থেকে দেখতে চায়।
উত্তাল জলরাশি যেদিক চোখ যায় স্বচ্ছ নীল জলের রাজত্ব। কখনাে খরস্রোতা, কখনাে শান্ত নিস্তব্ধ আবারএর ভেতরেই আছে প্রাণের অস্তিত্ব। আজানা গভীর এই জলরাশিতে এরা সাঁতরে বেড়ায়। মানুষের মনে ইচ্ছার বীজ বপন হলাে ডুব দেবে। এই গভীর জলে ভেসে বেড়াবে বিস্তীর্ণ এই জলরাশির ওপর জানবে এর গভীরতা। জানবে এর ভেতর লুকিয়ে থাকা অজানা সবরহস্য। মানব মনের ইচ্ছার বীজ সময়ের পালা বদলে বট বৃক্ষে পরিণত হলাে। মানুষ ছােট ডিঙ্গি নৌকা থেকে শুরু করে সুবিশাল জাহাজ তৈরি করলাে, ক্ষুদ্র ডুবােযান থেকে আবিষ্কার করলাে দৈত্যাকার নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিন।
আজ আমরা এই সাবমেরিন সম্পর্কে একটু জানার চেষ্টা করবাে। কেমন ছিল আজকের আবিষ্কার করা এই নিউক্লিয়ার সাবমেরিনের পথযাত্রা!
সাবমেরিনের ইতিহাস
সাবমেরিনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের আজকের সময় থেকে অনেকটা পেছনে ফিরে দেখতেহবে। ক্ষুদ্রাকৃতি বােটম্যান নামক একটি বাহন এর হাত ধরেই সাবমেরিন এর পথযাত্রা শুরু হয় যার পাশে এরিস্টটল এর নাম উল্লেখ এর পর আসে ড্রেবল নামে একজন ওলন্দাজ বিজ্ঞানীর কথা। যিনি ১৬২০ সালে পানির নিচে বৈঠার সাহায্যে চালানাে যায় এমন একটি সাবমেরিন নির্মাণ করেছিলেন। যা ঐ সময় খুব আলােড়ন সৃষ্টি করে।
এর পর ১৭৭৬ সালে টারটেল বা কচ্ছপ নামে প্রথম যুদ্ধ সাবমেরিন তৈরি করেন ডেভিড বাশনেল নামক একজন আমেরিকান বিজ্ঞানী। তিনি ঘরে বসেই এটি নির্মাণ করেন, যা দেখতে অনেকটা মাছের মতাে। বাহনটি মাত্র একজন ব্যক্তি দ্বারা পানির নিচে নিয়ন্ত্রণ করা হতাে। ভেতরে খুব অল্প পরিমাণ অক্সিজেন সংরক্ষণ করা যেত। এর তলানিতে ফাঁপা বায়ু প্রকোষ্ঠ পানি দ্বারা পূর্ণ করারমাধ্যমে নিমজ্জিত করা হতাে। যদিও এটি তার লক্ষ্য অনুযায়ী কোনাে যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস করতে সক্ষম হয়নি তবুও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই যানটি নিয়ে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং এর উন্নয়নের কাজ শুরু হয়ে যায়।
প্রায় ১০০ বছর পর ১৮৬৪ সালে ক্ষুদ্র আকৃতির সাবমেরিনটি HL HUNLEY নামক একটি কার্যকর বৃহৎ সাবমেরিনে পরিণত হয় যেটি কিনা সর্বপ্রথম কোনাে যুদ্ধ জাহাজ তৈরি ধ্বংস করতে সক্ষম হয় । গবেষকরা সাবমেরিনের আধুনিকায়নের লক্ষ্যে নিরলস পরিশ্রম করতে থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জার্মান বিজ্ঞানীরা U-66 নামে U-BOAT আবিষ্কার করে এবং এর ব্যবহার শুরু করেন। নিয়ন্ত্রণ এর সুবিধার্থে সাবমেরিনটিতে FORE PLENES AND TAIL PLENES এর ব্যবহার করা হয় কিন্তু এতে অধিক পরিমাণে জ্বালানির প্রয়ােজন পড়তাে।
