ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউরােলজি অ্যান্ড মেডিক্যাল এডুকেশন বিভাগের গবেষকদের মতে, বাচ্চা জন্মের সময় থেকেই তাদের মস্তিষ্কে সহজাতভাবে কিছু আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের ধারণা ও শক্তি বর্তমান থাকে যার সাহায্যে সে তার চারপাশে দৃশ্যমান কিংবা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায় এমন সব কিছুকে ভাল ও মন্দ এই দুটি ভাগে ভাগ করে ফেলার প্রবণতা প্রকাশ করে!
শুধু তাই নয়, তারা আরও বলেন, বিভিন্ন ব্রেইন ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাপ্ত উপাত্ত প্রমাণ করে যে, বিভিন্ন ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান পালন করার সময় আমাদের মস্তিস্কের বিশেষ একটি অংশ অধিক ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। এই অধিক ক্রিয়াশীল অংশকে গবেষকরা ‘গড স্পট’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন!
তাহলে কি আধ্যাত্মিক চেতনার পিছনের রহস্য আমাদের নিজেদের শরীরেই বর্তমান আছে? উত্তরটা লুকিয়ে থাকতে পারে আমাদের মস্তিষ্কের কোন এক অত্যন্ত রহস্যময় অংশের মধ্যে! এই রহস্যময় অংশের অবস্থান আমাদের দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী অংশ বরাবর মস্তিষ্কের ভিতরে মস্তিষ্কের দুই গােলার্ধের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থানে যা পিনিয়াল গ্রন্থি নামে পরিচিত। আর হ্যাঁ, এই পিনিয়াল গ্রন্থিই বিভিন্ন ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান পালন করার সময় অধিক ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে বলে গবেষকদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
অর্থাৎ, এই পিনিয়াল গ্রন্থিকেই ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউরােলজি অ্যান্ড মেডিক্যাল এডুকেশন বিভাগের গবেষকরা ‘গড স্পট’ হিসাবে অভিহিত করেছেন। মস্তিষ্কের এই রহস্যময় অংশকে প্রাচীন মিশরীয় এবং বিভিন্ন ধর্মালম্বীরা ‘৩য় নয়ন’ হিসাবে আখ্যা দিয়ে এসেছেন।
৩য় নয়নের সক্রিয়করণ আমাদের আইকিউ স্কোর এবং আধ্যাত্মিক-মানসিক ক্ষমতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। এই ৩য় নয়ন এমন একটি চোখ যার যত বেশী খুলে যাবে কিংবা যত বেশী সক্রিয় হবে, আমরা তত বেশী অদেখাকে ও অজানাকে নিয়ে কল্পনা করার শক্তি অর্জন করতে পারবে, প্রাত্যহিক
জীবনে আমাদের কর্মকাণ্ডের সম্ভাব্য ফলাফলগুলােকে আমাদের মনের আয়নায় ভাসিয়ে তােলার ক্ষমতা অর্জন করি, বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমুলক কর্মকাণ্ডকে শনাক্ত করতে তত বেশী সক্ষম হই।
বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মগুলাে আদি কাল থেকেই এই ৩য় নয়নকে উজ্জীবিত করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে আসছেন। ‘ওম ধ্বনি’, ‘বিশেষ দৈর্ঘ্যের শব্দ তরঙ্গ’ কিংবা ‘ধ্যান’। এই সকল পদ্ধতিরই অংশবিশেষ। বিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি সত্ত্বেও পিনিয়াল গ্রন্থির কার্যকলাপগুলাে বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও অনেকাংশেই অজানা রয়ে গেছে। আর এই রহস্যের আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলে দেয় বিংশ শতাব্দী শেষ ও একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে জন্ম নেয়া কিছু রহস্য মানব।
