আমাদের বাঙ্গালীদের জীবনের অন্যতম বিষয় হচ্ছে রসগোল্লা। যে কোন অনুষ্ঠানের শেষ পাতে রসগোল্লার ছাড়া যেন আমাদের চলেই না। রসগোল্লার মতো জনপ্রিয় খাবার বাংলায় খুব কমই রয়েছে। এর স্বাদ সবাইকে বিমোহিত করে রেখেছে প্রায় পুরো পৃথিবী রসগোল্লার পাগল এখন। কিন্তু এই রসগোল্লা কিভাবে আসলো এটা কি একবারও ভেবে দেখেছেন নাকি জানেন? আজকের ব্লগের বিষয় হচ্ছে রসগোল্লার আসল গল্প নিয়ে।
রসগোল্লার স্বপ্ন আর নবীন চন্দ্র দাস
রসগোল্লা এবং ভারত উপমহাদের সম্পর্ক কিন্তু নতুন নয় ১৫০ বছরের বেশি আগে এর সুত্রপাত হয় বাগবাজারে। ১৮৬৮ সালের দিকে নবীন চন্দ্র দাস রগগোল্লা আবিষ্কার করেন। এর কারণে তাকে রসগোল্লার কলম্বাস বলা হয়।
সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আজো বিশ্ব মাতিয়ে রাখছে নবীন চন্দ্রের রসোগোল্লা। কিন্তু এর শুরুটা কিন্তু এত সহজ ছিলো না। এর পিছনে রয়েছে প্রচন্ড রকমের স্ট্রাগল। নবীন চন্দ্র দাসের ব্যর্থতার নতুন ব্যবসা শুরুর গল্প আর তার সাথে নবীন চন্দ্র দাস ক্ষীরোদমণি দেবীর প্রেমের গল্প।
নবীন চন্দ্র দাসের জম্ম ১৮৪৫ সালে। তার পূর্ব পুরুষদের চিনির ব্যবসা ছিলো। নবীন চন্দ্রের জম্মের আগেই তার বাবা মারা যান তাই বেশি দূর পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি তার। ছোট নবীন আর তার বিধবা মা পূর্ব পুরুষদের ভিটায় থাকলেও নানান অজুহাতে তাদের ছোট করা হত। তাদের বংশ আর্থিকভাবে সচ্ছল হলেও বাবা না থাকায় মা ছেলের কষ্ট কম ছিলো না। তিনি খুব সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। রান্নাবান্নার প্রতি ভালোবাসা থেকে নবীন সিধান্ত নেন তিনি ময়রার কাজ করবেন। কিন্তু এতে নারাজ হন তার চাচারা। তারা বলে দেন তাদের বংশের কেউ এই কাজ করেনি নবীনও করতে পারবে না। কিন্তু নবীন চন্দ্রের মা ছেলের পক্ষ নেন। তাই সেসময়ের কলকাতার বাগবাজেরের কালিদসের দোকানে ছেলের জন্য কাজের ব্যবস্থা করেন তার মা। কিন্তু সেখান থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে সে চাকরি ছেড়ে দেন নবীন। সে সময়ে নিজের চাচারা মা ছেলেকে সাহায্য না করে উল্টো বিতাড়িত করে বাড়ি থেকে বের করে দেন।
কিন্তু সব মন্দের মাঝেও কিছু ভাল থাকে। কালিকাদাসের দোকানে চাকরি নেওয়ার পর তার সাথে দেখা হয় কিশোরী ক্ষীরোদমণির সাথে। এই কিশোরী নবীন চন্দ্র দাসের কাছে বলে এমন একটা মিষ্টি বানাতে যেটা ভারতে নেই আর এই মিষ্টি হবে ধবধবে সাদা আর তুলতলে রসে ভড়া। তার কথা থেকেই নবীন চন্দ্র নতুন এই মিষ্টি বানাতে লেগে যান। পরবর্তীতে এই ক্ষীরোদমণির সাথেই বিয়ে হয় নবীন চন্দ্র দাসের।
