ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাসের মধ্যে এনায়েতুল্লাহ আশতামাশ ও নসীম হিজাযীর বই আমার খুব ভালো লাগত। আলতামাশের ‘স্পেনের রূপসী কন্যা’ থেকে শুরু করে ‘আরব কন্যার আর্তনাদ’সহ প্রায় সব বই পড়ে শেষ করে ফেলেছি। আশ্রিত উপন্যাস পড়ার বদৌলতেই নসীম হিজাযী সম্পর্কে জানতে পারলাম। প্রথমে পিডিএফ ডাউনলোড করে নসীম হিজাযীর বই পড়তাম। অনেক বই কিনেও পড়া হয়েছে।
এই বইগুলো পড়তাম মূলত ইতিহাসকে জানার জন্য। সত্যিই এই বইগুলো মুসলমানদের ঈমানকে মজবুত করে। স্মরণ করিয়ে দেয় মুসলমানদের হারানো অতীতকে, হারানো গৌরবকে। কিন্তু এরপর বড় একটা ধাক্কা খেলাম যখন স্বয়ং ইতিহাসের বই পড়তে শুরু করলাম। বুঝতে পারলাম কেন উপন্যাসিকরা বার বার প্রেমিক পুরুষদের টেনে আনে। মনে হত একজন বীর যে ঈমানের বলে বলিয়ান থাকার কথা, সে বার বার কেন প্রেয়সীর কাছে তার বীরত্ব লুটিয়ে দিচ্ছে। বীরত্বের পাশাপাশি সমান তালে প্রেম চালিয়ে যাচ্ছে। অন্তত একজন মুসলিম বীরে পক্ষে এটা শোভনীয় নয়।
ইতিহাসের বই পড়ার পর আবিস্কার করলাম, এগুলো নিছক উপন্যাস, ইতিহাস নয়। স্থান, কাল, পাত্র ঠিক রাখা হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিছু রূপকথার কাল্পনিক চরিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে গল্পের প্রেক্ষাপট। প্রেক্ষাপট সত্য কিন্তু গল্প সত্য নয়। এটা ঠিক ইতিহাসের বিকৃতি নয়, কিন্তু সঠিক ইতিহাসও নয়। বীরত্বের পাশাপাশি প্রেম নিয়ে আসা হয়েছে পাঠকের মনোরঞ্জন করার জন্য, পাঠকের একঘেয়েমি দূর করার জন্য, রসহীন সাহিত্যকে আকর্ষণীয় করার জন্য। এ সমস্ত উপন্যাসে যে নারী চরিত্র ও প্রেমের গল্প উপস্থাপন করা হয় তা স্পষ্টত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে বেমানান। আর ১২’শ শতকে ইসলামী স্বর্ণালীযুগে এসবের যে স্থান ছিল না, এ কথা আমরা বেশ ভালো করেই জানি।
সম্প্রতি তুর্কি ড্রামা সিরিয়াল ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। দিরিলিস শব্দের অর্থ রেজারেকশন বা পুনর্জন্ম, আর এটি তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার আগের ইতিহাস নিয়ে তৈরি। ত্রয়োদশ শতকে ওঘুজ তুর্কীদের নেতা এবং সে দেশের কিংবদন্তী নায়ক আরতুগ্রুলের জীবন নিয়েই বাঁধা হয়েছে এর গল্প। এই আরতুগ্রুল ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমানের পিতা।
তবে এই ড্রামা সিরিজটিকে হারাম ফতোয়া দিয়েছে মিসরের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ইফতা কাউন্সিল ‘দারুল ইফতা’। সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত আরো আগেই হারাম ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের অধিকাংশ আলেমরাও ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’কে হারাম বলছে। এ ক্ষেত্রে মি. জাকির নায়েক এর মতামতকে বেশ গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন-
এটাতে এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো হারাম, তবে ঐ লেভেলের হারাম না যা হলিউড ও বলিউডে দেখানো হয়। মানুষ যদি হলিউড-বলিউড ছেড়ে দিয়ে ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’ দেখে তবে দেখতে পারে। কিন্তু কেউ যদি মুভি বা ড্রামার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে থাকে তাহলে এইটা তার জন্য দেখা উচিত না। কারণ, এইটা শতভাগ হালাল নয়। এখানে নন-মাহরাম নারীদের পর্দা ছাড়াই প্রদর্শন করা হচ্ছে, আরতুগ্রুলকে বীরত্বের পাশাপাশি প্রেমিক পুরুষ হিসেবেও উপস্থাপন করা হচ্ছে। স্পর্শ, আলিঙ্গন, মিউজিকসহ এমন কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো স্বাভাবিকভাবেই ইসলামী শরিয়তে সম্পূর্ণেরূপে হারাম। মুসলিম ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়েছে কিংবা মাঝে মাঝে অভিনেতা/অভিনেত্রীরা আল্লাহকে স্মরণ করছে, শুধুমাত্র এই অজুহাতে এটাকে হালাল মনে করার কোনো সুযোগ নেই। হারামকে হালাল মনে করাটাও একটা হারাম।