আশ্চর্যজনকভাবে এরা নিজেদের মধ্যে বাক্য বিনিময় ছাড়াই অজানা উপায়ে একজনের সাথে আরেকজন অনেক তথ্য আদান-প্রদানে সক্ষম বলে গুজব ওঠে যাকে ‘টেলিপ্যাথি’ (কোয়ান্টাম ফিজিক্সের ভাষায় ‘নন লােকালিটি অফ ইনফরমেশন’) বলে অভিহিত করা হয়।
এই তথ্য আদান-প্রদানের সময়ও ম্যাগনেটিক রিজোনেন্স ইমেজিং এর মাধ্যমে তাঁদের পিনিয়াল গ্রন্থিকে অতিমাত্রায় সক্রিয় হতে দেখা গেছে। তাদেরকে আমেরিকান লেখক Manny Coto এর রচিত বিখ্যাত কল্পকাহিনী ‘স্টার কিড’ এর নাম
অনুসারে ‘স্টার কিড’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
‘নন লােকালিটি অব ইনফরমেশন বা কোয়ান্টাম ননলােকালিটি’-এর ধারণাটি ‘কোয়ান্টাম এনটেংগেলমেনট’ এর সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িত। ধরা যাক, দুইটি কোয়ান্টাম কণিকা নিকটবর্তী দুইটি বিন্দুতে অবস্থান করছে। কণিকা-১ এর সাথে কণিকা-২ এর মিথস্ক্রিয়া ঘটার পর কণিকা-১ বহু দূরে চলে গেল । এই দুরত্নের ব্যাপ্তি হতে পারে বিলিয়ন বিলিয়ন আলােকবর্ষ। মনে করি মিথস্ক্রিয়া ঘটার পর কণিকা-১ মঙ্গল গ্রহে চলে গেছে এবং কণিকা-২ পৃথিবীতে রয়ে গেল।
দেখা গেল, মঙ্গল গ্রহে কণিকা-১ এর উপর নিরীক্ষণ চালানাের কিংবা কণিকা-১ এর কোনাে পরিবর্তন ঘটানাের তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে টেলিপ্যাথির অবতারণা করে কণিকা-২ এর কাছে পৌঁছে গেছে। যদিও বা পৃথিবী থেকে মঙ্গল গ্রহের গড় দুরত্ব প্রায় ১৮০ আলােক সেকেন্ড । অথচ, আলাের কাছাকাছি বেগে রওয়ানা করলেও মঙ্গলে পৌঁছতে ১৮০ সেকেন্ডের বেশি সময় প্রয়ােজন।
দূরবর্তী কণাগুলােকে এভাবে এনটেনগেলড বা বিজড়িত অবস্থায় সংযুক্ত রাখতে হলে কণাগুলােকে একবার হলেও একত্রে থাকতে হয়। সেটা নিকট অতীত হােক কিংবা হােক দূর অতীতে। বিগব্যাং থিওরি অনুসারে, মহাবিশ্বের সূচনা লগ্নে সমস্ত বস্তু ক্ষুদ্র বিন্দুতে একত্রিত ছিল এবং মহাবিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্ব বর্তমান অবস্থায় আসে। যদি বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে কোয়ান্টাম এনটেংগেলমেনট এর একটি প্রাথমিক শর্ত হতে পারে!
অর্থাৎ, কোয়ান্টাম কণিকা ২টি পরস্পরের সাথে আলাের গতির থেকে অনেক দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান করছে। তাদের মাঝে দূরত্ব যাই হােক না কেন। তারা আইনস্টাইনের ‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি’কে বুড়াে আঙ্গুল দেখিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে একে অপরের পরিবর্তনে সাঁড়া দিতে এবং সংকেত আদান প্রদান করতে পারে যা এক মহাবিস্ময়!
এ ধরণের ২টি কণিকাকে ‘এনটেনগেলড কোয়ান্টাম পার্টিকেল’ বা ‘বিজড়িত কোয়ান্টাম কণিকা’ বলা হয়। পদার্থবিদ অ্যালান অ্যাসপেক্ট আশির দশকের দিকে ‘কোয়ান্টাম ননলােকালিটি’কে প্রমাণ করতে সমর্থ হন। তাহলে কি ‘স্টার কিড’দের রহস্যের পিছনে এই ‘কোয়ান্টাম এনটেংগেলমেনটাই জড়িত?
