বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রাম একটি অন্যতম উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল একটি দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লবী যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সফল পরিণতি ভিয়েতনামের জনগণের কাছে তথা বিশ্ববাসীর কাছে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম একটি আলােচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল।
ভিয়েতনাম হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি অপেক্ষাকৃত ছােট দেশ। দখলদারত্বের বিরুদ্ধে দেশটির সংগ্রামের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। চীন, জাপান, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারত্ব তথা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশটি জয়ী হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে দেশটি স্বাধীনতা ঘােষণা করলেও, অচিরেই দেশটি ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের ও পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। একসময় বিদেশি প্রভুরা তাদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখার জন্য দেশটি ভাগ পর্যন্ত করেছিল।
১৯৭৬ সালের ২ জুলাই দুই ভিয়েতনাম একত্র হওয়ার আগ পর্যন্ত ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। ষাট ও সত্তরের দশকে ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে নিন্দা ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, ওই সময়কার রাজনীতিতে তা ছিল
উল্লেখ করার মতাে ঘটনা। ওই সময় উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রতিটি দেশে ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত গড়ে উঠেছিল। এমনকি উন্নতবিশ্বের তরুণসমাজও ছিল ওই যুদ্ধের বিপক্ষে ছিল। যার পরিণতিতে ওই সময় সারা বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেমনি ধিক্কারধ্বনি শােনা গিয়েছিল, ঠিক তেমনি ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষেও জনমত গড়ে উঠেছিল।
ওই সময় ভিয়েতনামে মার্কিন বােমাবর্ষণ, অত্যাধুনিক বােমার ব্যবহার সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী জানা যায়, ভিয়েতনাম যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন ত্রিশ লাখেরও বেশি মানুষ, যার মধ্যে ছিলেন ৫৭ হাজার মার্কিন সেনা।
১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের আগে ১৯৭৩ সালের ২৭ জানুয়ারি প্যারিসে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর ভিয়েতনামের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই শান্তিচুক্তির কারণে হেনরি কিসিঙ্গার ও লি ডাক থাে ১৯৭৩ সালে নােবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। এরা দুজন ছিলেন শান্তি আলােচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর ভিয়েতনামের মুখ্য আলােচক।
যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম থেকে সেনা প্রত্যাহারের আগে উত্তর ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী দক্ষিণ ভিয়েতনামের তৎকালীন রাজধানী সায়গন (পরবর্তীকালে হাে চি মিন নগরী) দখল করে নেয়। ১৯৭৬ সালেই দুই ভিয়েতনাম একত্র হয়ে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বলা ভালাে, ১৯৫৪ সালের জেনেভা সম্মেলনের মধ্যে দিয়েই ভিয়েতনামকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল।
দাসতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, রাজতন্ত্র, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামী জনগণের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনাে। ইতিহাস থেকে জানা যায় খ্রিস্টপূর্ব ১৭৯ সালে দক্ষিণ চীনের জায়গীরদার ও চীনা সেনাপতি ত্রি উ দা আজকের ভিয়েতনাম দখল করেছিলেন। ভিয়েতনামের বীরযােদ্ধা লাই বনের নেতৃত্বে প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র ভান জুয়ান প্রতিষ্ঠিত হয় ৫৪৪ সালে।
কিন্তু ৬০৩ সালে লাই বনের স্বাধীন সরকার চীনা সামন্তশক্তির প্রবল চাপের মুখে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। দশম শতকের প্রারম্ভে প্রথম বছর থেকেই শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী গণঅভ্যুত্থান। ৯৩৮ সালে নাে কুয়ান নিজেকে ভিয়েতনামের স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘােষণা দেন। চীনে লি রাজবংশের আমলে ১২২৫ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনাম বারবার চীনা সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এরপর মঙ্গোলীয়রা (১২৫৭) ভিয়েতনাম আক্রমণ করে। ১২৮৮ সালে কুবলাই খাঁর নেতৃত্বাধীন সর্বশেষ আক্রমণে মঙ্গোলীয়রা পরাজিত হয়।
এর পরপরই ভিয়েতনামে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই সময় চীন থেকে মঙ্গলদের বিতাড়িত করে মিং রাজবংশ চীনে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারা ১৪০৬ সালে পুনরায় ভিয়েতনাম দখল করে নেয়। এবং ১৪২৭ সালে তারা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ভিয়েতনাম থেকে বিতাড়িত হয়। ভিয়েতনামে লে লােই’র নেতৃত্বে নতুন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ওইসময় কৃষক অভ্যুত্থান হয় এবং ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত কৃষক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে নগুয়েন হু কাও ভিয়েতনামে রূপকথার নায়কে পরিণত হন।
