তিব্বতকে আসলে দেশ বলা হলেও এটা মূলত কোন দেশ নয়। অধিকাংশ তিব্বতীরা নিজেদেরকে স্বাধীন বলে মনে করলেও মূলত এখনো এই অঞ্চলটি চীনের অংশ। কিন্তু কি আছে এই দেশটিতে যা একে এতটা রহস্যময় করে তুলেছে? তিব্বতের রাজধানী লাসাকে বলা হয় বিশ্বের নিষিদ্ধ নগরী। কিন্তু কেন? আজকে আমরা জানব রহস্যেঘেরা এই দেশটি সম্পর্কে।
ভৌগোলিক অবস্থান
তিব্বত গণচীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। তিব্বতীয় মালভূমির গড় উচ্চতা প্রায় ১৬,০০০ ফুট। যার কারণে এই অঞ্চলকে পৃথিবীর ছাদও বলা হয়ে থাকে। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই দেশটির আয়তন ১২,২৮,৪০০ বর্গকিমি, যা কিনা বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ৯ গুণ বড়। আয়তনে বিশাল হলেও দেশটির জনসংখ্যা খুবই কম।
বিরূপ আবহাওয়া এবং পাহাড়ি ও দুর্গম অঞ্চল হওয়ার কারণে এ অঞ্চলের জনসংখ্যা খুবই কম। বর্তমানে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭৫ লক্ষের মতো। এখানে পশুপালন ছাড়া তেমন কোন পেশা নেই। শিক্ষিতের হার খুবই নগণ্য। জীবন যাত্রার মানও অতি নিম্ন। তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থান তিব্বতীয় মালভূমিতেতে অবস্থিত। নেপালের সাথে তিব্বত সীমান্তে মাউন্ট এভারেস্ট অবস্থিত।
তিব্বতকে পৃথিবীর জলাধারও বলা হয়ে থাকে। কারণ তিব্বত থেকে প্রবাহিত হয়েছে অসংখ্য নদ এবং নদী। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি নদী আবার কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশেও প্রবেশ করেছে।
পদ্মা নদী, ব্রহ্মপুত্র এগুলো মূলত এসেছে তিব্বত থেকেই। এছাড়া পাকিস্তান ও ভারতের বিখ্যাত ইন্দুস নদীও তিব্বত থেকে প্রবাহিত হয়েছে। তিব্বত থেকে প্রবাহিত হয়েছে ইয়াংজী নদী। এটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় নদী, পৃথিবীর ৩য় দীর্ঘতম নদী এবং এর দৈর্ঘ্য ৬৩০০ কি.মি.।
তিব্বত অনেক ক্ষেত্রেই চীনের ভৌগলিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। ১৯৫০ সালে গণচীন তিব্বতকে স্থায়ী অংশ করার সিদ্বান্ত নেয়। আর এরই ফলশ্রুতিতে এক সময়ের স্বাধীন তিব্বত চীনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। তীব্বত একদিকে যেমন চীনকে প্রাকৃতিক সম্পদের যোগান দিচ্ছে অন্যদিকে তীব্বতের সীমান্ত ভারতকে চাপে রাখছে।
তিব্বত কেন নিষিদ্ধ?
পৃথিবীতে নিষিদ্ধ দেশ কোনটি? এমন প্রশ্ন করা হলে আপনি নিশ্চয় তিব্বতের কথায় বলবেন। কিন্তু কেন তিব্বত নিষিদ্ধ দেশ জানেন কি? এ নিষিদ্ধের পেছনের রহস্য অনেকেরই অজানা। কেন তিব্বতকে নিষিদ্ধ দেশ বলা হয়? কী এমন গাঢ় রহস্যের কুয়াশায় আবৃত তিব্বতের অবয়ব?