জ্বালানি রিফিলিং এর জন্য সাবমেরিনকে সমুদ্রপৃষ্টে আসতে হত। ফলে খুব সহজে সাবমেরিন শত্রু পক্ষের আক্রমণের শিকার হত। অবশেষে ১৯৪৫ সালে ইঞ্জিনিয়াররা জালানি সমস্যা সমাধান হিসেবে তেজস্ক্রিয় পরমাণু ইউরেনিয়াম আবিষ্কার করেন। তেজস্ক্রিয় পরমাণু ব্যবহারের মাধ্যমে ১৯৫৪ সালে USS NAUTILUS নামক নিউক্লিয়ার সাবমেরিন এর যাত্রা শুরু হয়। অসাধারণ এই সাবমেরিনটি মাত্র ৪ কেজি ইউরেনিয়াম এর সাহায্যে ১০০০ কিলােমিটার পথ পাড়ি দিতে সক্ষম। কোনাে রিফিলিং ছাড়াই মাসের পর মাস সমুদ্রের গভীরে থাকতেপারে।
টর্পেডাে সাবমেরিন এর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র যা দ্বারা শত্রু পক্ষকে অনায়াসে ঘায়েল করা সম্ভব। শুরুর দিকে সাবমেরিনের টর্পেডােগুলাে বাস্প এবং ব্যাটারি চালিত থাকলেও পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে নিউক্লিয়ার মিসাইল সম্পন্ন USS GEORGE WASHINGTON এর পথ চলা। শুরু হয় আগে ও পরে জাপান, জার্মান, ইটালি, রাশিয়া ইত্যাদি দেশগুলাে সাবমেরিন তৈরি করে। তবে বর্তমানে বিশ্বের সেরা সাবমেরিনগুলাে হচ্ছ QHIO CLASS, TYPHON-CLASS, AKHULA CLASS,
SEAWOLF CLASS, BOREI CLASS SUBMARINE ইত্যাদি।
মিলিটারি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন
যুদ্ধ ক্ষেত্রে মিলিটারি সাবমেরিন শত্রুপক্ষের নজর এড়িয়ে সহজে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে পারে যা যুদ্ধের সমীকরণ বদলে দিতে সক্ষম। বর্তমানের আধুনিক সাবমেরিন একবার ডুব দিয়ে প্রায় ২৫ বছর একটানা পানির নিচে অবস্থান করতে সক্ষম। কিন্তু খাদ্য স্বল্পতা এবং মেরামত করার জন্য সাবমেরিনকে পানির উপরেআসতে হয়।
এসব আধুনিক সাবমেরিন এর মিসাইলপাল্লা প্রায় ৫৫০০ কি.মি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। আধুনিকসাবমেরিন এ উন্নত প্রযুক্তির মিসাইল বা টর্পেডােব্যবহার করা হয় যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রিমোটকন্ট্রোল বা প্রােগ্রাম্যাবল টর্পেডো যা কিনা টার্গেট লকসুবিধা সম্পন্ন। এছাড়াও আছে ফাইবার অপটিক্যালমিসাইল, এয়ার প্রেশার ভারটিকাল মিসাইল, মাইন ইত্যাদি সব অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র।