রসগোল্লার যাত্রা
আগেই বলেছি এই যাত্রা কিন্তু খুব সহজ ছিলো না। নতুন কাজের সন্ধান করার সময় কোথাও কাজ পাচ্ছিলেন না তরুণ নবীন চন্দ্র। এক পর্যায়ে পূর্ব পরিচিত এক ব্যক্তির নবীনকে তার সাথে মিষ্টির ব্যবসা করার প্রস্তাব দিলে সাড়া দেন নবীন। তখন জোড়াসাঁকোতে মিষ্টির দোকান দেন। তখন থেকে প্রায় প্রতি রাতেই ক্ষীরোদমণির আবদারের মিষ্টি বানাতে পরিশ্রম করতেন। ঐ সময়ে রসগোল্লা না হলেও আম দিয়ে মিষ্টি, দেদো সন্দেশ, আতা সন্দেশ, আর বৈকুণ্ঠ ভোগের মত সেরা মিষ্টিগুলো তৈরি করে ময়রার পরিচিতি পান। তার বৈকুণ্ঠ ভোগের জুড়ি নেই।
ভাগ্য সহায় না থাকায় জোড়াসাঁকোর দোকানে তালা পরে। এ সময়ে খুব বাজে ভাবে ভেঙ্গে পরেন নবীন। ততদিনে আবদার করা ক্ষীরোদমণি তার স্ত্রী তিনিই শক্তভাবে নবীনকে সাহস দেন নতুন করে নিজের ব্যবসা শুরু করতে। পুরোদমে সাহস নিয়ে বাগবাজারে বসলো নতুন মিষ্টির দোকান। এই দোকানের মালিকের নাম নবীন চন্দ্র দাস। আবারও শুরু হলো রাত জেগে নতুন মিষ্টি অর্থাৎ রসগোল্লা বানানোর চেষ্টা। কিন্তু প্রতিবারই রসে ছানার বল দিতেই ভেঙে যেতো। আপ্রাণ চেষ্টার পরে একসময় তৈরি হল নবীন চন্দ্রের স্বপ্নের মিষ্টি রসগোল্লা। যার আবদারে এই মিষ্টি করা অর্থাৎক্ষীরোদমণিই প্রথম স্বাদ নিলেন নতুন মিষ্টির। রসগোল্লার স্বাদ এতই পাগল করা ছিল যে সে সময় ধীরে ধীরে নবীন চন্দ্র দাসের মিষ্টির কথা সবার কাছে ছড়িয়ে যেতে থাকলো। বিয়ে হোক কিংবা বাড়িতে নতুন মেয়ে জামাই আপ্যায়ন সবক্ষেত্রেই শেষপাতে পরতে থাকলো নবীনের রসগোল্লা। অনেক ময়রাই নবীন চন্দ্র দাসের থেকে শিখতে লাগলো কিভাবে তৈরি হয় এই মজার মিষ্টি তার উপায়। সাদাসিধে নবীনো কাউকে কখনো না করেনি নিজের একা ব্যবসা করার জন্য।
নবীন চন্দ্র দাস কিন্তু নতুন মিষ্টি বানাতে অনেক গবেষণা চালাতেন। আলাদা স্বাদে সেরা মিষ্টি তৈরি করা ছিলো তার নেশার মত। তিনি যেসব জনপ্রিয় মিষ্টি তৈরি করেছেন এর মধ্য আছে ফল দিয়ে মিষ্টি, দেদো সন্দেশ, আতা সন্দেশ, আর বৈকুণ্ঠ ভোগ, কাস্তুরা পাক অন্যতম। এসব মিষ্টি স্বাদে কিন্তু সেরা ছিলো। বিশেষ করে বৈকুণ্ঠ ভোগ তো অতুলনীয়।
ক্যানজাত রসগোল্লা রপ্তানি
রসগোল্লা যাতে দেশের বাইরে বিক্রি করা যায় তার উদ্যোগ নেন নবীন চন্দ্র দাসের একমাত্র ছেলে কৃষ্ণ চন্দ্র দাস অর্থাৎ কে সি দাস। ১৯৩০ সালে তিনি বায়ু প্রতিরোধক টিনের কৌটায় রসগোল্লা প্রক্রিয়াকরণ শুরু করেন। এতে করে দীর্ঘ সময় রসগোল্লা ভালো থাকতো স্বাদো নষ্ট হতো না। এভাবেই বিদেশে রপ্তানি শুরু হয় রসগোল্লার। একে বলা হয় যেটিকে বলা হয় ক্যানডজাত রসগোল্লা।