১৯১২ সালে ১৩তম দালাই লামা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি স্ব-শাসিত অঞ্চল তিব্বত। মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত এ অঞ্চলটি তিব্বতীয় জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। এ অঞ্চলটিকে চীনের অংশ বলা হলেও এখানকার বেশির ভাগ তিব্বতি জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলকে চীনের অংশ মানতে রাজি নয়। এ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। ১৯৫৯ সালে গণচীনের বিরুদ্ধে তিব্বতিরা স্বাধিকার আন্দোলন করলে, তা ব্যর্থ হয়। তখন দালাই লামার নেতৃত্বে অসংখ্য তিব্বতি ভারত সরকারের আশ্রয় নিয়ে হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় বসবাস শুরু করেন। সেখানে স্বাধীন তিব্বতের নির্বাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিন্তু তিব্বতের নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনের মূল রহস্য এর দুর্গম এবং পাহাড়ি অঞ্চল। পৃথিবী থেকে তিব্বতের দূরত্ব যেন মঙ্গল গ্রহ থেকেও বেশি। বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ, সাংবাদিক, কিংবা ক্যামেরা তিব্বতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি। এজন্য শত শত বছর ধরে তিব্বত থেকে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালে। নিষিদ্ধ এ শহরে এক সময় প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এ কারণেই ধীরে ধীরে তিব্বত হয়ে ওঠে এক নিষিদ্ধ শহর।
তিব্বতের রাজধানী লাসা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গোবি মরুভূমি। মরুভূমির নিষ্ঠুর ও কষ্টদায়ক পরিবেশ এসব এলাকার মানুষকে কাছে আনতে নিরুৎসাহিত করে। তিব্বতের স্থলভাগ বছরের প্রায় আট মাস তুষারে ঢেকে থাকে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই তিব্বতকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে অনেক রহস্য ও কল্পকাহিনী। তিব্বতের রাজধানী লাসা বিশ্বব্যাপী ‘নিষিদ্ধ নগরী’ হিসেবে পরিচিত ছিল অনেক আগে থেকেই। তাই তিব্বতের রহস্যের পেছনে এর প্রকৃতি ও দুর্গম পরিবেশ অনেকাংশে দায়ী। তিব্বতের বেশির ভাগ ভূ-ভাগ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬ হাজার ফুটেরও ওপরে অবস্থিত হওয়ায়, সেখানে বসবাস করা পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের চেয়ে বেশি কষ্টকর।
দেশটিতে বাইরের বিশ্ব থেকে কারও প্রবেশ করার অনুমতি না থাকায় এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে সবার কাছে একটি রহস্যময় জগৎ হিসেবে পরিচিত ছিল। কী আছে লাসায়—তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত সমগ্র বিশ্ব। লাসার জনগোষ্ঠী, শহর, বন্দর, অট্টালিকা সবকিছুই ছিল সবার কাছে একটি রহস্যঘেরা বিষয়। লাসা নগরীতে ছিল বিখ্যাত ‘পোতালা’ নামক একটি প্রাসাদ। এই প্রাসাদ প্রথমবারের মতো বহির্বিশ্বের মানুষেরা দেখতে পায় ১৯০৪ সালে। আমেরিকার বিখ্যাত ন্যাশনাল জিওগ্রাফি পত্রিকায় এই বিখ্যাত অট্টালিকার ছবি ছাপা হয় সে সময়।
দালাই লামার আবির্ভাব
রহস্যময় পোতালা প্রাসাদে বাস করতেন তিব্বতের দালাই লামা। দালাই লামার আবির্ভাব ঘটেছে সেই ১৩৯১ সালে। দালাই লামা বলতে তিব্বতের প্রধান ধর্মগুরুকে বোঝায়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদেরকে তিব্বতে লামা বলে সম্বোধন করা হয়। মূলত ‘লামা’ শব্দের অর্থ ‘সর্বপ্রধান’, আর ‘দালাই’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞানসমুদ্র’। অর্থাৎ ‘দালাই লামা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘জ্ঞানসমুদ্রের সর্বপ্রধান’।
দালাই লামা হচ্ছেন তিব্বতের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু; image: tbs archives
তিব্বতের সর্বত্রই বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য পাহাড় ও গুহা। সেই পাহাড়ি গুহাগুলোতে বাস করেন বৌদ্ধ পুরোহিত লামারা। তিব্বতের গুহাগুলো নিয়েও রহস্য আর জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। তিব্বত বা লাসায় দীর্ঘদিন মানুষের প্রবেশাধিকার না থাকা, দুর্গম পরিবেশ, লামাদের কঠোরতা ও পর্যটক নিষিদ্ধের কারণে বাইরের পৃথিবীতে তিব্বত যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক অচেনা জগত।
সম্রাট সগেন পো তিব্বতের রাজধানী লাসা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা। ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট একটি বিরাট জলাশয় ভরাট করে প্রাসাদ এবং মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিব্বতের বিভিন্ন মন্দিরের ভেতরে সোনার তৈরি বড় বড় প্রদীপ মাখন দিয়ে জ্বালানো থাকে। ৪ হাজার ভরি ওজনের একটি প্রদীপও সেখানে রয়েছে বলে জানা যায়।