অষ্টাদশ শতাব্দীতেই ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি রাজা ষােড়শ লুই-এর শাসনামলেই ভিয়েতনামে তাদের খুঁটি গাড়ে। ১৭৮৭ সালে তারা একটি চুক্তি করে। ওই চুক্তি বলে ভিয়েতনামের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ফরাসিদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আর
ধীরে ধীরে ফরাসিরা তাদের অধিকার সংহত করে ১৮৫৮ সালে ও তার পরের বছর সায়গন দখল করে নেয়। ১৮৮৪ সালে ভিয়েতনামের শেষ স্বাধীন রাজাকে তার আশ্রিত সরকারে পরিণত করে। বাহ্যত ওই সময় থেকেই ভিয়েতনাম ফরাসিদের সরাসরি উপনিবেশে পরিণত হয়।
একই সাথে তারা লাওস ও কম্পুচিয়া দখল করে তিনটি দেশকে একত্র করে ইন্দোচীন নাম দেয়। ইতিহাস বলে ফরাসি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামী জনগণ ১৮৬০ সাল থেকেই গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। পর্যায়ক্রমে সেই গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্ব চলে যায় ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির হাতে। আর এই কমিউনিস্ট পার্টির অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন হাে চি মিন।
ভিয়েতনামের ইতিহাস থেকে জানা যায় হাে চি মিন বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলেন। নগুয়ের ভ্যান কুং, নগুয়েন তাত থান, নগুয়েন আই কুয়োক, লাই সই, ভুয়ং সন নিহি, লিনত ইত্যাদি নাম ব্যবহার করতেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য। প্রথম দুটো বাদে বাকি নামগুলো ছিল তার ছদ্মনাম।
হো চি মিনের জন্ম ১৮৯০ সালের ১৯ মে, আর মৃত্যু ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ সালে। ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে তিনি হো চি মিন নাম ধারণ করেছিলেন। বস্তুতপক্ষে তিনি ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির জন্মের সাথে জড়িত থাকলেও তার জীবনের একটা বড় সময় কেটেছে প্যারিসে, মস্কোতে ও চীনে। তিনি আন্তর্জাতিক কমিউনিষ্ট সংস্থা কমিন্টার্নের প্রতিনিধি হিসেবে ঐসব দেশে কাজ করেছেন। প্যারিসে থাকাকালীন (১৯১১ সালের পর) নির্বাসিত ভিয়েতনামি দেশপ্রেমিকের দ্বারা গঠিত ‘আন্তঃ উপনিবেশিক ইউনিয়ন’ নামে যে সংস্থাটি গঠিত হয়েছিল তার সাথে জড়িত ছিলেন হো চি মিন। এই সংস্থাটি ছিল কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের পথে প্রথম পদক্ষেপ।
এরপর ১৯২৪ সালের দিকে চীনের ক্যান্টনে প্রবাসী ভিয়েতনামী তরুণদের নিয়ে হো চি মিন গঠন করেন ‘ভিয়েতনাম বিপ্লবী যুবসমিতি’। এই যুবসমিতিই ছিল ‘ইন্দোচিন কমিউনিস্ট পার্টি’। এরপর ১৯৩০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি হংকংয়ের কাছে কৌললে ভিয়েতনামী বিপ্লবীদের এক সম্মেলনে গঠিত হয় ‘ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি’। কিন্তু অক্টোবর মাসে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম অধিবেশনে পার্টির নাম বদলে রাখা হয় ‘ইন্দোচীনের কমিউনিস্ট পার্টি’।
১৯৪০ সালের দিকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ অংশ নেয়ার জন্য হাে চি মিন ভিয়েতনামে ফিরে আসেন। ইতােমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ইন্দোচিন প্রত্যক্ষভাবে জাপানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় ১৯৪০ সালের আগস্টে। ওই সময়ে নভেম্বর মাসে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সপ্তম প্লেনামে জাপানি ফ্যাসিবাদী ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্ত হয়। ওই সময় পার্টি চীনের কোয়াঙে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে। এখানে উল্লেখ যে, রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে ভিয়েতনামী বিপ্লবীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।
আরো পড়ুনঃ
ভিয়েতনাম যুদ্ধঃ মার্কিন বাহিনীর পরাজয়ের করুণ ইতিহাস (পর্ব ২)
গভীর সমুদ্র তলদেশের জীববৈচিত্র্য এবং অদ্ভুত তাদের অভিযোজন ক্ষমতা
ভিয়েতনামী কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম দিকে চীন ও রাশিয়া দুটো দেশ থেকেই সাহায্য পেয়েছে। ১৯৪১ সালের শেষ দিক থেকে ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত আট মাস ধরে গেরিলা যুদ্ধ চলে। ১৯৪৪ সালের প্রথম দিকে এই যুদ্ধের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পায়।
এদিকে ১৯৪৫ সালের ৯ মার্চ জাপানিরা সমগ্র ইন্দোচিনে তাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। কিন্তু ভিয়েতনামের গেরিলাদের অগ্রযাত্রা তারা রােধ করতে পারেনি।
১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর তারা হ্যানয় অবরোধ করেন ও শত্রুমুক্ত হন। হো চি মিন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। পুরাে উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ উত্তর ভিয়েতনামে ওই সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ওদিকে বাও দাইকে প্রধান করে দক্ষিণ ভিয়েতনামে গঠিত হয় আরেকটি সরকার।
This is a Bengali article. It’s About 1st episode of ‘Vietnam War’.
Necessary reference are hyperlinked inside article.
Featured Image: CCTV News