দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ বাহিনীর সহায়তায় ফরাসিরা দক্ষিণ ভিয়েতনামের তাবেদার সরকারের উপর চাপ অব্যাহত রাখে। ১৯৫৪ সালের প্রথমদিকে ভিয়েত কংদের আক্রমণে ফরাসি ঘাঁটি দিয়েন বিয়েন ফু’র পতন ঘটে। এর রেশ ধরেই ১৯৫৪ সালের ২০ আগস্ট জেনেভা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সেখানে যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল যে,
১. সপ্তদশ অক্ষরেখা বরাবর ভিয়েতনামকে দু ভাগে ভাগ করা হবে। উত্তর ভিয়েতনাম হো চি মিন সরকার ও দক্ষিণে বাও দাই সরকার ক্ষমতা পরিচালনা করবে
২. ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে সেখানে গণভােটের মাধ্যমে ভিয়েতনামের ভাগ্য নির্ধারণ হবে
৩. লাওস ও কম্পুচিয়ার স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে।
নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিন দেশের সমন্বয়ে একটি কমিশনও (ভারত, পােল্যান্ড ও কানাডা) গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। কেননা দক্ষিণ ভিয়েতনামে একটি গণভােটের মাধ্যমে বাও দাইকে পদচ্যুত করে নাগাে দিয়েন দিয়েম নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘােষণা করেছিলেন। তিনি নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। দিয়েম সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করেছিল। ১৯৬৩ সালে একটি অভ্যুত্থানে দিয়েম সরকারের পতন ঘটেছিল।
এরপর দক্ষিণ ভিয়েতনামে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। ১৯৬৪ সালে টংকিং উপসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর উপর উত্তর
ভিয়েতনামের বােমাবর্ষণের ফলে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর ভিয়েতনামে বােমাবর্ষণের নির্দেশ দেয়। এর আগে ১৯৬১ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সৈন্য পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ওই যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। এমনি এক পরিস্থিতিতে উত্তর ভিয়েতনামের উদ্যোগে দক্ষিণ ভিয়েতনামে গঠিত হয়েছিল জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট বা National Liberation Front।
এদিকে ১৯৬৭ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন প্রভাবাধীন একটি নির্বাচনে নগুয়েন ভন থিও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। শহরাঞ্চলে থিও সরকারের কিছুটা প্রভাব থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলাে চলে গিয়েছিল লিবারেশন ফ্রন্টের নিয়ন্ত্রণাধীনে। ফলে উত্তর ভিয়েতনামে মার্কিন বােমাবর্ষণ বন্ধ ও বিপ্লবীদের সাথে একটি সমঝােতায় পৌছানাের জন্য প্যারিসে শান্তি আলােচনা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৩ সালের ২৭ জানুয়ারি একটি চুক্তির মারফত যুদ্ধের সাময়িক বিরতি হয়।
এরপর ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট থিও পদত্যাগ করলে জেনারেল ভ্যান মিন তার স্থলে প্রেসিডেন্ট হন। অন্যদিকে, উত্তর ভিয়েতনামে হাে চি মিনের মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন টুন ডাক থাঙ। দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকার ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল সায়গন দখল করে। এর মধ্য দিয়েই দুই ভিয়েতনামের একত্রীকরণের পথ প্রশস্ত হয়।
একই সাথে লাওস ও কম্পুচিয়াতেও সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা আন্দোলন সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এই জাতি দীর্ঘদিন ছিল পরাধীন। তাই তারা যখন মুক্তি আন্দোলন শুরু করেছিল, তখন বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। উপরন্তু মার্কিন নাপাম বােমাবর্ষণে সাধারণ শিশুরাও যখন মারা যাচ্ছিল ভিয়েতনামে, তখন বিশ্ববাসীর নীরব সমর্থন নিয়ে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি সে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল।
কিন্তু ১৯৭৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত যে সময়সীমা সেই সময়সীমায় ভিয়েতনামের অনেক সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আসরে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। যেমন ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে কম্পুচিয়ায় সামরিক আগ্রাসন। এমনকি ভিয়েতনাম ১৯৭৯ সালে চীনের সাথেও একটি বিবাদে জড়িয়ে গিয়েছিল। চীন ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে
ভিয়েতনাম আক্রমণ করেছিল। এখানে বলা প্রয়ােজন যে, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভিয়েতনাম ছিল সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে।
সােভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভিয়েতনামের ২৫ বছর মেয়াদি একটি সামরিক চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এমনকি সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নে সংস্কার কর্মসূচি চালু হলে, ভিয়েতনামও এক ধরনের সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে। একটি সমাজতান্ত্রিক সরকারও যে আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে, সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি ভিয়েতনামও সেই প্রমাণ রেখেছিল ১৯৭৮ সালের শেষের দিকে কম্পুচিয়া দখল করে।
ওই সময় কম্পুচিয়ায় ক্ষমতাসীন ছিল পল পট ও হেঙ সামরিনের নেতৃত্বাধীন কট্টরপন্থি একটি সমাজতান্ত্রিক সরকার, যারা ‘খেমার রুজ’ নামে পরিচিত ছিলেন। তারা ১৯৭৫ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করে একটি নতুন ধারার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন। মধ্য ষাটের দশকে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মতাে খেমার রুজরাও ক্ষমতাসীন হয়ে বুদ্ধিজীবীদেরসহ হাজার হাজার লােককে গ্রামে প্রেরণ করেন এবং গ্রামে সরকারি খামারগুলােতে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ করতে বাধ্য করেন।
