লিখুন
ফলো

ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর: গৃহযুদ্ধ থেকে সৃষ্ট এক সংগঠনের দুর্ধর্ষ কিছু অভিযান

ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর মূলত একটি গৃহযুদ্ধ, যা সংঘটিত হয়েছিল জর্ডানে। জর্ডানে অবস্থানরত ফিলিস্তিনি মুক্তিকামীদের প্রতিহত করতে ইজরায়েলের চাপের মুখে জর্ডান সরকার এই গৃহযুদ্ধের সূচনা করে। পরাজিত ফিলিস্তিনিরা পরবর্তীকালে ঠিক একই নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। এই সংগঠনটি পৃথিবীতে দুর্ধর্ষ কিছু অভিযানের জন্ম দেয়। আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর এবং তাদের মিশনসমূহ।

ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর পৃথিবীতে রচনা করে দুর্ধর্ষ কিছু অভিযান; image source: wikipedia

ফিলিস্তিনি ছিটমহল ও শরণার্থী শিবিরগুলোয় জর্ডান পুলিশ ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল। পিএলও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন) যোদ্ধারা প্রকাশ্যে বন্দুক নিয়ে ঘোরাফেরা করত এবং কর উত্তোলনের চেষ্টা করত। ১৯৬৮ এর আলোচনার সময় জর্ডানের সম্রাট হুসেইন ফিলিস্তিনি সংগঠন গুলোর সাথে সাত দফা চুক্তিতে পৌঁছান-

১. সংগঠনের সদস্যরা শহরের বাহিরে সশস্ত্র এবং উর্দি পরিহিত অবস্থায় চলাফেরা করতে পারবে না।

২. সংগঠনের সদস্যরা সাধারণ নাগরিকদের গাড়ির গতিরোধ এবং তল্লাশি চালাতে পারবে না।

৩. সংগঠনের সদস্যরা চাকরিতে নিয়োগের জন্য জর্ডান সেনাবাহিনীর সাথে প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে পারবে না।

৪. সংগঠনের সদস্যদের সর্বদা জর্ডানিয় পরিচয়পত্র সাথে বহন করতে হবে।

৫. সংগঠনের সদস্যদের যানবাহনে জর্ডানের লাইসেন্স থাকতে হবে।

৬. সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত যেকোন অপরাধমূলক কাজ জর্ডান কর্তৃপক্ষের দ্বারা নিরীক্ষিত হবে।

৭. ফিলিস্তিনি সংগঠন এবং সরকারের মধ্যবর্তী যেকোন বিতর্ক সম্রাট হুসেন এবং পিএলও এর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কমিটির মাধ্যমে সমাধান করা হবে।

ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর পৃথিবীতে রচনা করে দুর্ধর্ষ কিছু অভিযান; image source: Wikipedia

কিন্তু পিএলও এই সাত দফা চুক্তি মেনে চলল না। বরং ধীরে ধীরে এই অঞ্চল জর্ডানে একটি স্বাধীন অঙ্গরাজ্য হবার পথে এগিয়ে যেতে থাকল।

ষাটের দশকের শেষভাগে জর্ডানে অবস্থান করা সশস্ত্র ফাতাহ কর্মীরা ক্ষমতাসীনদের কাছে দেখা দেয় উটকো ঝামেলা হিসেবে। ১৯৭০-র সেপ্টেম্বরে তারা ইহুদি যাত্রী বহনকারী বেশ কয়েকটি বিমান ছিনতাই করে নিয়ে আসে জর্ডানের ভূমিতে। বিমানগুলাে থেকে লােকজন নামিয়ে দিয়ে বােমা মেরে উড়িয়ে দেয় ফাতাহ কর্মীরা।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিমান পুড়ে যাওয়ার সেই ছবি ফলাও করে প্রচার হয়। ইমেজ সংকটে পড়েন জর্ডানের বাদশাহ হােসেন বিন তালাল। জর্ডানের ওপর রাজপরিবারের নিয়ন্ত্রণ আছে কি না, এ নিয়ে উঠে প্রশ্ন। আসলেই তাে, কারা চালাচ্ছে জর্ডান?

