আপনার যদি কোন তথ্য খোঁজার দরকার হয়, তাহলে আপনি সার্চ করেন গুগলে। কোমল পানীয় এর কথা ভাবলে বিশ্বব্যাপী মানুষজন চিন্তা করেন কোকাকোলা বা পেপসির কথা। ফাস্টফুডের ব্যাপারে সবার আগে মাথায় আসে ম্যাকডোনাল্ডস বা কেএফসির কথা। একইভাবে আপনি যদি অনলাইনে মুভি বা সিরিজের বিঞ্জ ওয়াচ করতে চান, তাহলে সবার আগে মনে আসবে নেটফ্লিক্সের কথা। নেটফ্লিক্সে কোনকিছু স্ট্রীম করার ব্যাপারটা এতটাই কমন হয়ে গেছে যে ‘নেটফ্লিক্স অ্যান্ড চিল‘ নামে একটি ইন্টারনেট স্ল্যাং এর আবিষ্কার করে ফেলেছেন নেটিজেনরা।
শিরোনাম দেখে হয়তো এতক্ষণে পাঠকরা আন্দাজ করে ফেলেছেন আজকে আমাদের লেখার বিষয়বস্তুর ব্যাপারে। হ্যাঁ, এই নেটফ্লিক্সের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলোই জানাতে চেষ্টা করবো আজ। তো, দেরি না করে চলুন মূল লেখায় প্রবেশ করি।
প্রথমেই আসুন জেনে নিই নেটফ্লিক্স কি সেটা সম্পর্কে। একদম সোজা কথায় বলে গেলে, নেটফ্লিক্স ইনকর্পোরেটেড হলো একটি আমেরিকান ওভার-দ্যা-টপ কন্টেন্ট প্ল্যাটফর্ম (ওটিপি) এবং প্রোডাকশন কোম্পানি। এটির হেডকোয়ার্টারের অবস্থান ক্যালিফোর্নিয়ার লাওস গেটোসে। ১৯৯৭ সালে রিড হেস্টিংস এবং মার্ক র্যানডল্ফ মিলে প্রতিষ্ঠা করেন এই কোম্পানির। তখন এটির অবস্থান ছিলো ক্যালিফোর্নিয়ার স্কটস ভ্যালিতে।
নেটফ্লিক্সের জন্ম হয় ২৩ বছর আগে ১৯৯৭ সালের ২৯শে আগস্ট। তখন পিওর এট্রিয়া নামে একটি কোম্পানির মালিক ছিলেন হেস্টিংস; আর সে কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মার্ক র্যানডল্ফ। এছাড়া মাইক্রোওয়্যারহাউজ নামে একটি কম্পিউটার মেইল অর্ডার কোম্পানির কো-ফাউন্ডারও ছিলেন র্যানডল্ফ। তিনি কাজ করেছেন বোরল্যান্ড ইন্টারন্যাশনালেও। এবছরই হেস্টিংস তার পিওর এট্রিয়াকে র্যাশনাল সফটওয়্যার কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেন ৭০০০ মিলিয়ন ডলারে। তৎকালীন সময়ে সিলিকন ভ্যালিতে এটাই ছিলো সবচেয়ে বড় অংকের অধিগ্রহণের ঘটনা।
তো, এই অধিগ্রহণের জন্য প্রয়োজন ছিলো সরকারী অনুমোদনের। অনুমোদন আসার আগের সময়টাতে হেস্টিংস এবং র্যানডল্ফ স্যান্টা ক্রুজের নিজেদের বাসায় এবং পিওর এট্রিয়ার সানিভেলের অফিসে একে অপরের সাথে প্রচুর আলাপ-আলোচনা করেন। আর তখনই নেটফ্লিক্সের চিন্তা তাদের মাথায় আসে। তবে এই আইডিয়া আসার ব্যাপারটি নিয়ে হেস্টিংস একেক জায়গায় একেক ধরণের বক্তব্য রেখেছেন।
হেস্টিংস নেটফ্লিক্সে ২.৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন। প্রথম থেকেই র্যানডল্ফ অ্যামাজনের আনকোরা ই-কমার্স বিজনেস মডেলের ভক্ত ছিলেন৷ তিনি একই মডেল ব্যবহার করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আরো বেশি ক্যাটাগরির সহজে বহনযোগ্য পণ্য বিক্রির পথ খুঁজছিলেন। প্রথমদিকে তারা ভেবেছিলেন ভিএইচএস টেপ রেন্টিং এর দিকে আগাবেন। কিন্তু ভিএইচএস টেপ স্টক করা ছিলো অনেক ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার৷ এছাড়া এগুলো ছিলো খুবই নাজুক। তাই শিপিং করার সময়ও নানা সমস্যা দেখা দেয়। তাই ভিএইচএস টেপ রেন্টিং এর চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন তারা। সমসাময়িক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মত ডিভিডি প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হয়। তারাও এই প্রযুক্তি ব্যবহারের চিন্তা করেন। তারা প্রথমে ডিভিডি রেন্টিং এর ব্যাপারে পরীক্ষা করার জন্য হেস্টিংস এর স্যান্টা ক্রুজের বাসায় মেইলের মাধ্যমে একটি ডিভিডি পাঠান। এই ডিভিডি অক্ষত অবস্থায় পৌঁছানোর ফলে তারা এই প্রযুক্তিকে নিজেদের স্টার্টআপে ব্যবহারের ব্যাপারে সম্মত হন। ফলে তারা সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পড়েন তৎকালীন সময়ে ১৬ বিলিয়ন ডলারের বিশাল হোম ভিডিও সেলস অ্যান্ড রেন্টাল ইন্ডাস্ট্রির।
হেস্টিংসকে মাঝে মাঝেই বলতে শোনা গেছে তিনি নেটফ্লিক্স শুরু করার কথা ভাবেন কারণ অ্যাপোলো থার্টিন (১৯৯৫) নামক মুভিটি ফিরিয়ে দিতে দেরি হওয়ায় ব্লকবাস্টার তাকে ৪০ ডলার জরিমানা করেছিলো। কিন্তু এই বক্তব্যের কোন সত্যতা পাওয়া যায় নি বরং ভাবা হয় নেটফ্লিক্সের বিজনেস মডেল এবং তারা কোম্পানি হিসেবে কি করতে চায় তা বোঝানোর সহজ পন্থা হিসেবে হেস্টিংস এই গল্প বলেন নানা জায়গায়।
বিশ্বের প্রথম অনলাইন ডিভিডি রেন্টাল স্টোর হিসেবে নেটফ্লিক্স যাত্রা শুরু করে ৩০ জন কর্মী নিয়ে। এসময় তারা অফার করতো মোট ৯২৫টি ডিভিডি। কারণ ঐসময় ডিভিডি প্রযুক্তিতে মাত্র ৯২৫টি মুভি বা সিরিজ-ই পাওয়া যেত। পে-পার-রেন্ট, ভাড়ার টাকা, ডিভিডি ফেরত দেওয়ার শেষ তারিখসহ তাদের প্রাথমিক বিজনেস মডেল ছিলো প্রতিদ্বন্দ্বী ব্লকবাস্টারের মতই।
আসুন আমরা এবার নেটফ্লিক্স কিভাবে এতদূর এলো তার একটি টাইমলাইনের দিকেনজর দেই :-
১৯৯৭ : ৯০০+ ডিভিডি টাইটেল নিয়ে যাত্রা শুরু করে নেটফ্লিক্স। তখন নিয়ম ছিলো ৭ দিনের মধ্যে ডিভিডি ফেরত দিতে হবে। প্রথমদিকে একটি ডিভিডি ভাড়া নিতে খরচ হতো ৫০ সেন্ট। ১৯৯৯ সালের এপ্রিলের মধ্যে নেটফ্লিক্সের ডিভিডি টাইটেলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩১০০ তে। ২০০০ সালের জানুয়ারিতে যেটি ৫২০০তে উন্নীত হয়।
১৯৯৯ : এবছর নেটফ্লিক্স নতুন সাবসক্রিপশন মডেল নিয়ে আসে। এই মডেল অনুসারে একজন কাস্টোমার ১৫.৯৫ ডলার সাবসক্রিপশন ফী এর বিনিময়ে একসাথে ৪টি মুভি নিতে পারতো। এসময় নির্দিষ্ট তারিখে ফেরত দিতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা ছিলো না।
২০০০ : এবছর মাসিক সাবসক্রিপশন ফী উন্নীত হয় ১৯. ৯৫ ডলারে। এসময় নেটফ্লিক্সের সাবসক্রাইবার সংখ্যা ছিলো প্রায় ৩ লক্ষ এবং তারা ইউএস পোস্টাল সার্ভিসের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল ছিলো। এবছরই তারা ব্যাপক লসের সম্মুখীন হয়। আর্থিক মূল্যে যার পরিমাণ ছিলো ৫৭ মিলিয়ন ডলার। নেটফ্লিক্স কর্তৃপক্ষ ৫০ মিলিয়ন ডলারে নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে ব্লকবাস্টারের কাছে বিক্রি করে দিতে চায় কিন্তু ব্লকবাস্টার এই প্রস্তাব গ্রহণ করে নি। সময়ের পরিবর্তনে আজ ব্লকবাস্টারের কথা লোকে ভুলে গেছে।