বাস্তবিক পক্ষে এখানে ইতিহাসের মূল থিমটা ঠিক রাখা হয়েছে। কিন্তু দর্শক ধরে রাখার জন্য যে পরিমাণ মসলা মেশানো হয়েছে, বাস্তবে ইতিহাস এতটা মসলাদার নয়। দর্শকের মনোরঞ্জনের সব ব্যবস্থায় রাখা হয়েছে এখানে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইতিহাস সব সময় বিজয়ীর কলমে লেখা হয়। দিরিলিস আরতুগ্রুল এর বিভিন্ন দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে যে কায়ী গোষ্ঠীর একজন সৈন্য শত্রুপক্ষের শতাধিক সৈন্যের মোকাবেলায় বিজয় অর্জন করছে। যদিও আমরা জানি যে তুর্কিরা বীরের জাতি, তবুও এসব দৃশ্যায়ন নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়।
তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এটার পক্ষে কথা বলেছে। এই বিষয়টা বার বারই সামনে আসছে। মি. এরদোয়ানতো ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’ এর পরিচালক মেহমেদ বোজদাগকে সপরিবারের প্রেসিডেন্সিয়াল হাউজে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আবার অনেক ক্ষেত্রেই অভিনেতা/অভিনেত্রীদের বেপরোয়া ব্যক্তিগত জিবন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। আসলে এই দুইটি বিষয়ই ইতিহাসের সাথে অপ্রাসঙ্গিক। কেননা এরদোয়ান বা ইমরান খান এর পক্ষে কথা বললেই বিকৃত ইতিহাস সত্য হয়ে যাবে না। আবার কারো ব্যক্তিগত চরিত্র বা লাইফস্টাইল ইতিহাসের মধ্যে টেনে নিয়ে আসাও চরম বোকামি।
মুসলিম বিশ্বের নানা দেশে দারুণ জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর এই এপিক তুর্কী ড্রামাটি এখন কাশ্মীর-সহ ভারতের মুসলমানদের মধ্যেও ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পাঁচটি সিজনে পরিব্যাপ্ত ৪৪৮টি এপিসোড বা পর্বের এই বিশাল উপাখ্যান অনেকে মাত্র এক-দেড় মাসের মধ্যেও পুরোটা দেখে ফেলেছেন।
ভারতবর্ষে দিরিলিসের প্রচার ও জনপ্রিয়তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই ড্রামা সিরিয়ালের বীরত্বের প্রভাবে ভারতীয় মুসলিমরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে কিনা সেটা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে ভারতের সমাজব্যবস্থার উপর দিরিলিসের প্রভাব নিয়ে একটি জরিপও পরিচালনা করা হয়েছে। গবেষণা দলে অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ড. ইকরামুল হক বিবিসির এক সাক্ষাতকারে বলেন-
ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণে ভারতীয় মুসলিমরাও হয়তো এই তুর্কী গল্পটা ভালবেসে ফেলছেন, একাত্ম বোধ করছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রতি এর মাধ্যমে তাদের কোনও মুগ্ধতা তৈরি হচ্ছে। আসলে এটা শেষ পর্যন্ত ড্রামা-ই, কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা কূটনীতির সঙ্গে এর তেমন সম্পর্ক আছে বলে মনে করি না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, কাশ্মীরের সোপোর, পুলওয়ামা বা বারামুলা-তে এর আগে কস্মিনকালেও ‘আরতুগ্রুল’ নামে কেউ ছিল না। অথচ গত দু-তিন বছরে ভ্যালিতে যে শিশুরা জন্মেছে, সেই নবজাতকদের অনেকেরই বিবিসির এক সাক্ষাতকারে।
শীতের মরশুমে তো কাশ্মীরে দেখা যাচ্ছে আর্তুগ্রুল স্টাইলে’র টুপিও। গাঢ় ওয়াইন-রঙা এই ধরনের মাথা ও কান-ঢাকা ফার বা পশমী টুপি তুরস্কে খুব জনপ্রিয় হলেও কাশ্মীরে তা কিন্তু কখনওই পরার কোন চল ছিল না। আর এই সব পরিবর্তনের পেছনেই আছে তুর্কী ড্রামা সিরিজটি।
দিরিলিস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে তুরস্ক কি চাইছে?
মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই মনে করে, এই ড্রামা সিরিয়ালের মধ্যে দিয়ে তুরস্ক কূটনীতিতে তাদের ‘সফট পাওয়ার’ প্রয়োগ করতে চাইছে। দিরিলিস আরতুগ্রুল ঠিক কী ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তা দিচ্ছে, তা নিয়ে বিতর্কের জেরে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মিশরে এই সিরিজগুলো এরই মধ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সম্ভবত খুব শীঘ্রই বাহরাইনেও নিষিদ্ধ করা হবে।
অশ্লীলতা, ইতিহাস বিকৃতি কিংবা আরবের সংস্কৃতির পরিপন্থী হওয়ার জন্য যে এই ড্রামা সিরিজটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে এমন নয়। সেদেশে বলিউড ও হলিউডের রঙিন চলচিত্রগুলো ভালোই জনপ্রিয়। সেটা নিষিদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ কোনোকালেই নেয়া হয়নি। তাহলে দিরিলিস আরতুগ্রুল কেন নিষিদ্ধ করা হলো? আসলে বিষয়টা রাজনৈতিক।
অভিযোগ রয়েছে এই সিরিজ প্রচারের মধ্য দিয়ে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তুরস্কের অতীত ইতিহাস বিশ্ববাসীকে জানান দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই আরব বিশ্ব কোনোভাবেই এটা মেনে নেবে না, কারণ আরব বিশ্বের ওহাবী, সালাফিবাদের সাথে সুফিবাদী উসমানীয়দের বিরোধিতার ইতিহাস অনেক পুরনো।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মিশরের সর্বোচ্চ ফতোয়া কাউন্সিল এক বিবৃতিতে এমনও বলেছে যে এই ড্রামার মাধ্যমে তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে তাদের নিজস্ব ‘প্রভাব বলয়’ তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আরব বিশ্বের জনগণকে তুর্কিবাদী করার একটা পাঁয়তারা চালাচ্ছে বলেও জানাচ্ছে মিশর। তবে পাশাপাশি তুরস্কের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ পাকিস্তানে কিন্তু আরতুগ্রুল অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রায়ত্ত পিটিভি এই সিরিয়ালটির প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে মিলে আরতুগ্রুলের জন্য আলাদা একটি ইউটিউব চ্যানেলও চালু করেছে, যেখানে উর্দু ডাবিংয়ে এই নাটকটির সব এপিসোড দেখা যায়। ওই ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৮৮ লক্ষেরও বেশি। গত জুন মাসে তুর্কী সংবাদ সংস্থা টিআরটি ওয়ার্ল্ড জানিয়েছিল, পাকিস্তানের লাহোর শহরে আর্তুগ্রুল গাজীর দুটি মূর্তিও বসানো হয়েছে।
তবে আরতুগ্রুল সিরিজ নিয়ে খোদ তুরস্কের ভেতরেও কিন্তু বিতর্ক থেমে নেই। সে দেশে ‘দিরিলিস: আরতুগ্রুল’-এর সমালোচকরা মনে করেন যে এই সিরিজের মাধ্যমে সুকৌশলে যে মুসলিম জাতীয়তাবাদের বার্তা দেওয়া হয়েছে, তা প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে তার ক্ষমতা সংহত করতে সাহায্য করছে। এর মধ্যদিয়ে তিনি নিজেকে মুসলিম বিশ্বের ত্রাণকর্তা হিসেবে পরিচিত করতে চাচ্ছেন। আর এসব কাজে তিনি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’ ও ‘কুরুলুস উসমান’ এর মতো ড্রামা সিরিজগুলোকে।
এমনকি, এই সিরিজের লেখক ও প্রযোজক মেহমেত বোজদাগ-ও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। এরদোয়ান নিজেও বহুবার প্রকাশ্যে এই সিরিজের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। শুধু কি তাই! তিনি একবার স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে দিরিলিস শ্যুটিংয়ের সেটে চলে যান। অভিনেতা ও টেকনিশিয়ানদের সাথে কুশল বিনিময় করেন। শুধু তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নয় ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরাও দিরিলিসের সেটে আসেন। এমনকি তুর্কি যোদ্ধাদের টুপিও পরে থাকতে দেখা যায় তাকে।
সবমিলিয়ে এই ড্রামা সিরিজের মধ্যদিয়ে তুরস্ক বিশ্বে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। একই সাথে ক্ষমতা সুসংহত করতে ও মুসলিম বিশ্বের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হতে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানও এধরণের ড্রামা সিরিজগুলোকে ব্যবহার করছেন।
This is a Bangla article. It discusses the Turkish drama serial Dirilis: Artugrul and Turkey’s political strategy.
All the references are hyperlinked within the article.
Featured Image: Daily Sabah