১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের মধ্যদিয়ে সর্বপ্রথম বাংলায় রাজনৈতিকভাবে ইসলাম প্রবেশ করে। দলে দলে মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকে। ফলে ভাটা পরে অত্রাঞ্চলে সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের মূর্তি নির্মাণ শিল্পে। বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের কয়েক শতকের মধ্যে অত্রাঞ্চলের প্রায় সিংহভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয়ে ওঠে। যেহেতু ইসলাম ধর্মে মূর্তি বা ভাস্কর্য সম্পূর্ণরূপে হারাম, তাই অত্রাঞ্চলে মূর্তিকে একপ্রকার ঘৃণার চোখেই দেখা হয়ে থাকে।
ভাস্কর্য নির্মাণে সবচেয়ে বড় ভাটা পড়ে পাকিস্তান শাসনামলে।
রাষ্টীয় কাজে মূর্তি নির্মাণকে প্রায় নিষিদ্ধই করে দেওয়া হয়। এ ধারা অব্যাহত থাকে সদ্যস্বাধীন হওয়া বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলেও তেমন একটা ভাস্কর্য নির্মাণের রীতি ছিল না। এমনকি আমাদের স্বাধীনতা স্মারক জাতীয় স্মৃতিসৌধও কিন্তু কোনো মূর্তি নয়। সেখানে মুক্তি সংগ্রামের সাতটি আন্দোলনকে স্মরণ করে সাতটি কনক্রিটের ফলক নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে কোনো মূর্তি নির্মাণ করা হয়নি। কিন্তু কেন?
খোদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ঢাকা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে নবীনগরে এই স্মৃতিসৌধের শিলাবিন্যাস করেন। বঙ্গবন্ধু কিন্তু সেদিন দেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর ধর্মমতের বিরুদ্ধে গিয়ে মূর্তি নির্মাণের অনুমতি দেননি।
আবার ঠিক একইভাবে নির্মিত হয়েছে শহীদ মিনার। সেখানেও কোনো মূর্তি নেই। স্নেহময়ী আনত মস্তক মায়ের প্রতীক হিসেবে মধ্যস্থলে সুউচ্চ কাঠামো নির্মিত হয়েছে এবং দুই পাশে সন্তানের প্রতীক স্বরূপ হ্রস্বতর দুটি করে কাঠামো রয়েছে। সেখানেও মূর্তির পরিবর্তে প্রতিকী কনক্রিট কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে।
তবে সময়ের সাথে সাথে সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। পরবর্তী বাংলাদেশে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য বা মূর্তি। যেমন সাবাস বাংলাদেশ, অপরাজেয় বাংলাদেশ, অদম্য বাংলাদেশ, চেতনা ‘৭১’ ইত্যাদি। আজকে আমরা বাংলাদেশের মূর্তি সংস্কৃতির গোঁড়া থেকে জানা চেষ্টা করব।
ভাস্কর্য শিল্প বাংলাদেশের সংস্কৃতিরএকটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বললেও ভূল হবে না। বাংলাদেশে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের ভাস্কর্যও আবিষ্কৃত হয়েছে যা থেকে বোঝা যায় সুদূর অতীতকাল থেকে এখানে ভাস্কর্যশিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই মূর্তি ও ভাস্কর্য বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির গৌরব বহন করে চলেছে।
প্রাচীন বাংলার ঐতিহাসিক পরিচয় উদঘাটনে এখানকার মূর্তি ও শিল্পকর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। যদিও প্রায় ২৫০০ বছর পূর্বে এখানে মূর্তিশিল্পের উদ্ভব ঘটে। তবুও গুপ্ত যুগ, পাল যুগ এবং সেন শাসনামলে মূর্তি নির্মাণকলা সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষ পেয়েছিল।
গুপ্ত যুগের মূর্তি
খ্রিষ্টাব্দ অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত চার’শ বছরের দীর্ঘ পাল শাসনামলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মূর্তিশিল্পের কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। এসব কেন্দ্রে নির্মিত হওয়া ভাস্কর্যগুলো বৈচিত্র্যে ও সংখ্যায় প্রচুর। পাল আমলের প্রায় সহস্রাধিক ভাস্কর্য পাওয়া গেছে যা দেশের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ইউরোপ আমেরিকার জাদুঘরেও ঠাঁই করে নিয়েছে। সোমপুর মহাবিহার খনন করে পাল যুগের প্রচুর ভাস্কর্য উদ্ধার করা হয়। পাল ভাস্কর্যগুলোয় গুপ্তযুগের শেষভাগের প্রভাব থাকলেও পরবর্তীকালে এটি অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে যায়।