২০০১ : এই সময়ে নেটফ্লিক্স বেশ দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছিলো কিন্তু টেক রিলেটেড কোম্পানিগুলোর শেয়ারের হঠাৎ দাম বেড়ে আবার কমে যাওয়ায় তারা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। আবার নাইন-ইলেভেনের হামলার ফলেও বিপদে পড়ে তারা। এসবের ফলশ্রুতিতে তাদেরকে নিজেদের কর্মীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশকে ছাটাই করতে হয়। তবে এবছর আবার ডিভিডি প্লেয়ার খুব জনপ্রিয় হয় আমেরিকায়। যার ফল নেটফ্লিক্স পায় পরবর্তী বছরগুলোতে।
২০০২ : নেটফ্লিক্স তাদের শেয়ার পাবলিক করে। তাদের শেয়ারের প্রারম্ভিক মূল্য ছিলো ১৫ ডলার করে।
২০০০ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে নেটফ্লিক্স খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা এবং লাভ উভয় দিক থেকেই। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান তখনও লসেই চলছিলো। কেননা প্রতিষ্ঠান বড় হচ্ছিলো প্রতিনিয়ত এবং এই ক্রমবর্ধমান প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার খরচ বাড়ছিলো। কেবল ২০০২ সালের ১ম কোয়ার্টারে নেটফ্লিক্সের লসের পরিমাণ ছিলো ৪.৫ মিলিয়ন ডলার।
২০০৩-২০০৬ : এসময় নেটফ্লিক্স গ্রাহকদের ইউজার এক্সপেরিয়েন্স আরো সুখকর করার দিকে নজর দেয়। তারা সিনেম্যাচ র্যাংকিং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে গ্রাহক ভবিষ্যতে দেখতে আগ্রহী হবেন এমন মুভি বা সিরিজ রেকমেন্ড করতে শুরু করে।
২০০৬ সালের শেষে এসে দেখা যায় নেটফ্লিক্সের মোট সাবস্ক্রাইবারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.২ মিলিয়নে। টানা ৭ বছরের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধির হার পৌঁছে ৭৯% এ এবং কোম্পানি প্রথমবারের মত লাভের মুখ দেখে। এই লাভ ছিলো ৮০ মিলিয়ন ডলারের মত বিশাল অংকের। এই সবকিছুর মূলে ছিলো তাদের উদ্ভাবনী বিজনেস মডেল এবং অ্যালগরিদম।
২০০৭ : এই বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো নেটফ্লিক্সের জন্য। কেননা এবছরই অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিস গতি পায় এবং ডিভিডি প্লেয়ারের দিন শেষ হয়ে আসে। অনেকেই নেটফ্লিক্সের ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান ছিলেন৷ নেটফ্লিক্স এসময় ওয়াচ নাও নামক তাদের স্ট্রিমিং সার্ভিস শুরু করে। এখানকার লাইব্রেরিতে ১০০০ মুভি-সিরিজ ছিলো। তাদের ৫.৯৯ ডলারের মাসিক ডিভিডি সাবস্ক্রিপশনের সাথে স্ট্রিমিং সাইটের সাবস্ক্রিপশন ফ্রি ছিলো।
