লিখুন
ফলো

রঙবেরঙের মেঘের ইতিবৃত্ত

নীল আকাশে সাদা। মেঘের ভেলা শরতের সবচেয়ে নয়নাভিরাম দৃশ্য। এই নয়নাভিরাম দৃশ্যকে উপভােগ করার জন্য আপনাদেরকে নিয়ে যাবাে বাহারি মেঘের রাজ্যে। তার আগে চলুন মেঘ সম্পর্কে একটু ধারণা নেয়া যাক। মেঘ বলতে পৃথিবীর বা অন্য কোনাে গ্রহের আবহাওয়া মন্ডলে ভাসমান জলকণার সমষ্টি বােঝানাে হয়। সাধারণত পানি পৃথিবীতে কোথাও স্থির অবস্থায় থাকে না। বিভিন্ন মাধ্যমে আবর্তিত ও অবস্থার পরিবর্তন হয়। 

রঙবেরঙের মেঘ
বিভিন্ন ধরণের মেঘ; image: wikipedia
আমরা সাধারণভাবে পানিকে কঠিন, তরল, বায়বীয় তিন অবস্থায় দেখে থাকি। বায়বীয় অবস্থারই পরিবর্তিত রূপহল মেঘ। পানির সবচেয়ে বড় ও স্থায়ী উৎস হল সমুদ্র, এ ছাড়াও রয়েছে নদী-নালা খাল-বিল। সূর্যের তাপে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে এসব উৎস থেকে পানি হালকা হয়েবাষ্প আকারে উপরে ওঠে। এই বাষ্প ঠান্ডা ও ঘনীভূত হয়ে তৈরি হয় ভাসমান মেঘ। ভুপৃষ্ঠ থেকে জলীয় বাষ্প যতই উপরে উঠতে থাকে ততই ঠাণ্ডা ও ঘনীভূত হতে থাকে। সাধারণত ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬,৫০০ ফুট উঁচু থেকে ঘনীভবন শুরু হয়। 




এই ঘনীভূত মেঘ অনেকটা ঘন কুয়াশার মতো এই কুয়াশামণ্ডলী প্রচণ্ড বাতাস প্রবাহের কারণে হিমায়িত অঞ্চলে পৌছলে আরাে ঠাণ্ডা হয়ে পানির কণায় পরিণত হয়। নিচ থেকে উষ্ণ বাতাসের সাথে ধুলিকণা উপরে আসলে এই ধুলিকণাকে কেন্দ্র করে পানি জমতে থাকে।

এক পর্যায়ে পানির কণা পাঁচ সেন্টিমিটারের বড় হলে তা মাধ্যাকর্ষণের টানে বৃষ্টি হয়ে ভূমিতে পড়ে। বৃষ্টি হওয়ার ক্ষেত্রে তাপমাত্রা বিশেষ ভূমিকা রাখে। উপরের শীতল বায়ু যেমন বাষ্পকে ঠান্ডা করে মেঘে পরিণত করে তেমনি নিচের উষ্ণ বায়ু মেঘ থেকে বৃষ্টি নামতে ভূমিকা রাখে। 

শিলা বৃষ্টি

আবার অনেক সময় পানির কণা অতিরিক্ত ঠাণ্ডা হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফ কণায় পরিণত হয়। এই বরফ কণা হিমায়িত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভূ-পৃষ্ঠের দিকে আসার

সময়। চারদিকের হিমায়িত ও ঘনীভূত কুয়াশার কারণে বরফ কণার আয়তন বেড়ে যায়। গড়ে একটা শিলার ব্যাস প্রায় পাঁচ থেকে এক শ পঞ্চাশ মিলিমিটার হতে পারে। সাধারণত পুঞ্জ বর্ষণ (Cumulonimbus clouds’) মেঘ শিলা বৃষ্টির জন্য দায়ী। ঝড়াে আর সংকটপূর্ণ আবহাওয়াতে শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহ উপরের দিকে উঠতেথাকলে শিলা তৈরি হয়। উষ্ণ বায়ু উপরের দিকে উঠতে থাকে, আর শীতল বায়ু নিচের দিকে নামতে থাকে। সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ খুব হিমায়িত পানির উৎস তৈরিহয়। তখন শীতল পানির দানা আর শীতল বায়ুর সংমিশ্রণে মেঘে বরফ জমতে জমতে তৈরি হয় শিলা। 

শিলাবৃষ্টি; image: thoughtco

ঐ উর্ধ্বমুখী বায়ু এমন একটা অবস্থানে পৌঁছায় যেখানে তাপমাত্রা শূন্যের নিচে চলে যায় এবং পানি বরফ হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে উর্ধ্বমুখী বায়ুতে সৃষ্ট বরফখন্ড ঐবায়ুর প্রবাহ থেকে ছুটে গিয়ে নিচের দিকে পড়তে থাকে। এই উর্ধ্বমুখী বায়ুর উপরে উঠে যাওয়ার পরে বরফ কণা সৃষ্টি হয়ে নিম্নগামী হওয়ার প্রক্রিয়া বার বার চলতে থাকে এবং বরফ কণার উপর আস্তরণ জমা হয়ে তা বরফ খন্ডের আকার নেয়। 

