স্বাধীন ফিলিস্তানের উপর ইসরাইলি আগ্রাসন চলছে দীর্ঘ সত্তর দশক ধরে। এই দীর্ঘ সময়ে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ কর্তৃক কতজন ফিলিস্তিনের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা হয়েছে তার কোন সঠিক হিসাব নেই। ঘৃণিত গুপ্তহত্যার এই প্রক্রিয়া বর্তমানেও চলমান। ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতকেও একাধিকবার গুপ্তহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল মোসাদ। তবে ব্যর্থ হয়েছিল সবগুলোই। ব্যর্থ হওয়া এমনই একটি রোমাঞ্চকর ঘটনা নিয়ে আজকের আলোচনা করব।
সে সময় ইয়াসির আরাফাতকে হত্যার ধারাবাহিক মিশনে ছিল মােসাদ। হত্যার উদ্যোগগুলাে এক এক করে যখন ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন অভিনব এক পরিকল্পনা নিয়ে শীর্ষ গােয়েন্দাদের মুখােমুখি হন নৌ-বাহিনীর কর্মকর্তা বেনিয়ামিন শালিত। সুইডিশ বংশােদ্ভূত এই ইহুদি অফিসার একজন সাইকোলজিস্টও। আরাফাতসহ তারকা ফিলিস্তিনি যােদ্ধাদের হত্যা পরিকল্পনার জন্য তিন সদস্যের যে গােপন কমিটি করা হয়েছিল, তাদের কাছে নিজের পরিকল্পনা পেশ করন বেনিয়ামিন। ১৯৬২ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমা The Manchurian Candidate থেকে হত্যার কৌশলের ধারণা নেন এই সাইকোলজিস্ট। এই সিনেমায় দেখানাে হয়েছে কীভাবে একজন চীনা গােয়েন্দা কর্মকর্তা এক মার্কিন যুদ্ধবন্দিকে ব্রেনওয়াশ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিবার্চনে অংশ নেওয়া এক হত্যার জন্য পাঠায়। বেনিয়ামিন শালিত প্রস্তাব করেন, তিনিও আরাফাত হত্যায় এমন কিছু করতে চান। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কারাবন্দি এক ফিলিস্তিনিকে চাইলেন কমিটির সভায়।
ইজরাইলের কারাগারে তখন হাজারাে ফিলিস্তিনি। সভায় হাজির ছিলেন গােয়েন্দাসংস্থা আমানের প্রধান মেজর জেনারেল আহারুন ইয়ারিভ। তিনি ওই কমিটির সদস্য ছিলেন। বেনিয়ামিন কমিটির সদস্যদের বােঝালেন, তিনি ফিলিস্তিনি বন্দিকে ব্রেনওয়াশ করে তাকে কিলারে পরিণত করতে পারবেন, যে কিনা আরাফাতকে হত্যা করতে দ্বিধা করবে না। প্রস্তাব অনুমােদন করা হয়। শিনবেত সদস্যরা বেনিয়ামিনের কাছে বেশ কিছু ফিলিস্তিনি বন্দিকে নিয়ে আসে। তাদের মধ্য থেকে বেথেলহেমে জন্ম নেওয়া ২৮ বছরের এক যুবককে বাছাই করা হয়।
এই যুবককে দেখে মনে হয়েছিল, তিনি আরাফাতের নেতৃত্বে ক্ষুব্ধ। তাকে যখন আটক করে জেলে নিয়ে আসা হয়েছিল, তখন তিনি হেবরনের কাছের একটি ছােট্ট গ্রামে বসবাস করতেন। যুবকটি ছিল ফাতাহর তৃণমূল কর্মী। আরাফাত হত্যা মিশনে তার কোড নাম দেওয়া হয় ফাতখি (Fatkhi.)। আমানের আলােচিত ইউনিট-৫০৪-কে দায়িত্ব দেওয়া হলাে এই প্রজেক্টে সব ধরনের লজিস্টিক সাপাের্ট দিতে। কিন্তু এই ইউনিট থেকেই উঠেছিল কট্টর বিরােধিতা।
