লিখুন
ফলো

চা এর ইতিহাস

আমাদের সকাল শুরু হয় চা পান করে বা মাথা ব্যথা হলেই অনেকে টেনে নেয় চায়ের কাপ। অতি পরিচিত এই পানীয় পৃথিবীর সকল মানুষের পছন্দের তালিকায় সবার আগে জায়গা করে নিয়েছে। হালকা সুগন্ধ যুক্ত এই তরল পানীয় বেশ ইতিহাসের মধ্য দিয়েই এদেশে এসেছে। চায়ের আনাগোনা বাসা বাড়ি থেকে শুরু করে অফিস আদালতেও আপ্যায়নের মাধ্যম হিসেবে দেখা যায়। বাড়িতে মেহমান আসলে কিংবা বিকেলে ছাদের আড্ডায়ও চায়ের দেখা পাওয়া যায়। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের চীনে অসাবধানতাবশত ঘটে যাওয়া এক ঘটনায় জন্মেছে আজকের এই চায়ের ইতিহাস। চা পান করে না এমন মানুষ খুব কমই আছে। চীনের হাজার হাজার বছর পুরনো এই গল্পে মিশে আছে তাদের ঐতিহ্য থেকে শুরু করে আজকের সারাবিশ্বে বিখ্যাত হওয়া এই তরল পানীয়।  আজ জানবো এই চায়ের ইতিহাস নিয়ে। 

চায়ের উৎপত্তি

হাজার হাজার বছর আগে চীনে সর্বপ্রথম চায়ের আবিষ্কার ঘটে। চায়ের ইংরেজি  নাম Tea. এর বৈজ্ঞানিক নাম ক্যামেলিয়া সিনেনসিস। চায়ের নামকরণ হয় গ্রীক দেবী থিয়ার নামানুসারে। চীন দেশে চায়ের উচ্চারণ করা হতো চি বলে। সেখান থেকেই এক সময় চা শব্দটি উচ্চারিত হয়। বাণিজ্যিক ভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয় ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে, চীনে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম চায়ের খোঁজ পায় ব্রিটিশরা। ১৮৫৫ সালে এদেশে ব্রিটিশদের আনাগোনার সময় তারা সিলেটে চায়ের গাছ খুঁজে পায়। আর এরপর থেকে নানান পথ হেঁটে এদেশে চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও চায়ের উৎপাদন বেশ লক্ষণীয়। ভারতে চায়ের উৎপাদন শুরু হয় ১৮শ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। 

চায়ের উৎপত্তি নিয়ে আমরা কম বেশি সবাই একটি গল্প জানি যে কেউ একজন অসতর্কতাবশত চায়ের পাতা পানিতে জ্বাল দিলে এর স্বাদের জন্য চায়ের সৃষ্টি হয়। তবে এই গল্পটাই ঠিক অন্যভাবেই ঘটেছিলো সেদিন। চায়ের প্রথম স্বাদ গ্রহণকারী ছিলেন একজন সম্রাট, পাশাপাশি দক্ষ বিজ্ঞানী এবং শাসক। সম্রাট একদিন বনে বসে জল ফুটাচ্ছিলেন। তখন হুট করে তার পাত্রে বনের এক গাছ থেকে পাতা ভেতরে পড়ে যায়। সেই পাতা পানির সাথে ফুটে উঠলে সম্রাট শেন নং কৌতুহলবশত সেটি পান করেন এবং তিনি এতোটাই উপভোগ করেন যে সেই গাছ নিয়ে গবেষণা শুরু করে দেন। 

চায়ের চাষ পদ্ধতি

Image Source: Google

চা উৎপাদনের বেশ কিছু পদ্ধতি আছে। বাংলাদেশে চায়ের আসল জায়গা আমরা সিলেটকেই জানি। তবে সিলেট ছাড়াও বাংলাদেশে আরও বেশ কয়েক জেলায় চায়ের উৎপাদন হয়। বিশেষ করে চট্টগ্রামে চায়ের বেশ ভালো উৎপাদন হয়। চা চাষের জনয সবচেয়ে ভালো এবং নির্ভরযোগ্য জমি হচ্ছে ঢিলা। ঢিলা জমিতে বা পাহাড়ি উঁচু সমতল ভূমিতে চা চাষ করার জন্য আবাদযোগ্য জমি। সাধারণত উঁচু স্থানে মই দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে চায়ের চাষ করা হয়।

চা উৎপাদন করার জন্য শ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে এপ্রিল/মে মাসে। অর্থাৎ প্রাক-বর্ষাকালীন সময়ে চা চাষ করা হয়ে থাকে। তবে যদি চা বাগানের পানি সেচের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে ডিসেম্বর/মার্চ মাসেও চা গাছ রোপণ করা যায়।