এই উধ্বর্মুখী বাতাসের কিন্তু বেশ ভালােই গতি থাকতে হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই গতি ঘণ্টায় ৬০ মাইলও হতে পারে। শিলা উর্ধ্বাকাশ থেকে পতিত হবার সময়। কিছুটা গলে যায়, আবার ঊর্ধ্বমুখী বায়ুর সাথে উপরে উঠে যায়। এভাবে ওঠা-নামা করতে থাকে। খুব বড় আকারের শিলাখন্ড আসলে অনেক বারের পুনঃ প্রক্রিয়ারফসল।



এই শিলাখন্ডগুলাে বৃষ্টির পানির কণা বা মেঘকে আশ্রয় করে এবং যখন এগুলাে ক্রমশ ভারী হয়ে উঠে এবং উর্ধ্বগামী বায়ু আর এতটা ভারী কণা বহন করতে পারে না, তখন শিলাখন্ড বৃষ্টির সাথে ভূমিতে পতিত হতে থাকে। যাকে আমরা শিলাবৃষ্টি হিসেবে দেখতে পাই। 

মেঘদের আচরণ ও বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়: স্তরীভূত ও পরিচলনশীল। মূলত মেঘকে তার পাদদেশের উচ্চতা দিয়ে শ্রেণিবিভাগ করা হয়, চূড়ার উচ্চতা দিয়ে নয়। এই পদ্ধতি ১৮০২ সালে লুক হাওয়ার্ড আস্কেসিয়ান সােসাইটিতে প্রস্তাব করেন। আচরণগত দিক দিয়ে স্তরীভূত ও পরিচলনশীল দুই ভাগে ভাগ করা হলেও উচ্চতার দিক দিয়ে উঁচু, মধ্যম ও নিচু তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এসব মেঘ সাধারণত ৩০,০০০ থেকে৪০,০০০ ফুট উচ্চতায় থাকে। মেঘগুলাে পৃথিবী থেকে ৬,৫০০ ফুট উপর থেকে শুরু হয়। 

এই বিশাল উচ্চতার কারণে সূর্যের আলাে মেঘ ভেদ করে পৃথিবীতে আসতে না পারার কারণে মেঘকে কালাে দেখায়। আমরা আকাশে যে নানা রঙ বেরঙের মেঘ দেখি, তাদের সাথে চলুন পরিচিত হই।  

মৌলিক বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে মেঘের সাধারণ শ্রেণিবিভাগ-

১. অলক মেঘ (Cirrus clouds) : এই মেঘ বায়ুমন্ডলে সর্বোচ্চ উচ্চতার মেঘ। বাতাসের তাপমাত্রা ও বায়ুমন্ডলের উচ্চতার কারণে এ সকল মেঘ দেখতে বরফ স্ফটিকের পাখনার মত। মেঘের উপরে অনেক উচ্চতায় এরা গঠিত হয়। সাধারণত পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে দশ মাইলের মত উচ্চতায় গঠিত হয়ে থাকে। সূর্যাস্তের আগে এবং সূর্যাস্তের পরে, চকচকে প্রায়ই উজ্জ্বল হলুদ বা লাল রঙিন হয়। এই মেঘগুলি অন্য মেঘের অনেক আগেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং পরে অনেক সময় বিবর্ণ হয়ে যায়। এই মেঘস্থল থেকে এতদূরে যে পৃথিবীর পৃষ্ঠে তাপমাত্রার পরিবর্তনের কোনাে প্রভাব পড়ে না। 

অলক মেঘ; image: thoughtco

২. অনুভূমিক মেঘ (Stratus clouds): সাধারণত এ ধরণের মেঘ মাটি থেকে মাত্র কয়েকশো ফুট উপরে গঠিত হয়। এরা হালকা-পাতলা, কুয়াশার মতাে। ভাের বেলা কিংবা সন্ধ্যায় যখন বাতাস স্থির থাকে, তখন এ ধরনের মেঘ দেখা যায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় এরা ভূমির সাথে মিশে গেছে। ঘন কুয়াশা বা মেঘলা আকাশ এই মেঘেরই ফলাফল। অনুভূমিক মেঘ (Stratus clouds) থেকে ভারী বৃষ্টি আর তুষারপাত হয়। 



৩. পুঞ্জ মেঘ (Cumulus clouds):এগুলাে দেখতে সুন্দর পুঞ্জীভূত মেঘ। গ্রীষ্মকালে এদের দেখা যায়। পৃথিবী থেকে মাত্র এক মাইল উপরে থাকে এবং মাটিতে দ্রুত ধাবমান ছায়া ফেলে। মধ্য বিকেলে সূর্য যখন সর্বাধিক উষ্ণ থাকে, তখন এরা আকার ও সংস্থা। বেড়ে যায় এবং এদের শীর্ষদেশ কয়েক মাইল পর্যন্ত উচ্চতায় উঠে যায়। সন্ধ্যাবেলা এ অনুভূমিক মেঘের স্তরে মিশে অদৃশ্য হয়ে যায়। 

