শৈশবে চুম্বকের প্রতি আকর্ষণ ছিল না এমন একজন মানুষেরও দেখা মিলবে না। এ আকর্ষণ চুম্বকের সাথে চৌম্বক পদার্থের মতাে নয় ঠিকই তবে এ আকর্ষণও যে যথেষ্ট প্রবল ছিলাে সেটি নতুন করে বলার কিছু নেই। চুম্বক সমন্ধে মানুষের জানাশােনা বহু বছরের পুরনাে। চুম্বক আবিষ্কার নিয়ে ইতিহাসে নানান গালগল্প ছড়িয়ে রয়েছে। কথিত আছে ৪০০০ বছর আগে ম্যাগনেস নামে উত্তর গ্রিসের এক রাখাল বালক তার হারানাে ভেড়া খুঁজতে গিয়ে সর্বপ্রথম চুম্বক পাথরের খোঁজ পায়। ম্যাসনেসের নামানুসারে যার নাম ম্যাগনেট রাখা হয়। প্রাচীন গ্রিক ও রােমানরা অনেক আগে থেকেই লােডস্টোন (প্রাকৃতিক চুম্বক) সমন্ধে জানতাে। চীনারা সর্বপ্রথম (২০৬ খ্রিষ্টপূর্ব) কম্পাস ব্যবহার করে।
কম্পাস হলাে চুম্বকের সাহায্যে দিক নির্ণয়কারী যন্ত্র। চীনা নাবিকরা তাদের দিক নির্ণয়ের কাজে এ যন্ত্রটি ব্যবহার করতেন। অনেক সময় কোনাে কিছু বুঝতে বিজ্ঞান অনেক সময় নেই। যেমন চুম্বক সম্পর্কে মানুষের জানাশােনা বহু বছরের পুরনাে হলেও সত্যিকারার্থে চুম্বক কিভাবে কাজ করে সেটা জানতে পেরেছি গত শতাব্দীতে এসে যখন মানুষ পরমাণু সম্পর্কে পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানার্জনকরে। চলুন আপাতত চুম্বকের নানা দিক সম্পর্কে জেনে নেয়।
চুম্বকত্ব কী?
ছেলেবেলায় আমরা যেসব জিনিস নিয়ে খেলা করতে পছন্দ করতাম, চুম্বক ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। আর এর পেছনে কারণ ছিলাে চুম্বকের বিস্ময়কর ধর্ম। চুম্বক নিয়ে খেলা করার সময় আমরা অনেকবারই দেখেছি দুটি চুম্বক কখনাে পরস্পরকে আকর্ষণ করে আবার কখনাে বা বিকর্ষণ করে। কিন্তু তখন আমরা বুঝতাম না কেন আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে। চুম্বকের আকর্ষণ-বিকর্ষণের এই ঘটনাকেই চুম্বকত্ব বলা হয়।
প্রাচীন মানুষের কাছে চুম্বকত্ব ছিল ম্যাজিকের মতাে। হাজার হাজার বছর পর এসে এখন আমরা জানি চুম্বকীয় বস্তুর ভিতরে আসলে কী ঘটে, তার ভিতরের পরমাণু সমূহের গঠনশৈলী কীভাবে তার চুম্বক ধর্মের জন্য দায়ী কিংবা আমরা এখন জেনে গেছি কেনবিদ্যুৎ এবং চুম্বকত্ব আসলে তড়িৎচুম্বকীয় মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।
একটা সময় চুম্বক বলকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, চুম্বকত্ব হচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু বস্তুর মধ্যে অদৃশ্যমান অদ্ভুত রকমের বল। এখন আমরা বলতে পারি চুম্বক বল মূলত তড়িৎ প্রবাহের ফলে সৃষ্ট বল।
চুম্বক সমন্ধে ছয়টি মৌলিক তথ্য
১. একটি চুম্বক দন্ডের প্রান্তদ্বয়কে মেরু বলা হয়। এর মধ্যে একটিকে উত্তর মেরু ও অপরটিকে দক্ষিণ মেরু বলা হয়।
২. একটি চুম্বকের উত্তরমেরু, অপর একটি চুম্বকের দক্ষিনমেরুকে আকর্ষণ করে। অন্যদিকে একটি চুম্বকের উত্তরমেরু অপর একটি চুম্বকের উত্তরমেরুকে বিকর্ষণকরে। অর্থাৎ সমজাতীয় মেরু পরস্পর বিকর্ষণ করে এবং ভিন্নজাতীয় মেরু পরস্পরকে আকর্ষণ করে।
৩. কোনাে চুম্বকের চারপাশে যে অঞ্চলজুড়ে তার বলের প্রভাব বিস্তৃত থাকে সেই অঞ্চলকে বলা হয় চুম্বকক্ষেত্র। এ বল আকর্ষণ বা বিকর্ষণজনিত হতে পারে।
৪. যদি একটি চুম্বক দন্ডকে শূন্যে বুঝিয়ে রাখা হয় তাহলে দন্ডটির উত্তরমেরু পৃথিবীর উত্তর এবং দন্ডটির দক্ষিণমেরু পৃথিবীর দক্ষিণ দিক বরাবর হয়ে থাকে। কারণ পৃথিবী নিজেই একটি বিশাল চুম্বক দন্ডের মতাে আচরণ করে। এখানে বলে রাখা ভালাে যে চুম্বকীয় মেরু এবং ভৌগলিক মেরু পরস্পর বিপরীত।
৫. একটি চুম্বক দন্ডকে কেটে যত খন্ডেই বিভক্ত করা হােক না কেনাে প্রত্যেকটি খন্ডেই পূর্বের ন্যায় উত্তর ও দক্ষিণমেরু সৃষ্টি করবে।
৬. কোন চৌম্বক পদার্থকে কোন শক্তিশালী চুম্বকের নিকটে আনলে ঐ চুম্বক পদার্থটি সাময়িকভাবে চুম্বকে পরিণত হয় বা অন্য কোন চৌম্বক পদার্থকে আকর্ষণ করে। এ ঘটনাকে চৌম্বক আবেশ বলে।