চা চাষের জন্য বিভিন্ন চারার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ক্লোন চারা, বীজ চারা নামক চারা চা চাষে বহুল ব্যবহৃত। সাধারণত ক্লোন চারার জন্য এবং বীজ চারার জন্য গভীরতা হিসেবে ৩০-৩৫ এবং ৪০-৪৫ কিংবা উভয়ের জন্য ২৫-৩০ সে.মি. প্রশস্ত গর্তের প্রয়োজন হয়। এই গর্তের মধ্যে সবল চারা বুনতে হয়। তবে বুনার আগে ২৩ সে.মি. মাটি গর্তের একপাশে রেখে সেই নিচের মাটিতে প্রতি গর্তে দুই কেজি পচা গোবর সার, টিএসপি ৩০ গ্রাম এবং ১৫ গ্রাম এমপি মিশিয়ে নিতে হয়। চায়ের জন্য মাটির আদ্রতা যাচাই করাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শুষ্ক মৌসুমে চায়ের চারা রোপণ করার পর চায়ের গোরা থেকে বেশ কিছুটা উচ্চতায় মালচ বিছিয়ে দিতে হয়। এর উপকরণ হিসেবে কচুরিপানা, গুয়াতেমালা একে সাইট্রনেলা ঘাসও বলা হয়, এবং ঝোপ ঝার ব্যবহার করা হয়। 



চায়ের চাষবাসে শেষ ধাপের আগে ছাটাই করে নিতে হয়। সাধারণত একটি চা গাছের চারা কম্পক্ষে পাঁচ বছর পর্যন্ত অপ্রাপ্ত বা অপরিণত হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। অপরিণত চায়ের চারাকে আগাছা ছেঁটে দেয়ার মাধ্যমে এর আকৃতি পাল্টানো হয়। এতে করে যত বেশি ঝোপাকৃতি হবে ততোই চা পাতা পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। চা গাছ রোপণ করার মাধ্যমে চা ছাঁটাই করার সময় নির্ধারণ করা হয়। যেমন, চায়ের চারা যদি এপ্রিল/মাসে রোপণ করে তাহলে সেই বছরের শেষে বা পরের বছরের জানুয়ারিতে ছাঁটাই করা যাবে। চা গাছ ছাঁটাই করার বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে থাকে। যেমন, মধ্যকান্ডচ্ছেদন, ভঙ্গন, বাহুবদ্ধকরন ইত্যাদি।

চা গাছ বেশ সেনসিটিভ টাইপের হয়ে থাকে। সাধারণত চা গাছ সূর্যের তাপ সহ্য করতে পারে না। আর তাই চা গাছ রোপণ করতে ঠাণ্ডা আবহাওয়া পরিবেশ বেছে নিতে হয়। ছায়া আছে এমন জায়গায় চা চাষ করতে হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এমন পরিবেশ আছে বলে চা চাষ করা সম্ভব হয়েছে। সিলেট, চট্টগ্রাম ইত্যাদি জেলায় ছায়া পদ্ধতি অবলম্বন করে চা গাছের রোপণ করা হয়ে থাকে। সময় মতো সার দেয়া, যত্ন নেয়ার উপর অনেক সময় চায়ের সবল ইনপুট নির্ভর করে। তবে গাছে সার, পানির নিষ্কাশন বাদেও গাছে কোন প্রকার পোকামাকড় হয় কিনা, কোন ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ আছে কিনা এসবের দিকেও খেয়াল করতে হয়। বিশেষ যত্নের পরেই একটি গাছের মাধ্যমে চা পান করার মতো পাতা পেতে পারি আমরা। 

বাংলাদেশে বর্তমানে  চা উৎপাদনে বেশ এগিয়ে আছে। পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১৯ সালে প্রায় ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি চা উৎপাদন করেছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে এদেশে চা উৎপাদন করা হয়েছিলো ৮২.১৩ মিলিয়ন কেজি প্রায়। বাংলাদেশ চা বোর্ডের উপপরিচালক মুনির আহমদ জানান, বাংলাদেশে ২০১৯ এর আগে কখনো ৮৫ মিলিয়নের আগে যেতে পারেনি। আর এতেই বুঝা যায়, চা উৎপাদনে বাংলাদেশ সর্বকালের রেকর্ড করেছে। মুনির আহমদ আরও জানান, ২০১৯ সালে যখন নভেম্বরে ৯৫ শতাংশ চা উৎপাদন হয় তখনই তারা নিশ্চিত হয়েছিলো যে বাংলাদেশ এবার চা উৎপাদনে রেকর্ড করবে এবং তা সত্যিও হয়। বাংলাদেশে চায়ের চাহিদা বছরে প্রায় ৯ কোটি কেজি। ২০১০ সাল থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ১৪ লাখ কেজির মতো চা আমদানি করতে হতো। তবে বর্তমানে আর চা আমদানি করতে হয় না, বরবগ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ চা রপ্তানি করে থাকে। বাংলাদেশের চা গবেষকদের মতে, এদেশে চা উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব। চা বাগানের জমির সঠিক ব্যবহার, সঠিক পরিচর্যা, চা বাগানের মালিদের ন্যায্য পয়সা দেয়া ইত্যাদি। 