সাবমেরিনে পেরিস্কোপ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবেবর্তমানের আধুনিক সাবমেরিন এ পেরিস্কোপ এর পাশাপাশি সােনার সিস্টেম (sonar system) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সােনার সিস্টেম (sonar system) থেকে রেডিও ওয়েভ প্রেরণ করা হয় । এই রেডিও ওয়েভ আশে পাশে থাকা বস্তুর সংস্পর্শে এসে আবার প্রতিফলিত হয়ে সাবমেরিনের রেডার সিস্টেমে কর্তৃক গৃহীত হয় এবং এই প্রতিফলিত রেডিও ওয়েভ থেকেই বস্তুর আকার আকৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
বর্তমানে বিশাল আকৃতির এসব সাবমেরিন পরিচালনায় অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন সহ কয়েকডজন ক্রু মেম্বার প্রয়ােজন হয়। আর তাদের জন্য প্রয়ােজন হয় পানযােগ্য খাবার পানীয়, বেচে থাকার জন্য অক্সিজেন। আর এই সব কিছুর যােগান দেওয়া হয় সমুদ্রের নােনা জল থেকে। একটি সাবমেরিনে যে পরিমাণ অক্সিজেন থাকে তা মােটামুটি ৭-৮ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়।
প্রতিদিন গড়ে এক এক জন ক্রু মেম্বারের জন্য প্রায় ১২ ঘন মিটার অক্সিজেন প্রয়ােজন হয়। এই বিপুল অক্সিজেন এবং পানির সরবরাহ করা হয় সমুদ্র পানিকে হাইড্রোলাইসিস করার মাধ্যমে। সমুদ্রের পানির মধ্যে বিদ্যুৎ চালনা করার ফলে অক্সিজেন ও হাইড্রজেন আলাদা হয়ে যায়। আর এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়েঅক্সিজেন ও বিশুদ্ধ পানি উৎপন্ন করা হয়।
বর্তমানে এই আধুনিকতার যুগে মিলিটারি সাবমেরিন ছাড়াও আরাে নানা ধরনের সাবমেরিন দেখা যায়। কোনােটি ব্যবহার করা হয় বিনােদনের জন্য। কোনােটি আবার গবেষণার জন্য। নিচে এর কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলােঃ
বামন সাবমেরিন
এইসব সাবমেরিন আকারে অপেক্ষাকৃত ছােট হয়। সাধারণভাবে অন্য জাহাজে বহন যােগ্য, সমুদ্র তলদেশে ছােটখাটো অপারেশনের কাজে এই সাবমেরিন ব্যবহার করা হয়।
ব্যক্তিগত সাবমেরিন
লন্ডনে জন্মগ্রহণকারী গ্রাহাম হােপস নামের একজন প্রকৌশলী ১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম তার ব্যক্তিগত সাবমেরিন তৈরি করেন। এসব সাবমেরিন বিনােদন,গবেষণা ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা।
গভীর সমুদ্র অপারেশনে সাবমেরিন
(DSRV) DEEP SUBMERGENCE RESE VEHICLES সাবমেরিন যদি সমুদ্র তলদেশে কোনাে সমস্যায় পড়ে তখন এইসব সাবমেরিন উদ্ধার কাজ পরিচালনা করে বা সাহায্য প্রেরণ করে।
আরো পড়ুনঃ
মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগিতায় পরাশক্তিগুলো
দূরত্ব মাপতে আলােকবর্ষ কেন প্রয়োজন হলো?