বাদশাহ ভাবলেন- আরাফাত ও তার লােকজন জর্ডানে এমনভাবে চলাফেরা করছে, কার্যক্রম চালাচ্ছে, যাতে মনে হতে পারে দেশটা তাদের। বহিরাগতদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার টেনশন তাকে পেয়ে বসে। ক্ষুব্ধ হােসেন সেপ্টেম্বরে জর্ডানি সেনা, পুলিশ ও গােয়েন্দা সংস্থাগুলােকে ইয়াসির আরাফাতের বাহিনীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। এই অপারেশনে জর্ডানে আশ্রয় নেওয়া কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী/ফেদাইন মিলিশিয়া নিহত হয়। পিএলও তার কার্যক্রম জর্ডান থেকে লেবাননে সরিয়ে আনে।

এই ঘটনা ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর হিসেবে পরিচিত ফিলিস্তিনিদের কাছে। এর বদলা নিতে পরবর্তী সময়ে একই নামে একটি সংগঠন গড়ে তােলা হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন সালাহ খালাফ। খালাফ ছিলেন পিএলও’র গােয়েন্দা শাখা ‘রাশেদ’-এর কমান্ডার। ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্যরা ১৯৭১ সালের ২৮ নভেম্বর কায়রােতে জর্ডানের প্রধানমন্ত্রী ওয়াশফি আল তালালকে হত্যা করে। তিনি এক বছর আগে জর্ডানে ফাতাহর বিরুদ্ধে ক্র্যাকডাউনে ভূমিকা রেখেছিলেন।

ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর পৃথিবীতে রচনা করে দুর্ধর্ষ কিছু অভিযান; image source: Wikipedia

১৯৭২ সালের জুলাইয়ের শুরুর দিকে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের আটজন সদস্য লিবিয়ার মরুভূমির একটা ট্রেনিং ক্যাম্পে পৌছান। এই দলটি দেখভাল করছিলেন মােহাম্মদ ইউসেফ আল নাজার। নাজার ছিলেন ফাতাহর নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা। এই আটজন সদস্যের ছিল বিশেষ বিশেষ গুণ। এদের কারও কারও যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল, কেউ কেউ ইউরােপে বিশেষ করে জার্মানিতে বেশ পরিচিত ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মােহাম্মদ মাশালহা। মাশালহা জার্মান ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তাকে গ্রুপটির মুখপাত্র করা হয় আর কোড নাম দেওয়া হয় ‘ঈসা’।

লিবিয়ার মরুভূমিতে তারা ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের প্রতিষ্ঠাতা সালাহ খালাফ ওরফে আবু ইয়াদের সঙ্গে দেখা করেন। খালাফের বিশ্বস্ত সহযােগী মােহাম্মদ ওদেহ ওরফে আবু দাউদও তার সঙ্গে ছিলেন। এই আবু দাউদ-ই ছিলেন জার্মানির মিউনিখ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। গ্রুপটিকে জানানাে হয় তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে অংশ নিতে যাচ্ছেন, তবে কী অপারেশন তা গােপন রাখা হয়। কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের পিস্তল, সাবমেশিনগান চালানাে, গ্রেনেড চার্জ ও হাতাহাতি লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়; শেখানাে হয় ছদ্মবেশ ধারণের কৌশল।

গ্রুপ সদস্যদের সবারই আলাদা কোড নাম দেওয়া হয়, দেওয়া হয় লিবিয়ার ভুয়া পার্সপাের্ট। অপারেশন চলাকালে মুখ ঢেকে রাখতে বলা হয় আর বারবার পােশাক পরিবর্তনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ইজরাইলি গােয়েন্দা সংস্থাগুলাে এর কিছুই জানত না।

জুলাইয়ের সাত তারিখে মােসাদের এক ফিলিস্তিনি চর (কোড নাম লুসিফার) সতর্ক করে দেয় যে, ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর ইউরােপে ইজরাইলি স্বার্থে হামলা করতে যাচ্ছে। আগস্টের ৫ তারিখকে সম্ভাব্য হামলার দিন উল্লেখ করা হলেও লুসিফার বিস্তারিত কিছুই জানাতে পারেননি।

সেপ্টেম্বরের তিন ও চার তারিখে গ্রুপটির আটসদস্য আলাদা কয়েকটি ফ্লাইটে করে পশ্চিম জার্মানিতে পৌছায়। তারা সবাই মিউনিখে গিয়ে মিলিত হয়, সেখানে তখন অলিম্পিক চলছিল। অপারেশন শুরুর প্রাক্কালে মিউনিখের একটি রেস্টুরেন্টে পুরাে পরিকল্পনাটি জানানাে হয় সদস্যদের। চূড়ান্ত পরিকল্পনাটির কথা জানান খালাফের সহযােগী ওদেহ। তারা অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করেন, যা সুইডেন ও স্পেন থেকে চোরাই পথে আনা হয়েছিল।

জার্মানির মিউনিখে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের অপারেশন; image source: hareetz.com