চা নিয়ে অজানা তথ্য

চায়ের বিভিন্ন ইতিহাস ছাড়াও বেশ কিছু অজানা তথ্য আছে যা আমরা অনেকেই জানিনা। চা পানের শুরুর ইতিহাস সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। চীনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় দুইশ বছর আগে সেখানে চা পাতা মৃতদের সাথে দিয়ে দেয়া হত। কেননা তারা বিশ্বাস করতো চা পাতা সেই মৃতদের পরলৌকিক জিবনের অনুষঙ্গ হয়ে থাকবে সেটি। সাধারণত এটিকে তাদের সময়কার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পদ্ধতি বলা হতো। জাপানের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে অনেকেই বলেন, চা চীন থেকে জাপানে আসে জাপানি ধর্মগুরুদের হাত ধরে। তারা পরবর্তীতে চা বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বা প্রথায় ব্যবহার করেছিলেন। 

আজকের দিনের রাশান ক্যারাভান চা কিন্তু এমনি এমনি আসেনি! রুশদের কাছে চা পৌঁছাতো চীন থেকে রাশিয়ার পথে ক্যারাভান রুটে। দীর্ঘদিন ধরে চা মহাদেশে ভ্রমণ করে বেড়াতো। তাদের রাতের ক্যাম্প ফায়ারের ধোঁয়া চায়ের উপর ছুটে আসতো। এবং যতক্ষণে তারা মস্কোতে পৌঁছাতো পাতাগুলো বেশ ধোঁয়াটে বর্ণের হয়ে যেত এবং এর থেকেই রাশান ক্যারাভান চায়ের উৎপত্তি ঘটে।

আরো পড়ুনঃ

পাস্তাঃ যে খাবার ছাড়া ইতালিয়ানরা এক প্রকার অসম্পূর্ণ

অটোম্যান সাম্রাজ্য এবং তার ইতিহাস

চায়ের প্রকারভেদ

চায়ের বেশ কিছু প্রকারভেদও আছে। চা-কে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন, কালো চা (ব্লাক টি), মিশ্রিত চা, সবুজ চা (গ্রিন টি) 

এছাড়া দার্জিলিং চা, মাচা চা, লাহপেট, সাদা চা ও দেখা যায়। বিশ্বে অনেক দামী চায়েরও দেখা মিলে। দা হং পাওকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে দামী চা। এই চায়ের মূল্য প্রতি গ্রাম প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। পিজি টিপস ডায়মন্ড টি ব্যাগ নামেও এক চা আছে যা কিনতে হলে আপনাকে গুনতে হবে প্রায় ১৫ হাজার মার্কিন ডলার! যা এদেশের হিসাবে দাঁড়ায় প্রায় ১২ লাখ টাকা।  এর মূল্য এতো হওয়ার কারণ হচ্ছে এটি এক ধরণের বিরল প্রজাতির চা যা খুব সহজেই পাওয়া যায় না। ইউরোপের বেশ পুরনো একটি চা হচ্ছে ব্রোকেন লিফ ব্ল্যাক টি। এই চা কেবল ইউরোপেই চাষ করা হয়ে থাকে। এই চা বিখ্যাত কেননা এটি চা গাছের তিন নাম্বার পাতা থেকে এই চা উৎপাদন করা হয়ে থাকে। 

জনপ্রিয় এই পানীয় বেশ কায়দা করেই যেন তার স্থান করে নিয়েছে। পৃথিবীর কোন জায়গা বা মানুষ নেই যেখানে বা যারা চায়ের স্বাদ নেয়নি। এর জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে এদেশ থেকে শুরু ক্রে অন্যন্য দেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। কয়েকশ বছর আগের সেই সম্রাট থেকে শুরু করে আজকের বিভিন্ন শ্রেনির মানুষই চায়ের স্বাদ গ্রহণ করছে। অজানা এই চা পাতাটি যে ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে সেটা কে জানতো! 

This is a Bangla article. Here, everything is written about the TEA.

All references link are hyperlinked

Featured image taken from Google

Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous Article

দূরত্ব মাপতে আলােকবর্ষ কেন প্রয়োজন হলো?

Next Article

ডেথ ইন দ্যা গুঞ্জ (2016) : বালকের পুরুষত্ব অর্জনের কাফকায়েস্কে গল্প

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন

Total
0
Share