তিব্বতিরা অত্যন্ত ধর্মভীরু হওয়ায় ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। লামাকে তারা সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা করতেন সেই ১৩ শতক থেকেই।তিব্বতীরা মনে করে দালাই লামা হল বুদ্ধের অবতার। তারা বিশ্বাস করে, যখনই কেউ দালাই লামার পদে অভিষিক্ত হন, তখনই ভগবান বুদ্ধের আত্মা তাঁর মধ্যে আবির্ভূত হয়। দালাই লামা নির্বাচনের পদ্ধতিটাও বেশ রহস্যময় এবং রোমাঞ্চকর। তিব্বতিদের দালাই লামা বা নেতা নির্বাচনের পদ্ধতিটা বিচিত্র। তিব্বতি প্রথামতে, কারও মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তার মরদেহের সৎকার করা হয় না। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, মৃত্যুর পরও আত্মা জাগতিক পরিমণ্ডলে বিচরণ করে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মা জাগতিক পরিমণ্ডল ত্যাগ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা মরদেহটি তাদের বাড়িতে রেখে দেয়।
কোনো লামার মৃত্যু হলে লাসার পূর্বে এক সরোবরের তীরে লামারা ধ্যান করতে বসেন। ধ্যানযোগে লামারা দেখতে পান সেই সরোবরে স্বচ্ছ পানির ওপর ভেসে উঠছে একটি গুহার প্রতিবিম্ব, যার পাশে রয়েছে একটি ছোট বাড়ি। প্রধান লামা তাঁর সেই অলৌকিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এঁকে দেবেন নতুন দালাই লামার ছবি। তারপর কয়েকজন লামা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তিব্বতের বিভিন্ন স্থানে যান শিশু অবতারের খোঁজে। তাঁরা তিব্বতের ঘরে ঘরে গিয়ে সেই ছবির হুবহু শিশুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। আর এভাবেই খুঁজে বের করা হয় নতুন দালাই লামাকে।
তিব্বতের বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে তিব্বতের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭৫ লক্ষ। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর একমাত্র পেশা মরুভূমিতে পশু চরানো। শিক্ষা এবং কাজের দক্ষতা না থাকলেও ধর্মের ক্ষেত্রে তাদের কাছে কোন ছাড় নাই। এই শতকে এসে ও সেখানে মেনে চলা হয় শতাব্দীপ্রাচীন আজব সব রীতিনীতি। রহস্যে মোড়া গুম্ফাগুলোর দেওয়ালে প্রতিধ্বনি তোলে পুরোহিতের মন্ত্র, ক্যানভাসে দক্ষ হাতে একের পর এক নয়নজুড়ানো নিপুণ থাংক (পটচিত্র) এঁকে যায় গেরুয়া রঙের পোশাকে মোড়া সন্ন্যাসী চিত্রকরেরা।
সাধারণ মানুষ ফিরে যেতে চায় যাযাবরবৃত্তিতে, পশুচারণের আদিম পেশায়। সেইসাথে তিব্বত এখনো নিষিদ্ধ দেশ পৃথিবীজুড়ে। আজও এদেশ নানারকম আজব রীতি-নীতি আর নিয়মকানুনের বেড়াজালে ঘেরা।
এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় রহস্য হচ্ছে রাজধানী ‘লাসা’, যাকে বলা হয়ে থাকে ‘নিষিদ্ধ নগরী’। একে নিষিদ্ধ নগরী বলার পেছনেও রয়েছে অনেক কারণ। লাসা শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘ঈশ্বরের স্থান’। তিব্বতিদের জীবনে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আর ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক স্থানগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে এই শহর। তিব্বতিদের প্রধান ধর্মগুরু দালাইলামার বাসস্থানও লাসার পোতালা প্রাসাদে। শোনা যায় এই প্রাসাদের চূড়া সোনার তৈরি।
তবে এখন রহস্যেঘেরা এ দেশটিতে মানুষের যাতায়াতে আর তেমন বাধা নেই। চীন সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বিশেষ কিছু স্থান ছাড়া তিব্বতের প্রায় সব অঞ্চলেই ভ্রমণ করা যায়। সে ক্ষেত্রেও রয়েছে বিভিন্ন রীতি রেওয়াজ। মেনে চলতে হয় আজব কিছু রীতিনীতি ও নিয়ম কানুন।
বরফ ঘেষা তীব্বত যেন সমস্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। আপনি একদিকে বরফ চূড়া দেখবেন অন্যদিকে দেখবেন নীরব কিংবা জাগ্রত ঝর্না বয়ে যাচ্ছে অদূরে। হয়তো হারিয়ে যাবেন সেখানকার নদী বহমান চলাচলে। তিব্বতের রাজধানী লাসায় তাপমাত্রা গড়ে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে -১৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস। তাই সেখানে অভিযোজন না করতে পারলে বেঁচে থাকা একপ্রকার দুষ্কর বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। তিব্বতে ঘুরে আসতে হলে আপনাকে চীনের রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার থেকে আগে ভিসা পেতে হবে। আমার জানা মতে প্রক্রিয়াটা খুব বেশি জটিল নয়।
This is a Bengali article. It is about why Tibet is a forbidden country?
Necessary references have been hyperlinked inside the article.
Featured Image: The Daily Star