সেন যুগের মূর্তি
বাংলাদেশে প্রাপ্ত ভাস্কর্যসমূহ মূলত টেরাকোটা, ব্রোঞ্জ ও কষ্টিপাথর বা পাথর দ্বারা নির্মিত। সবচেয়ে পুরনো যে ভাস্কর্য পাওয়া গেছে তা একটি টেরাকোটা এবং এর সময় খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক। ৭ম শতক থেকে ভাস্কর্য নির্মাণে ব্রোঞ্জ এর ব্যবহার শুরু হয়। পাথর, বিশেষত কষ্টিপাথরের ব্যবহারও তখন থেকেই শুরু হয়।
টেরাকোটা
বাংলায় টেরাকোটার ব্যবহার শুরু হয় মৌর্য্য যুগ(খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪-১৮৭) থেকে। ধারণা করা হয় প্রাক-মৌর্য্য যুগে মাতৃকা দেবীগণের মূর্তি প্রধান ছিল। মৌর্য্য যুগের ভাস্কর্যের শিল্পরূপ ও নান্দনিকতা দেখে মনে হয় সেসময় ভাস্কর্যের একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২য় থেকে ১ম শতকের দিকে ভাস্কর্যগুলো আরও অভিজাত, পরিশোধিত ও সুদৃশ্য আকারের হয়ে ওঠে।
ব্রোঞ্জ
খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভাস্কর্য নির্মাণে ব্রোঞ্জ এর ব্যবহার শুরু হয়। এ অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য থাকায় অধিকাংশ মূর্তিই গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি। অবশ্য পরবর্তীকালে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিতেও ব্রোঞ্জ ব্যবহৃত হয়।
পাথর
বাংলাদেশে পাওয়া প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভাস্কর্যগুলোকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- হিন্দুদের উপাস্য সত্তা এবং বৌদ্ধদের উপাস্য সত্তা(বিশেষত গৌতম বুদ্ধ)। এছাড়া দুই-একটি জৈনমূর্তি দেখা যায়, যা সংখ্যায় খুব কম।
হিন্দু মূর্তি
ধারণা করা হয় গুপ্ত শাসনামল থেকে এদেশে হিন্দু ধর্মীয় মূর্তি নির্মাণ আরম্ভ হয়েছিল। অধিকাংশ মূর্তিতে হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রতিকৃতি দেখা যায়। অন্যান্য উপাস্য সত্তার মধ্যে শিব, দুর্গা, ব্রহ্মা, গণেশ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মহাস্থানগড় জাদুঘরে সংরক্ষিত বগুড়া থেকে পাওয়া মহিষমর্দিনী মূর্তিটি কেবল বাংলা নয়, বরং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন নিদর্শন।
বৌদ্ধ মূর্তি
বৌদ্ধ ধর্মীয় ভাস্কর্যসমূহের মধ্যে গৌতম বুদ্ধ প্রধান। মনে করা হয় বাংলাদেশের প্রাচীনতম বৌদ্ধমূর্তিসমূহ পুণ্ড্রবর্ধন নগরের মূর্তি ছিল। এসকল মূর্তি ও ভাস্কর্য বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা বিশেষত রাজশাহী ও রংপুর এলাকা হতে সংগৃহীত হয়।
জৈন মূর্তি
১৩ শতকের প্রথমদিকে বাংলায় মুসলিম শাসকগণ বিজয়ী হয়ে এদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। ধীরে ধীরে এ অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যাবৃদ্ধি হয় এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন ধর্মানুসারীর সংখ্যা কমে আসে। মূর্তি নির্মাণে পূর্বেকার রাজাদের মত পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় ধীরে ধীরে বাংলায় পাল-সেন যুগের ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্যশৈলী স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এই ভাস্কর্যরীতি উত্তরে নেপাল ও তিব্বত; পূর্বে মায়ানমার ও থাইল্যান্ড, দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে বিস্তৃত হয়।
আধুনিক ভাস্কর্য