টিম মেম্বাররা দেয়াল বেয়ে অলিম্পিক ভিলেজ-এর ভেতরে ঢুকে পড়েন– যেখানে ইজরাইলি ক্রীড়া প্রতিনিধি দলটি অবস্থান করছিল। সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল ৩২ জনের মতাে পুলিশ সদস্য, তবে মাত্র দুজন ছিলেন সশস্ত্র। কারণ, জার্মানি একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রাখতে চেয়েছিল। আর তারা তাে জানত না-কী ঘটতে যাচ্ছে। ৫ সেপ্টেম্বর ভাের চারটায় আঘাত হানে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্যরা। একজন ইজরাইলি অ্যাথলেট পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, কিন্তু মােশে উইনবার্গ নামের এক রেসলিং কোচ ও ইউসেফ রােমানাে নামে আরেকজন ভারােত্তলক গুলিতে নিহত হন। বাকি নয়জনকে জিম্মি করা হয়।

এদের ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে ইজরাইলের কারাগার থেকে দুইশাে ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তি চাওয়া হয়। এদিন সকালে গােল্ডামেয়ার নেসেটকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেন। ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব মানেনি ইজরাইল। তবে আপসরফার অংশ হিসেবে হেলিকপ্টারযােগে জিম্মি নয়জন ক্রীড়াবিদ ও গেরিলা দলটিকে জার্মানির একটি বিমানঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাদের নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল মিশরের রাজধানী কায়রােতে, কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ জার্মানি বাহিনী ফিলিস্তিনি গেরিলাদের লক্ষ্য করে গুলি ছােড়ে। গেরিলারাও পালটা গুলি চালায়। এতে পাঁচ গেরিলা, একজন জার্মানি পুলিশ কর্মকর্তা ও নয়জন ইজরাইলি খেলােয়াড় মারা যান।

জার্মানির মিউনিখে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের অপারেশন; image source: hareetz.com

মিউনিখ অলিম্পিকে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী আবু দাউদ মারা গেছেন ২০১০ সালের জুলাইয়ের দিকে। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। ২০০৮ সালে বার্তা সংস্থা এপির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে দাউদ মিউনিখ অলিম্পিকে গেরিলা হামলার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির দায় স্বীকার করেন। অবশ্য, ১৯৯৯ সালেই নিজের লেখা প্যালেস্টাইন : ফ্রম জেরুজালেম টু মিউনিখ বইয়ে এ হামলার পরিকল্পনা কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন দাউদ। ৯৮ মােসাদ এই অপারেশনের প্রতিশােধ নিতে চেয়েছিল, কিন্তু তাদের ভুল নিশানায় মারা যায় কিছু নিরপরাধ ব্যক্তি।

 


This is a bengali article. it’s about ‘Black September’.

All necessary reference are hyperlinked inside article.

Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous Article

পারফিউমের ইতিহাস : প্রাচীন মেসোপোটেমীয় পণ্য যেভাবে তৈরী করলো বিলিয়ন ডলারের বাজার

Related Posts
আরও পড়ুন

হোয়াটসঅ্যাপ ইতিবৃত্ত

ম্যাসেঞ্জারের পরে সবচাইতে জনপ্রিয় ম্যাসেজিং অ্যাপ হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ। এত লম্বা সময়েও এর জনপ্রিয়তা কমেনি। সব জেনারেশনের মানুষরাই ব্যবহার…

ব্লু অরিজিন : জেফ বেজোসের স্পেস ফ্লাইট কোম্পানি [পর্ব – ২]

১ম পর্ব ব্লু অরিজিনের পুনঃব্যবহারযোগ্য নিউ শেফার্ড সাবঅরবিটাল সিস্টেম  ব্লু অরিজিন একটি রকেট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এবং এখন তারা…

কোপি লুয়াক : অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কফি

ইন্দোনেশিয়ার বাহাসা ভাষার ভাষাভাষী লোকজন কফি কে বলে কোপি। আর তারা বিড়ালের মত দেখতে  গন্ধগোকুল বা খট্টাশ নামক…

সবচেয়ে বেশি কভিড আক্রান্ত দেশগুলো

জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো তালিকার শীর্ষে রয়েছে, যেখানে মোট ১৪ মিলিয়ন অতিক্রম করেছে। মোট বৈশ্বিক সংখ্যা এখন ৬৫ মিলিয়নেরও বেশি, যেখানে ১৫ লক্ষেরও বেশি লোক মারা গেছে।  This…

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন

Total
0
Share