আরো পড়ুনঃ
আর এখানে পিনিয়াল গ্রন্থির সক্রিয় হবার কারণটাই বা কী? এ এক অমীমাংসিত রহস্য! দূরবর্তী কণাগুলােকে এভাবে এনটেনগেলড বা বিজড়িত অবস্থায় সংযুক্ত রাখতে হলে কণাগুলােকে একবার হলেও একত্রে থাকতে হয়। সেটা নিকট অতীত হােক কিংবা হােক দূর অতীতে। বিগ ব্যাং থিওরি অনুসারে, মহাবিশ্বের সূচনা লগ্নে সমস্ত বস্তু ক্ষুদ্র বিন্দুতে একত্রিত ছিল এবং মহাবিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্ব বর্তমান অবস্থায় আসে।
যদি বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে কোয়ান্টাম এনটেংগেলমেনট এর একটি প্রাথমিক শর্ত হতে পারে। পিনিয়াল গ্রন্থি নিয়ে সব থেকে বেশি গবেষণা করেছেন এমন ব্যক্তিদের নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই চলে আসবে বিখ্যাত গণিতবিদ ও দার্শনিক René Descartes (১৫৯৬-১৬৫০) এর নাম। René Descartes হিউম্যান এনাটমি এবং ফিজিওলজির প্রতি অনেক আগ্রহী ছিলেন।
বলা হয়ে থাকে, যদি তিনি আজ অবধি বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রকে অনেকাংশেই গণিতের মাধ্যমে প্রকাশ করে ফেলতেন। তিনি মানবদেহকে একটি বিশেষ ধরণের মেশিন হিসেবে আখ্যা দেন। তাঁর মতে, মেশিন আর মানব দেহের মধ্যে একটাই পার্থক্য; মেশিনের মন নেই, প্রাণ নেই কিন্তু মানব দেহে তা বর্তমান।
তবে এই দেহ, মন এবং প্রাণের সংযােগস্থল কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন দেহ, মন এবং প্রাণের সংযােগস্থল মস্তিষ্কের গভীরে পিনিয়াল গ্রন্থিতে। তিনি পিনিয়াল গ্রন্থিকে ‘আত্নার মূল আসন’ (Principal Seat of Soul) হিসেবে দাবি করেন!
৩য় নয়ন নিষ্ক্রিয়করণ ও ষড়যন্ত্র
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আমরা যে সকল রাসায়নিক পদার্থ নাড়াচাড়া করি কিংবা যে সকল খাবার খাই তার কিছু কিছু পিনিয়াল গ্রন্থি তথা ৩য় নয়ন নিষ্ক্রিয়করণে ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ৩য় নয়ন নিষ্ক্রিয়করণে সব থেকে বড় কালপ্রিট ফ্লুরাইড’।
ফ্লুরাইড রক্তের মাধ্যমে পিনিয়াল গ্ল্যান্ডে জমা হয়ে পিনিয়াল গ্ল্যান্ডের কার্যক্ষমতাকে হ্রাস করে দেয়। জানা গেছে, নাজি’রা তাদের বন্দীদের আইকিউ স্কোর কমিয়ে নিজেদের বশে আনার জন্য কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প এ ফ্লুরাইডযুক্ত পানি সরবরাহ করতাে। শুধু তাই নয়, আমেরিকায় কমিউনিস্টরা জনগণকে মানসিক শক্তির দিক থেকে নপুংসক করার অংশ হিসাবে পানিতে ফ্লুরাইড মিশাচ্ছেন বলে ষাটের দশকের দিকে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা দাবি করেন।
৩য় নয়ন সক্রিয়করণ
শুরুতেই বলে এসেছি, বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মগুলাে আদিকাল থেকেই এই ‘৩য় নয়ন’ কে উজ্জীবিত করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে আসছেন। ‘ওম ধ্বনি’, ‘বিশেষ দৈর্ঘ্যের শব্দ তরঙ্গ’, ‘সূর্য স্নান’ কিংবা ‘ধ্যান’ এই সকল পদ্ধতিরই অংশ বিশেষ। এছাড়া আয়ােডিন পিনিয়াল গ্রন্থির নিষ্ক্রিয়করণকে প্রতিহত করে ৩য় নয়ন সক্রিয়করণে শক্ত ভূমিকা পালন করে।
পিনিয়াল গ্রন্থি নিয়ে আরও প্রচুর মজার ব্যাপার শেখার আছে। কীভাবে পিনিয়াল গ্রন্থি আমাদের দেহ ঘড়ি হিসেবে কাজ করে, কীভাবে ‘আমরা কখন ঘুমাবাে, কখন ঘুম থেকে জেগে উঠব’-সহ আরও অনেক শরীরবৃত্তিয় ঘটনার কলকাঠি নিয়ন্ত্রণ করে ইত্যাদি আরাে অনেক কিছু!
আগ্রহ থাকলে পাঠকরা হয়ত একদিন এর রহস্য উৎঘাটন করতে এগিয়ে আসবে। তাতদিনে চিকিৎসা শাস্ত্রেও অনেক উন্নতি হবে। হয়ত একদিন সত্যিই পিনিয়াল গ্রন্থির রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হবে।
This is a Bengali article. It’s about pineal gland. all the reference are hyperlinked within article.
Featured Image: Getty image