রাজধানী তারা খালি করে দেন। তাদের এই সিদ্ধান্তের ফলে তাদের শাসনামলে কয়েক লক্ষ লােক কম্পুচিয়ায় প্রাণ হারিয়েছিল। এই অভিযােগের পরিপ্রেক্ষিতেই ভিয়েতনাম ১৯৭৮ সালে দেশটি দখল করে ক্ষমতা থেকে খেমার রুজদের উৎখাত করে। তারা ক্ষমতায় বসায় হুন সেনকে। কিন্তু জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা হুন সেন সরকারকে দীর্ঘদিন সমর্থন করেনি।
বরং ১৯৮২ সালে খেমার রুজ, দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও প্রিন্সসিহানুকের নেতৃত্বে যে
প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছিল, সেই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন জনগণের একটি বিশাল অংশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছিল। ১৯৬৭ সালের পরে জনমত অবিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং ১৯৭০ সাল নাগাদ আমেরিকার এক তৃতীয়াংশই বিশ্বাস করেছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে যুদ্ধের জন্য সেনা পাঠিয়ে কোনও ভুল করেনি।
১৯৫৪ সালের জেনেভা সম্মেলন থেকে প্রথম ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জড়িত থাকার বিরোধিতার সূচনা হয়। নির্বাচন হেরে যাওয়ায় দিমের মার্কিন সমর্থনকে গণতন্ত্রকে ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়েছিল, যে মার্কিন সমর্থন করেছিল বলে দাবি করেছে। জন এফ কেনেডি, সেনেটর থাকাকালীন ভিয়েতনামে জড়িত থাকার বিরোধিতা করেছিলেন।
যাইহোক, ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনকে শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার কারণ এবং এর কারণগুলি নির্দিষ্ট করে এমন কয়েকটি দল নির্দিষ্ট করা সম্ভব। অনেক যুবক প্রতিবাদ করেছিলেন, কারণ তারা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল, অন্যরা যুদ্ধবিরোধী হওয়ায় যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন বিপরীত সংস্কৃতির মধ্যে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় হয়ে উঠল। শান্তি আন্দোলনের কিছু সমর্থক ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন বাহিনীর প্রত্যাহারের একতরফা পক্ষে ছিলেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্যবাদবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দলগুলিকে একত্রিত করার প্রবণতা সৃষ্টি করেছিল, এবং ক্যাথলিক শ্রমিক আন্দোলনের মতো নয়া বামের সাথে জড়িতদের পক্ষে। স্টিফেন স্পিরোর মতো অন্যরাও ন্যায়যুদ্ধ তত্ত্বের ভিত্তিতে যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। কেউ কেউ ভিয়েতনামের জনগণের সাথে সংহতি জানাতে চেয়েছিলেন, যেমন নর্মন মরিসন থাচ কোং দুকের আত্ম-দহনকে অনুকরণ করেছিল।
উচ্চ-পদস্থদের ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধীতা মার্কিন জনগণের মতামত পরিবর্তনের প্রয়াসে ক্রমবর্ধমান গণ-বিক্ষোভে পরিণত হয়। যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলাকালীন ১৯৬৮ সালের গণতান্ত্রিক জাতীয় সম্মেলনে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল ১৯৬৮ সালে আমার লাই ম্যাসাক্যাকের মতো মার্কিন সামরিক নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে নতুন মনোযোগ ও সমর্থন সুষ্টি হয়, কিছু প্রবীণরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ভিয়েতনাম ভেটেরান্সে যোগ দিয়েছিল।
আরো পড়ুনঃ
ভিয়েতনাম যুদ্ধঃ মার্কিন বাহিনীর পরাজয়ের করুণ ইতিহাস (পর্ব ১)
গভীর সমুদ্র তলদেশের জীববৈচিত্র্য এবং অদ্ভুত তাদের অভিযোজন ক্ষমতা
১৯৬৯ সালের ১৫ অক্টোবর ভিয়েতনাম মোরাটোরিয়াম লক্ষ লক্ষ মার্কিনকে আকর্ষণ করেছিল। ১৯৭০ সালে কেন্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চার শিক্ষার্থীর মারাত্মক গুলি চালানোর ফলে দেশব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে প্যারিস শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর এবং খসড়া সমাপ্তি এবং পরের মাসগুলিতে ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ প্রত্যাখ্যান হয়েছিল।
সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের মতােই ১৯৮৯ সালে ভিয়েতনাম কম্পুচিয়া থেকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। উল্লেখ্য, কম্পুচিয়ার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে খেমার রুজরা ‘চীনা লাইন’- এর প্রতিনিধিত্ব করত, অন্যদিকে হুন সেনরা প্রতিনিধিত্ব করত ‘সােভিয়েত-ভিয়েতনাম লাইন’। বলা যেতে পারে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে চীন ও সােভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে যে দ্বন্দ্ব ছিল, তার প্রতিফলন ঘটেছিল ইন্দোচীনে।
ভিয়েতনাম, কম্পুচিয়া ও লাওসে ক্ষমতাসীনরা ‘প্রাে-সােভিয়েত ইউনিয়ন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন। বিংশ শতাব্দীতে ভিয়েতনামের মুক্তি আন্দোলন ছিল অনেকগুলাে আলােচিত ঘটনার
একটি। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা গ্রহণ ও ‘সােভিয়েত লাইন’ গ্রহণ করলেও, সােভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের মতাে ভিয়েতনামে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেনি। তারা চীনের মতােই নিজস্ব আঙ্গিকে এখন সমাজতন্ত্রকে ধরে রেখেছে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সৈন্যদের করুণ পরিণতির ইতিহাস আজও বিশ্ববাসীর জানা। বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র ভিয়েতনামের সবচেয়ে বেশি সৈন্য হারিয়েছিল। এই যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনামে স্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
This is a Bengali article. It’s About 2nd episode of ‘Vietnam War’.
Necessary reference are hyperlinked inside article.
Featured Image: times.au