৪. জলদ মেঘ (Nimbus clouds): এগুলাে হচ্ছে ঘন ধূসর বর্ণের বর্ষণ মেঘ। এদের গঠন-প্রকৃতি আকার বিহীন। বর্ষণ মেঘের নিচের দিকে অর্ধাংশ থাকে জলকণায় ভারী যা কখনও কখনও বৃষ্টির ফোঁটায় পরিণত হয়ে নিচে পতিত হয়। নানা ধরনের মেঘ আবার সংযুক্ত হয়ে জলদ মেঘ তৈরী হয়। ভারী বজ্রপাতের উৎস এই মেঘ। আবার মৌসুমী বায়ু প্রবাহ এই মেঘের সঙ্গী হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডােও হয়ে থাকে। 

অনুভূমিক মেঘ; image: wikipedia

৫. উচ্চপুঞ্জ মেঘ (Auto-cumulus clouds): দেখতে গােলাকার, মহাতরঙ্গময়, সাদা কিংবা ধূসরাভ। এগুলাে ছােট ছােট মেঘপুঞ্জের ঘন সন্নিবিষ্ট রূপ। আট থেকে বিশ হাজার ফুট উচ্চতায় এদের দেখা যায়। 

৬.উচ্চ অনুভুমিক মেঘ (Alto-stratus clouds): দেখতে পুরু, ধুসর নীলাভ পাতের ন্যায় মাটি থেকে সাড়ে ছয় হাজার থেকে বিশ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থান করে। 

৭. ঘন অনুভূমিক মেঘ (Cirro-stratus): বিশ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বরফ স্ফটিকে গঠিত এক প্রকার পাতলা সাদা পাতের মতাে মেঘ। এই মেঘ বায়ুমন্ডলে উচ্চ পরিমাণে আর্দ্রতার প্রমাণ। এটি দেখতে লােমযুক্ত (চুলের মত) বা মসৃণ চেহারা সঙ্গে স্বচ্ছ, সাদা কুঁজে মেঘ। এরা পুরাে আকাশ আচ্ছাদন করে থাকে, সময়ের সাথে সাথে পুরাে আকাশে ছড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় । 

image: national Geographic

৮. অলকাপুঞ্জ মেঘ (Cirro-cumulus): ঘন মেঘমালার ভেতরে গঠিত এক টুকরা মেঘ যা দেখতে সাগর তীরস্থ বালুকারাশির ঢেউয়ের মত। অলকাপুঞ্জ মেঘ প্রায় ৫ থেকে ১০ কিলােমিটার (প্রায় ১৬,৬০০ এবং ৩০,০০০ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত। এর স্তর পাতলা হওয়ায় সূর্য বা চাঁদের আলােতে কোনাে বাধা সৃষ্টি করে না। 

৯. পুণ্ড বর্ষণ (Cumulonimbus clouds): এই মেঘকে বয় মস্তক বলা হয়। এরা অনেকটা দেখতে ফুল কপির মতাে। এই ধরণের মেঘ বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে উপর পর্যন্ত দেখাযায়। সাধারণত পুঞ্জ বর্ষণ (Cumulonimbus clouds’) মেঘ শিলা বৃষ্টির জন্য দায়ি। 



১০. অনুভূমিক পুঞ্জ (Strato-cumulus): এই মেঘ হচ্ছে সেই সব বিন্দু বিন্দু মেঘ যা পৃথিবী পৃষ্ঠের কাছাকাছি থেকে শুরু করে সাড়ে ছয় হাজার ফুট উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে । এরা আমাদেরকে শীতকালের আগমনী বার্তা দেয়। 


This is a bengali article. Here Described Characteristics of different types of clouds. 

All the reference are hyperlinked within article. 

Featured Image: Ten Minutes School 

Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous Article

বিদ্যুৎ কিভাবে আবিষ্কার হলো?

Next Article

চুম্বক: মানব ইতিহাসের এক চমকপ্রদ আবিষ্কার

Related Posts

কাঞ্চনজঙ্ঘা: তুষারধবল শুভ্রতায় আচ্ছাদিত ওপারের স্বর্গ

পর্বতের প্রতি মানুষের বিনম্র শ্রদ্ধা সেই আদিকাল থেকেই। আর পর্বতের চূড়া জয় করার মতো গৌরবের ভাগীদার হতে মানুষ…

বিশ্বের একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশ ভুটান

সূচিপত্র Hide ধরিত্রী দিবস ও ভুটানসবুজে ঘেড়া ভুটানজলবায়ুভুটানের ইতিহাস ও সংস্কৃতিখাবার ক্যালেন্ডারের পাতায় আজ ২২ এপ্রিল। আজ বিশ্ব…

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড: বঙ্গোপসাগরে অজানা রহস্য

সূচিপত্র Hide উৎপত্তিনামকরণজীববৈচিত্র্যব্লু ইকোনমিতে গুরুত্ব আমরা অনেকেই ‘মারিয়ানা ট্রেঞ্চ’ এর নাম শুনেছি। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ হলো পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম…

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন

Total
0
Share