জেরুজালেমভিত্তিক ইউনিটটির প্রধান রাফি (Rafi Sutton) একে পাগলামি বলে মন্তব্য করেন। তার মতে, এটা একটা বন্য কল্পনা, যা সায়েন্স ফিকশনের কথা মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য আমান কমান্ডারের কথা আমলে নেওয়া হয়নি। বেনিয়ামিন শালিত তিন মাস ধরে ফাতখিকে নিয়ে কাজ করেন। তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমানাের চেষ্টা চালান শালিত। এমনভাবে ব্রেনওয়াশ করতে থাকেন, যেন সে পরিচালিত হবে অন্য কারও নির্দেশনায়। ফাতখির মাথায় ঢােকানাে হয়-
‘ফাতাহ ভালাে, পিএলও ভালাে। আরাফাত খারাপ, তাকে সরাতে হবে।
এভাবে ফিলিস্তিনি যুবককে Programmed Killer বানানাের দিকে এগিয়ে যান সাইকোলজিস্ট শালিত। দুই মাস পর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে থাকে ফাতখি। বেনিয়ামিন বুঝতে পারেন, তার পরিকল্পনা কাজ করছে ঠিকঠাকমতাে।
ব্রেনওয়াশের দ্বিতীয় ধাপে ফাতখিকে বিশেষভাবে তৈরি একটি কক্ষে রাখা হয়, হাতে দেওয়া হয় পিস্তল। রুমের বিভিন্ন কোনায় আরাফাতের ছবি টাঙিয়ে তাকে বলা হতাে ‘shoot to kill Arafat’… ব্রেনওয়াশের এই প্রশিক্ষণ আমানপ্রধানসহ তিন সদস্যের কমিটির অন্যান্যরা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে যেতেন।
১৯৬৮ সালের মধ্য ডিসেম্বরে বেনিয়ামিন শালিত জানালেন, এবার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। ১৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে জর্ডান নদী সাঁতরিয়ে তাকে জর্ডানে পাঠানাের সিদ্ধান্ত হয়। রাত ১টা নাগাদ ইজরাইলি গােয়েন্দা কর্মকর্তাদের সহায়তায় জর্ডানে প্রবেশ করে ফাতখি। কিন্তু পাঁচ ঘণ্টা পর যে তথ্য আসে, তার জন্য ইজরাইলি গােয়েন্দারা মােটেও প্রস্তুত ছিলেন না। জর্ডানে ইজরাইলের এক এজেন্ট ইউনিট-৫০৪-কে এক বার্তায় জানায়, ফাতাহর এক যুবক কর্মী পিস্তলসহ কারামেহ পুলিশ স্টেশনে পৌঁছেছে। তিনি পুলিশ সদস্যদের জানিয়েছেন, ইজরাইল তার ব্রেনওয়াশ করে তাকে দিয়ে আরাফাতকে হত্যা করতে চেয়েছিল।
হতবাক হয়ে যান ইহুদি গােয়েন্দারা। কদিন পরই ইয়াসির আরাফাতের সমর্থনে এক আবেগঘন বক্তব্য দেন ফিলিস্তিনি ওই যুবক। ছয় দিনের আরব-ইজরাইল যুদ্ধের সময় ও পরবর্তীকালে ইয়াসির আরাফাতকে হত্যার কয়েক দফা চেষ্টা চালায় ইজরাইল। যুদ্ধ শেষে শিনবেতের এক ইনফরমার তথ্য দেয়, আরাফাত জাফা গেটের অদূরে জেরুজালেমের ওল্ড সিটিতে লুকিয়ে আছেন। ইজরাইলি একটা কন্টিনজেন্ট আরাফাতকে ধরতে সেখানে যায়। তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছার মাত্র কয়েক মিনিট আগে আরাফাত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
এর দুদিন পর আরেকটি গােপন খবরের ভিত্তিতে জেরুজালেমের পূর্বে বেইত হানিয়া নামের একটি গ্রাম ঘিরে ফেলে একদল ইহুদি সেনা। তারা একটি অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে, তবে আরাফাত এ দফায়ও পালাতে সক্ষম হন। পরদিন একজন সঙ্গীকে সাথে নিয়ে নারীর ছদ্মবেশে ক্যাবে চড়ে একটি ব্রিজ হয়ে জর্ডান নদী অতিক্রম করেন তিনি।