চুম্বক ক্ষেত্র
মনে করুন কোনাে একটি চুম্বক দন্ডকে টেবিলের উপর রেখে এর কাছেই কিছু লােহার পেরেক রাখা হলাে। এরপর আস্তে আস্তে চুম্বকটিকে পেরেকগুলাের দিকে সরাতে থাকলেন। একটা সময় গিয়ে দেখা যাবে পেরেকগুলাে লাফিয়ে এসে চুম্বকের গায়ে লেগে যাচ্ছে। কিন্তু কেন এমন ঘটছে? প্রথমাবস্থায় তাহলে কেন পেরেকগুলাে আকৃষ্ট হয়নি? এর কারণ প্রত্যেকটি চুম্বকেরই তার চারপাশে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলজুড়ে তার বলের প্রভাব বিস্তৃত রয়েছে। সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে গেলেই তবে চুম্বক বা চৌম্বক জাতীয় পদার্থ আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল অনুভব করবে। চুম্বকের চারপাশের এই নির্দিষ্ট অঞ্চলকেই চুম্বক ক্ষেত্র বলে।
একটি চুম্বকদন্ডকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখলে কেন সর্বদা দন্ডটি উত্তর-দক্ষিণ দিক হয়ে থাকে?
১৬০০ সালে উইলিয়াম গিলবার্ট নামে একজন বিখ্যাত ইংরেজ ডাক্তার ও পদার্থবিদ এই প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি বলেন পৃথিবী নিজেই একটি বৃহদাকার চুম্বক। গিলবার্টের তত্ত্বটি De Magnete নামে বইয়ে প্রকাশিত হয়, যেটা ছিলাে ইংরেজিতে প্রকাশিত প্রথম কোনাে বড় বৈজ্ঞানিক বই। পূর্বে বৈজ্ঞানিক সব বই ল্যাটিন ভাষায় লেখা হতাে।
এখন আমরা জানি পৃথিবী আসলে চুম্বকীয় কারণ এর ভিতরে অবস্থিত গলিত ধাতুর প্রবাহ।একটি চুম্বক দন্ডের ন্যায় পৃথিবীরও চুম্বক ক্ষেত্র রয়েছে যেটা শূন্য পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এ অঞ্চলকে বলা হয় ম্যাগনেটোস্ফিয়ার।
চুম্বকীয় বল কি শুধুই পৃথিবীর মধ্যে রয়েছে নাকি অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যেও রয়েছে?
আমরা যে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছি সেই সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্র পৃথিবীর তুলনায় কয়েক গুণ বেশি শক্তিশালী। কিন্তু আমাদের পৃথিবীকে কেন্দ্র করে যে চাঁদ ঘুরছে তার চৌম্বকক্ষেত্র অতি নগণ্য অথবা নেই বলা চলে। সৌর পরিবারের অন্য গ্রহগুলােরও চৌম্বকক্ষেত্র রয়েছে। যেমন শনি, বৃহস্পতি, নেপচুন ও ইউরেনাসের চৌম্বকক্ষেত্র পৃথিবীর তুলনায় বেশি শক্তিশালী।
অন্যদিকে মঙ্গল, বুধ ও শুক্র গ্রহের চৌম্বকক্ষেত্র পৃথিবীর তুলনায় কম শক্তিশালী। আচ্ছা, পৃথিবীর চুম্বক ধর্মের আদৌ কি কোনাে প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে? এমন প্রশ্ন যদি কারাে মনে জন্ম নিয়ে থাকে তাহলে শােনেন। পৃথিবীর এই চুম্বক ধর্মকে ব্যবহার করে প্রাচীন কাল থেকে মানুষ দিক নির্ণয় করে আসছে। বিশেষ করে বিশাল সমুদ্র পাড়ি দেয়ার সময় নাবিকরা পৃথিবীর চুম্বক ধর্মকে কাজে লাগিয়ে দিক নির্ণয় করতাে।
শীতের সময় যেসব অতিথি পাখি হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেয় কিংবা যেসব সামুদ্রিক প্রাণী বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়, তারাও দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পৃথিবীর চুম্বক ধর্মকে কাজে লাগায়। সাধারণ চুম্বকের মতাে পৃথিবীরও চুম্বক বলরেখা রয়েছে। এই চুম্বক বলরেখাগুলাে সূর্য থেকে আগত বিভিন্ন ক্ষতিকর রশ্মি থেকে পৃথিবীর প্রাণীজগৎকে রক্ষা করছে। পৃথিবীর চুম্বক বলয় না থাকলে সূর্য থেকে আগত ক্ষতিকর রশ্মিগুলাে অবাধে পৃথিবীতে চলে আসতাে। ফলে সমস্ত প্রাণীকুল হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়তে এবং পৃথিবীর যােগাযােগ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাও একরকম অকার্যকর হয়ে যেত।
This is a bengali article. Magnets and magnetism are described here.
All the reference are hyperlinked within article.
Featured Image: Ten Minutes School