সাবমেরিন এর নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর এর কার্যপদ্ধতি
সাবমেরিন এর গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর যা সাবমেরিন এর জালানি সরবরাহের কেন্দ্রবিন্দু। এখন দেখা যাক এই নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর কী এবং কীভাবে কাজ করে।
নিউক্লিইয়ার রিয়েক্টর একটি বড় আবদ্ধ পাত্র বিশেষ, যার মধ্যে ইউরেনিয়াম পরমাণু সংরক্ষিত থাকে। এটি বিক্রিয়া করার মাধ্যমে তীব্র তাপ উৎপন্ন করে যা পরবর্তীতে নিউক্লিয়ার শক্তি উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়।নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর তিনটি ধাপে বিভক্ত (১) জালানি উপাদান (২) মডারেটর (৩) কাউন্ট রড।
জ্বালানি উপাদানগুলাে লম্বা সূক্ষ্ম, সরূ নল আকৃতির যা একত্রে প্রায় কয়েক ডজন করে থাকে এবং প্রতিটি নল ফিশনযােগ্য 235 U অথবা * U পরমাণু ধারণ করে। জ্বালানি উপাদানে পূর্ণ প্রতিটি রড ১ সে.মি. করে লম্বা হয়। জ্বালানি উপাদানগুলাে মডারেটরে ডুবন্ত থাকে, যা সাধারণত পানি দ্বারা পূর্ণ থাকে। মডারেটর নিউক্লিয়ার রিয়েক্টরের মধ্যে থাকা নিউট্রনের গতি কমিয়ে বিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এই সকল বিক্রিয়া কন্ট্রোল রডেরমাধ্যমে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনা করা হয়।
নিউক্লিয়ার রিয়েক্টরে ফিশন বিক্রিয়ার ফলে প্রচন্ড তাপ উৎপন্ন হয়। আর এই তাপ শক্তি তিনটি ধাপে সাবমেরিন এর প্রােপেলারকে ঘুরতে সাহায্য করে। ধাপ তিনটি হচ্ছে (১) রিয়েক্টর কোর, (২) হিট এক্সচেঞ্জ ও (৩) পাম্পপ্রথমে রিয়্যাক্টর কোর থেকে বিক্রিয়ার ফলে উত্তপ্ত গরম পানি নলের মাধ্যমে হিট এক্সচেঞ্জারে পাঠানাে হয় সেখানে রাখা ঠান্ডা পানি অত্যধিক গরম পানির সংস্পর্শে বাষ্পে পরিণত হয় এবং অতি উচ্চ চাপ সৃষ্টি করে সেই চাপ সরু নলের মাধ্যমে প্রােপেলারে পাঠানাে হয় এবংএই অত্যাধিক চাপের ফলে সাবমেরিন এর প্রােপেলার ঘুরতে শুরু করে। প্রােপেলারের ঘূর্ণনের ফলে সাবমেরিন সামনের দিকে এগিয়ে যায় । অতিতে সাবমেরিন এর প্রােপেলারে ৩টির মতাে ব্লেড ব্যবহার করা হতাে কিন্তু এতে করে প্রােপেলার এর ঘূর্ণনের ফলে বুদ বুদ সৃষ্টি হয় ফলে সাবমেরিন নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হতাে ফলে বর্তমানে ৬ টির মতাে ব্লেড ব্যবহার করা হয়, এতে প্রােপেলার অল্প ঘুরেও অধিক গতি অর্জন করে এবং বুদ বুদ ও সৃষ্টি হয় না।
সাবমেরিনের যুগে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে ত্রিমাত্রিক করার লক্ষ্যে সম্প্রতিবাংলাদেশ সরকার চীন থেকে ২ টি সাবমেরিন ক্রয় করে, যা ইতােমধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহীনিতে যুক্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ত্রিমাত্রিক প্রতিরক্ষা শক্তি অর্জন করে। সাবমেরিন ২ টি ৩৫ জি ক্লাস মডেলের যা ডিজেল এবং বিদ্যুৎ চালিত। এই সাবমেরিন দুটির নাম দেওয়া হয়েছে নবযাত্রা ও জয়যাত্রা। এরা আধুনিক টর্পেডাে এবং মাইন বহন করতে সক্ষম। এর গতি সীমা প্রায় ১৭ নটিক্যাল মাইল। প্রতিটি সাবমেরিন ক্যাপ্টেনসহপ্রায় ২৭ জন করে ঐ মেম্বার বহনে সক্ষম।
এটি দৈর্ঘ্যে ৭৬ মিটার এবং প্রস্থে ৭.৬ মিটার। বিষেশজ্ঞরা মনে করেন, সাবমেরিন যুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্র সীমার নিরাপত্তা রক্ষা কার্যক্রম আরও শক্তিশালী হয়েছে।
This is a Bengali article. It’s about history of submarine.
All the reference are hyperlinked within article.
Featured Image: Defense BD