সৌন্দর্যচর্চায় সাজপোশাক ও অলঙ্কারের পাশাপাশি যে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্ববহ সেটি হলো পারফিউম বা সুগন্ধি। দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রতিনিয়ত যেসকল প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করে চলেছি, তন্মধ্যে সুগন্ধি অন্যতম। এটি আমাদের মনকে যেমন প্রফুল্ল রাখে, তেমনি আমাদের ব্যক্তিত্বের প্রকাশেও ভূমিকা রাখে। স্বাভাবিকভাবে যদি কারো শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হয়, তাহলে তার সাথে কথাবার্তা বলতে আপনি অতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না। অপরদিকে কারো শরীর থেকে যদি কোনোরূপ বাজে গন্ধ বের না হয়, তবে তার সাথে কথা বলার বলার ক্ষেত্রে কোন দ্বিধা কাজ করবে না৷ আর এক্ষেত্রে আমাদেরকে সহায়তা করতে পারে সুগন্ধির ব্যবহার। সময়ের সাথে সাথে পারফিউম ব্যক্তিত্ব, মনন এবং সৌখিনতার পরিচায়কে পরিণত হয়েছে। আজকে এই সুগন্ধি নিয়েই আমরা আলোচনা করতে যাচ্ছি। চলুন প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক সুগন্ধি কি?
পারফিউম বা সুগন্ধি
গন্ধ নিঃসারণকারী কিছু পদার্থের সঠিক অনুপাতে সুদক্ষ মিশ্রণের ফলে যে সুগন্ধযুক্ত পণ্য উৎপাদিত হয়, তাকে পারফিউম বা সুগন্ধি বলে। পারফিউম শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন শব্দ গুচ্ছ per fumumথেকে;যার ইংরেজি অর্থ “through smoke”বা “by means of smoke”.এটি দ্বারা এমন একটি পদ্ধতিকে বোঝায়, যার মাধ্যমে কোন পদার্থকে স্প্রে এর মত বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়া হয়৷ এরপর শূন্যে ভাসমান এই পদার্থের উপস্থিতি ঘ্রাণানুভূতির মাধ্যমে অনুভব করা যায়৷ প্রাচীন চীন, ভারত, মিশর, কার্থেজ, আরব, গ্রীক, রোমান এবং ইহুদিরা পারফিউম তৈরীর বিদ্যা জানতো। বাইবেলে সুগন্ধি দ্রব্যাদি এবং সুগন্ধি তৈরীর পদ্ধতির উল্লেখ পাওয়া যায়।
ইতিহাস
বর্তমানে আমরা সুগন্ধির যে রূপ দেখতে পাচ্ছি, অতীতে তার অবস্থা এরকম ছিলো না৷ প্রথমদিকে দেবতাদের উদ্দেশ্যে ফুল, গাছপালা বা লতাগুল্ম ও রজন উৎসর্গ করা হতো৷ এছাড়া এসময় সুগন্ধি তৈরীর পদ্ধতিতে শরীর এবং স্থানকে সুরভিত করা হতো। এই সুরভিত করার পেছনে স্বাস্থ্যগত এবং ধর্মীয় উভয় কারণই ছিলো। তখনকার সময়ের মানুষরা একে ‘বিশুদ্ধিকরণ’ বলে অভিহিত করতেন। পরবর্তীকালে আরো প্রগাঢ় সৌরভ সৃষ্টির লক্ষ্যে নানা ধরণের ধূপ, তেল, ভেষজ নির্যাস এবং গাঁজানো হয়েছে এমন তরলের ব্যবহার শুরু হয়। এগুলোকে প্রার্থনার পরিবেশ সৃষ্টি এবং ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
পারফিউমারি নামে পরিচিত সুগন্ধি তৈরীর বিদ্যার চল শুরু হয় প্রাচীন মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক), মিশর এবং সম্ভবত প্রাচীন চীনে। পরবর্তীতে এই বিদ্যার আরো উন্নতি সাধন করেন মুসলিম এবং রোমানরা।
টাপুতি-বেলাতেকালিমনামে একজন নারীকে পৃথিবীর প্রথম রসায়নবিদ বলে ধারণা করা হয়। তিনি ছিলেন একজন সুগন্ধি প্রস্তুতকারী। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দে মোসেপটেমিয়ায় বসবাস করতেন৷ কিউনিফর্মবা কীলকাকার ট্যাবলেটে তাঁর নামের উল্লেখ পাওয়া গেছে। তিনি অন্যান্য সুগন্ধি দ্রব্যাদির সাথে ফুল, তেল এবং ক্যালামাসের পাতন ঘটাতেন। তারপর ঐ মিশ্রণের পরিশ্রাবণ করতেন এবং বেশ কয়েকবার রসায়ন শাস্ত্রে ব্যবহৃত স্টীল নামক যন্ত্রের প্রাচীন সংস্করণে ঢালতেন৷ আর এভাবেই প্রস্তুত হতো টাপুতির পারফিউম।
ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতায় (খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০-১৩০০ সাল) সুগন্ধি এবং সুগন্ধি প্রস্তুতকারী বিদ্যার অস্তিত্ব ছিলো।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা ২০০৩ সালে সাইপ্রাসের পিরগস নামক স্থানে কিছু পারফিউমের সন্ধান লাভ করেন৷ এগুলোর বয়স ৪০০০ বছরেরও অধিক, মনে করা হয় এগুলোই এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে পুরাতন পারফিউমের নিদর্শন। এগুলো যেখানে পাওয়া যায় সেটি ছিলো একটি প্রাচীন সুগন্ধি প্রস্তুতকারী কারখানা। ৩০০ বর্গমিটার আয়তনের এই কারখানায় এসব সুগন্ধি ছাড়াও সুগন্ধি প্রস্তুতে ব্যবহৃত নানা ধরণের যন্ত্রপাতির সন্ধান মিলেছে।
৯ম শতকে আল-কিন্দিনামক আরব রসায়নবিদ ‘Book of the Chemistry of Perfume and Distillations’নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এতে ১০০টিরও বেশি নানা ধরনের সুগন্ধি এবং মূল্যবান ড্রাগ তৈরির প্রণালী লিপিবদ্ধ করেন তিনি। এছাড়াও এখানে সুগন্ধি তৈরীর ১০৭ ধরণের পদ্ধতি এবং নানা ধরণের পারফিউম তৈরীর যন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
পারস্যবাসী (বর্তমান ইরান) রসায়নবিদ ইবনে সিনা (যিনি ইউরোপীয়দের কাছে আভেসিনা নামে পরিচিত);পাতন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফুল থেকে নির্যাস নিষ্কাশন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন৷ বর্তমানে পারফিউম তৈরীর ক্ষেত্রে এটিই সর্বাধিক ব্যবহৃত প্রক্রিয়া৷ তিনি প্রথমে গোলাপ ফুল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। তাঁর এই আবিষ্কারের পূর্বে যেসব তরল পারফিউম ছিলো; সেগুলো তৈরীতে নানা ধরণের তেল এবং চূর্ণিত তৃণ বা ফুলের পাপড়ি ব্যবহৃত হতো। ফলে এগুলোর গন্ধ ছিলো বেশ কড়া। অন্যদিকে ইবনে সিনার আবিষ্কৃত গোলাপজল ছিলো অনেক বেশি সুক্ষ্ম এবং রুচিকর৷ ফলে এটি রাতারাতি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ইবনে সিনা সুগন্ধি প্রস্তুত করতে যেসকল উপাদান এবং পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, সেগুলোর কাছে আধুনিক পারফিউমারি, বিশেষ করে রসায়নশাস্ত্র চিরঋণী। ১৯৩৯ সালে রসায়নে নোবেল বিজয়ী লিওপোল্ড রুজিকা১৯৪৫ সালে বলেন, প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত পারফিমের উন্নতি জৈব রসায়নের বিকাশে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে।
স্যান্টা মারিয়া দেল্লে ভিগনে বাস্যান্টা মারিয়া নোভেল্লাএর অবস্থান ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে। এই ক্যাথলিক গির্জার সন্ন্যাসীদের প্রস্তুতকৃত সুগন্ধিকে যদি দালিলিক প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়, তাহলে ১২২১ সালের দিকেই সম্ভবত পশ্চিম ইউরোপে সুগন্ধি প্রস্তুতকারী বিদ্যার প্রচলন ছিলো। অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপে ১৩৭০ সালে হাঙ্গেরীয়রা সুগন্ধি তেল এবং অ্যালকোহলের সংমিশ্রণে একটি পারফিউম প্রস্তুত করে। এটিহাঙ্গেরিয়ান ওয়াটারনামে অধিক পরিচিত। এসব ক্ষেত্রে সুগন্ধি প্রস্তুতকারকদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন হাঙ্গেরিরকুইন এলিজাবেথ(উল্লেখ্য, ইনি আর ব্রিটেনের কুইন এলিজাবেথ এক নন)।
আরো পড়ুনঃ
কোপি লুয়াক : অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কফি
দেশে দেশে বোরকা ও আযান নিষিদ্ধের গল্প