দিনদিন ইজরাইলের বিরুদ্ধে ফাতাহর প্রতিরােধ আক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করল। এই আক্রমণগুলাে সমন্বয় করা হতাে জর্ডান উপত্যকার দক্ষিণে অবস্থিত কারামেহ থেকে। এখানেই সদর দপ্তর স্থাপন করেছিল ফাতাহ। ইজরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ফাতাহর বিরুদ্ধে বড় ধরনের অপারেশন পরিচালনা করার অনুমতি চেয়েছিল, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লেভি এ ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। এ নিয়ে হতাশ ছিল মােসাদ। কায়সারেয়ার প্রধান জাভি আহারনি আরাফাতকে হত্যা করতে ভিন্ন উপায় খোঁজার পরামর্শ দেন।
এরপরই আরেকটি পরিকল্পনা হাজির করা হয় ১৯৬৮ সালে । ইউরােপ থেকে একটি বিস্ফোরক বােঝাই গাড়ি বৈরুতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে যাবেন কায়সারেয়ার একজন সদস্য, তিনি ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে এটা করবেন। গাড়িটি আরাফাতের বাসার কাছেই রাখা হবে আর সময়মতাে রিমােট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটানাে হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লেভি এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন ইজরাইলি পলিটিশিয়ানদের ওপর পালটা আক্রমণের আশঙ্কায়। কারণ, আরাফাত ততদিনে আর মিলিটারি কমান্ডার নেই, হয়ে উঠেছেন রাজনৈতিক নেতা। অবশ্য ফাতাহর আক্রমণ বেড়ে গেলে আরাফাত হত্যার অনুমােদন দেন ইজরাইলি প্রধানমন্ত্রী।
২১ মার্চ, ১৯৬৮। ইজরাইলি কমান্ডােরা হেলিকপ্টারে চড়ে কারামেহর কাছে মরুভূমি এলাকায় অবস্থান নেয়। এর আগের রাতে ফাতাহর সদর দপ্তর গুঁড়িয়ে দেওয়ার অনুমতি দেয় ইজরাইলি মন্ত্রিসভা। দিনের আলােতেই অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু যতটা সহজ ভাবা হয়েছিল, ইজরাইলের পক্ষে অভিযানটি তত সহজ হয়নি। ফাতাহ কঠোর প্রতিরােধ গড়ে তােলে। ৩৩ ইজরাইলি সেনা নিহত হয় লড়াইয়ে। একশাের বেশি ফিলিস্তিনি আর ৬১ জর্ডানি নাগরিক নিহত হয়। ফাতাহ দাবি করে, পালটা হামলায় ইজরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী মােশে দাওয়ান আহত হয়েছেন। এ ঘটনার পর ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনিদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতায় পরিণত হলেন। কারামেহ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর আরও বিধ্বংসী ও বিকল্প হামলার উপায় খুঁজতে থাকে ইজরাইল। এমনই একটি অভিনব উপায় নিয়ে হাজির হয়েছিলেন সুইডিশ বংশোদ্ভূত নৌ-বাহিনীর সাইকোলজিস্ট বেনিয়ামিন শালিত।
This is a bengali article. it’s about The way a Palestinian youth cheated on Mossad.
All the necessary reference are hyperlinked inside article.