এর পর রসগোল্লার খ্যাতি গোতা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে। কেসি দাসের মিষ্টির দোকানের ব্রাঞ্জ এখন কলকাতার বাইরেও রয়েছে।
রসগোল্লার কিছু তথ্য
এমনো শোনা যায় ছোট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রসগোল্লা খেতে ভালোবাস্তেন। আর তিনি কেবল নবীনের রসগোল্লাই খেতেন।
রসগোল্লার আবিষ্কার কে করেছিলো এনিয়ে ওড়িশা ও কলকাতার মধ্যে মামলা চালাচালিও হয়েছিল। সকল তথ্য প্রমাণের প্রমাণিত হয় যে কলকাতার নবীন চন্দ্রই প্রথম রসগোল্লা আবিষ্কার করেছিলেন।
এখন কিন্তু কেবল ধবধবে সাদা রসগোল্লা নয় নানান স্বাদের নানান বাহারের রসোগোল্লা রয়েছে। যেমন আম রসগোল্লা, নলেন গুড়ের রসগোল্লা।
২০০১ সালের দিকে মিষ্টি প্রস্তুতকারক সংস্থা বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিক নিয়ে আসেন বেকড রসগোল্লা।
২০১৮ সালের নবীন চন্দ্র দাসের জীবন নিয়ে ‘রসগোল্লা’ সিনেমাটি দর্শক মাতায়। চিত্রনির্মাতা পাভেল সমাতাটি পরিচালনই করেন।
নিরামিষের সাথে আমিষের প্রচলন
ছোট বেলা থেকেই রান্নার প্রতি আগ্রহ ছিলো নবীনের। আগে কিন্তু এখনকার মত আমিষের সাথে নিরামিষ রান্নার প্রচলন ছিলো না। অর্থাৎ সে সময়ে মাছ দিয়ে সবজি রান্না করা হত না। মাছ রান্নায় শুধু মাছ থাকতো আর সবজিতে শুধুই সবজি রান্না করা হত।
নবীন চন্দ্র দাস প্রথম মোচার ঘোন্টের সাথে চিংড়ি মাছ দিয়ে নিরামিষের সাথে আমিষ খাবার রান্না শুরু করেন। এটা তো বর্তমান সময়েও অনেক জনপ্রিয় একটি পদ বাঙ্গালীদের কাছে।
শেষ কথা
মানুষের কর্ম তার আবিষ্কারের যে তার নামটি স্মরণীয় করে রাখে রাখে তার একটা বড় উদাহরন কিন্তু রসগোল্লা। সেই কবে এক তরুণ ময়রা তার প্রিয় মানুষটির আবদার রক্ষা করতে নতুন মিষ্টি তৈরি চেষ্টা শুরু করেন এরপর এপান সফলতাও। আর পরিশ্রম তার কাজ তাকে আজ আমাদের কাছে এখনো জীবিত রেখেছে। তিনি যদি একবার ব্যর্থ হয়ে থেমে যেতেন তবে হয়তো আজ আমরা রসগোল্লা নামের কোন মিষ্টির দেখাই পেতাম না। তাই হতাশ না হয়ে জীবনে চেষ্টা করা শুরু থেকেই সফলতা চাবিকাঠির সূচনা হয়।
আরো পড়ুনঃ
পাস্তার ইতিহাস
পাস্তাঃ যে খাবার ছাড়া ইতালিয়ানরা এক প্রকার অসম্পূর্ণ
This is a Bengali Article. Here, everything is written about the SWEETS.
The featured image is taken from Google
All links are below:
https://www.google.com/amp/s/www.kalerkantho.com/amp/online/miscellaneous/2015/07/03/240852
https://bangla.365reporter.com/how-nabin-chandra-das-become-the-inventor-of-rosogolla/