২০০৮ : এবছর নেটফ্লিক্স ঘোষণা করে যে তারা ডিভিডির রিটেইল সেলস বন্ধ করে দেবে। এই ঘোষণা আসার কিছুদিন আগেই তারা আমেরিকার প্রিমিয়াম ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক স্টার্জ এর সাথে চুক্তি করে। যার ফলে নেটফ্লিক্স সাবস্ক্রাইবাররা আরো ২৫০০টি নতুন মুভি বা সিরিজ দেখার সুযোগ পায়।
রিটেইল সেলিং ছিলো নেটফ্লিক্সের প্রমাণিত এবং নির্ভরযোগ্য আয়ের উৎস। কিন্তু রিটেইল সেলিং বন্ধ করে দেওয়ায় মানুষ বুঝতে পারে যে নেটফ্লিক্স কখনোই কেবল ডিভিডি রেন্টিং কোম্পানি হতে চায় নি।
২০১১ : এই বছর নেটফ্লিক্স তাদের বিজনেসকে ২ ভাগে ভাগ করার কথা চিন্তা করে। সেই ভাবনা অনুযায়ী তারা তাদের ডিভিডি রেন্টালকে রিব্র্যান্ডিং করে। এটির নতুন নাম দেওয়া হয় কুইকস্টার। স্ট্রীমিং সার্ভিসের নাম থাকে আগেরটাই। উভয় সার্ভিসের জন্য আলাদা আলাদা সাবস্ক্রিপশন ফীও নির্ধারণ করা হয়। এই সিদ্ধান্তকে বিনিয়োগকারী এবং ব্যবহারকারী উভয়ই খারাপ চোখে দেখে। ব্যবহারকারীদের চোখে এই সিদ্ধান্ত ছিলো কেবল আরো বেশী টাকা আয়ের পন্থা। এর ফলে অনেকে হেস্টিংস এর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং কোম্পানির ভবিষ্যতের ব্যাপারেও অনেকে সন্দিহান হয়ে পড়ে। এসময় সাবস্ক্রিপশন ফীও বাড়ানো হয় এবং এর ফলাফল হয় ভয়াবহ। ঐ গ্রীষ্মে প্রায় ৮ লাখ ব্যবহারকারী নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রিপশন রিনিউ করা থেকে বিরত থাকে। অনেকেই ভাবে এখানেই নেটফ্লিক্সের সমাধি রচিত হয়ে গেছে। কোম্পানির সিদ্ধান্তের এমন প্রতিফলনের ফলে লঞ্চিং এর আগেই কুইকস্টারকে বাতিল করে দেন হেস্টিংস।
কিন্তু এতকিছুর পরেও সফলতার সাথেই বছর শেষ করে নেটফ্লিক্স। ২০০৭ থেকে ২০১১ এই ৪ বছরে নেটফ্লিক্স ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ মিলিয়ন থেকে বেড়ে হয় ২৩ মিলিয়ন৷ শতকরা হিসেবে যার হার ২৮৩%। কুইকস্টারের মত ভুল সিদ্ধান্তের ফলে ছোটখাটো কোম্পানি হলে হয়তো ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হতো। কিন্তু হেস্টিংস আর নেটফ্লিক্স ভালোভাবেই এই ধাক্কা সামলে নেয়। আর স্ট্রিমিং জগতে নেটফ্লিক্সকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মত কেউ না থাকাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
২০১২ : ভুল সিদ্ধান্তের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা নেটফ্লিক্সকে এবছর মুখোমুখি হতো হলো আরো নানা সমস্যার। বিভিন্ন স্টুডি এবং মিডিয়া পাবলিশারদের সাথে তাদের সম্পর্ক হয়ে পড়লো খারাপ৷ ২০০৮ সালের পর স্টার্জ এর সাথে তারা ৩০ মিলিয়ন ডলারের আরো বড় চুক্তি করে। কিন্তু ২০১২ তে আরো বেশি অর্থের জন্য চুক্তি বাতিল করে দেয় স্টার্স। ফলে অনেক কন্টেন্ট নেটফ্লিক্স থেকে চলে যায়। এতে করে নিজেদের কন্টেন্ট নিয়ে নতুন করে ভাবতে হয় নেটফ্লিক্সকে।
আরো পড়ুনঃ
This is a Bangla article. Everything is written here about theNETFLIX
All links are hyperlinked.
Featured image taken fromGoogle