রেঁনেসার কালে ইতালিতে পারফিউমারি বিদ্যার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। ষোড়শ শতকে ইতালির অভিজাত সম্প্রদায়ের সদস্য ক্যাথেরিন দে মেদিচিএর ব্যক্তিগত পারফিউমার ছিলেন রেঁনে দ্য ফ্লোরেন্তিন।তিনি নিজের যন্ত্রপাতি এবং উপকরণ নিয়ে ফ্রান্সে চলে আসেন। তার এখানকার অ্যাপার্টমেন্টটি নিজস্ব গবেষণাগারের সাথে গুপ্ত পথ দ্বারা সংযুক্ত ছিলো। কিছুতেই যেন পারফিউমের ফর্মুলা চুরি না হয়, সেজন্যে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তিনি। এই রেঁনের কারণেই ফ্রান্স সুগন্ধি এবং প্রসাধন সামগ্রী উৎপাদনে ইউরোপের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সেদেশে চতুর্দশ শতকে পারফিউমের নির্যাসের কাঁচামাল হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ শুরু হয়। এসময়ে এসে দক্ষিণ ফ্রান্সে এটি অত্যতম শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকের সুগন্ধি ব্যবহারকারীরা ছিলেন মূলত ধনিক এবং অভিজাত শ্রেণীর। দীর্ঘদিন গোসল না করার ফলে শরীরে যে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হতো, তা ঢাকতেই মূলত তারা পারফিউম ব্যবহার করতেন। ১৬৯৩ সালে জিওভান্নি পাওলো ফেমিনিসনামে এক ইতালীয় নাপিত অকুয়া অ্যাডমিরাবিলিসনামে একটি তরল সুগন্ধি তৈরী করেন; যেটি বর্তমানে ‘ও ডে কোলন’নামে সমধিক পরিচিত। ১৭৩২ সালে তার ভাতিজা ভিওভান্নি মারিয়া ফারিনাএই ব্যবসার কার্যভার গ্রহণ করেন। ওনার মৃত্যুর পরও তার পরিবার এই ব্যবসা চালিয়ে যায়। বর্তমানে তাদের অষ্টম প্রজন্ম ‘ও ডে কোলন’ উৎপাদন এবং বিপণন করছে। কোলন মূলত জার্মানির একটি শহরের নাম।
অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ ফ্রান্সের গ্র্যাস এবং ইতালির সিসিলি ও কালাহব্রিয়া অঞ্চলে সুগন্ধি উদ্ভিদ ও ফুলের চাষ শুরু হয়। এর পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল সুগন্ধি শিল্পের ক্রমবর্ধমান কাঁচামালের চাহিদার যোগান দেওয়া। এখনো ইউরোপীয় সুগন্ধি শিল্পের বাণিজ্য এবং সৃষ্টিশীলতার মূল কেন্দ্রস্থল ফ্রান্স এবং ইতালি।
পারফিউম শিল্পের বর্তমান অবস্থা
২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পারফিউম শিল্পের মার্কেট ভ্যালু ৩৩.৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে ৩.৯% প্রবৃদ্ধির যে হার, সেটি বজায় থাকলে ২০২৫ সালে এর মার্কেট ভ্যালু হবে ৪০.৯ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্বের সবচেয়ে দামী পারফিউমের তকমা গায়ে সেঁটেছে আমিরাতী পারফিউম ‘শুমুখ’।আরবি শুমুখ শব্দের ইংরেজি অর্থ হলো “deserving the highest”; অর্থাৎ, এটি প্রস্তুতকারী পারফিউমারির মতে তাদের পণ্যটি সর্বোচ্চ দাম পাওয়ার যোগ্য।
পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা পারফিউম ব্র্যান্ডের তালিকা করলে সেখানে স্থান পাবেক্যালভিন ক্লেইন, নটিকা, জিয়ান্নি ভারসাচে, মঁ ব্লঁ, গেস, ডলচি অ্যান্ড গ্যাবানাএর মত ব্র্যান্ডগুলো।
আবিষ্কারের পর থেকে এখনও পর্যন্ত কখনোই পারফিউমের আবেদন কমেনি, বরং বেড়েছে বহুগুণে। এটি পরিণত হয়েছে একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশে। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত রবে বলে মনে হয়।
This is a Bangla article. This article is about the history of perfume.
All the necessary links are hyperlinked.
Featured images are collected from google.