জ্যোৎস্নাত রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা অবাক হই। অগণিত তারকামণ্ডলী, গ্রহ এসব কিছু এখনো বড়ই রহস্যময় আমাদের কাছে। তবে মানবজাতীও থেমে নেই এই রহস্য উন্মোচনে। চন্দ্রজয়তো করেছি ৫০ বছর আগে, মঙ্গল জয়ও বেশি দূরে নেই। প্রযুক্তির কল্যাণে আজ মহাকাশের অনেক কিছুই আমাদের জানা। অথচ সেই তুলনায় আমরা আমরা তেমন কিছুই জানি না বিশাল সাগরের তলদেশ নিয়ে।
ছোটবেলা থেকেই আমরা ভূগোল বইয়ে পড়ে আসছি, পৃথিবীর তিনভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। এই এক ভাগ স্থলের উপর গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতা। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষসহ স্থলভূমির সকল জীবকূল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভর এই সাগরের উপর। অথচ সেই সাগর এখনো অজানা আমাদের কাছে। বিশেষ করে সাগরের তলদেশ। আজ থেকে আরো দুই বছর আগে বলা হত সাগরের গভীরতম অংশের চাইতে চাঁদে এখন পর্যন্ত বেশি মানুষের পদচারণা হয়েছে। এর কারণটা বোঝাও অতটা কষ্টকর না।
একটা সময় মানুষের ধারণা ছিল সমুদ্রের তলদেশে কোন জীবন থাকতে পারে না। ভিক্টোরিয়ান বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ফোর্বস তার বিখ্যাত ‘এজোয়িক হাইপোথেসিস’এ উল্লেখ করেন, সমুদ্রের যতই গভীরে যেতে থাকি, জীববৈচিত্র্য ততই কমতে থাকে। তার মতে সমুদ্রের ৫৫০ মিটারের চেয়ে বেশি গভীরে কোন প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। ফোর্বসকে ভূল প্রমাণিত করতে বেশি সময় নেয়নি মানুষ। ১৯৬০ সালে ডন ওয়ালশ এবং জ্যাকস পিকার্ড যখন ইতিহাস সৃষ্টি করে প্রথমবারের মত মারিয়ানা ট্রেঞ্চের সবচাইতে গভীর অংশ চ্যালেঞ্জার ডিপ, যেটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০,৯০০ মিটার গভীরে, সেখানে গিয়ে দেখতে পান জীবন অস্তিত্ব। সমুদ্র তলদেশের এই ভিন্ন জগতের জীববৈচিত্র্য অবাক করেছে সবাইকেই। কারণ তারা বেঁচে আছে পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন পরিস্থিতিতে। যেমন:
১. সূর্যের আলো কেবল সাগরের ২০০ মিটার পর্যন্তই যেতে পারে। এর ফলে বিভিন্ন ফাইটোপ্লাংকটন এবং উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ হয়ে থাকে এই ২০০ মিটারের মধ্যেই। এই গভীরতার পর সাগর একেবারেই অন্ধকার। যেহেতু কোন সালোকসংশ্লেষণ হয়না, তাই সেই গভীরতায় থাকা প্রাণিদের খাদ্যের জন্য অন্য প্রাণির উপর নির্ভর থাকতে হয়।
২. সাগরের প্রতি ১০ মিটার গভীরতায় ১ বায়ুমন্ডলীয় চাপ বৃদ্ধি পায়। সুতরাং সমুদের সবচাইতে গভীর অংশের পানির চাপ আমরা সমুদ্রের বাইরে যে চাপ অনুভব করি তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি! এই চাপ সাবমেরিনকে একেবারে গুড়িয়ে দিতে পারে।
৩. সমুদ্রের গভীরের তাপমাত্রা থাকে অনেক কম যেহেতু সেখানে সূর্যের আলো পৌছাতে পারে না। তবে এটা নির্ধারণ করা অতটা সহজ কাজ নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০০ মিটার অব্ধি তাপমাত্রা স্থানভেদে পরিবর্তন হলেও সমুদ্রের ৫০০০-৫৫০০ মিটার গভীর থেকেই মোটামুটি তাপমাত্রা থাকে -১ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে (লবণের উপস্থিতির কারণে সমুদ্রের পানি -১.৯৪ ডিগ্রির আশেপাশে তাপমাত্রায় বরফে পরিণত হয়)। তবে সেখানে কোন ‘হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট’ থাকলে তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে, যা নিয়ে একটু পরেই আলোচনা করব।
কিছু কিছু প্রাণী যেমন জেলিফিশ, কোম্ব জেলি, স্যাল্পস খাবারের সন্ধানে গভীর তলদেশ থেকে উপরে উঠে আসতে পারে। কিন্তু গভীর সাগরের তলদেশে থাকা বেশিরভাগ প্রাণী, সেখানেই আবদ্ধ থাকে। সুতরাং দেখাই যাচ্ছে, সাগরের গভীর তলদেশে বেঁচে থাকতে হলে এসব প্রতিকূলতাকে জয় করে অভিযোজিত হতে হয়েছে সেখানকার প্রাণীদের। এই অভিযোজন যেমন নির্ভর করে আলো, চাপ, তাপমাত্রার উপর ঠিক তেমনি তাদের শিকার করা, শিকারীর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া, বংশবৃদ্ধি কিংবা মিথোজীবিতার উপরও নির্ভর করে। তো এবার চলুন জেনে আসি তেমনি কিছু অভিযোজন নিয়ে।
বায়োলুমিনিসেন্স:
জীববিজ্ঞানী ইডিথ উইডার বলেন,
যদি তুমি সমুদ্রের তলদেশে যাও, হাতের কাছে থাকা আলোর উৎসগুলো বন্ধ করে দাও এবং তুমি আরো অনেক কিছুই দেখতে পাবে যা থেকে তুমি আরো অনেক কিছুই জানতে এবং গবেষনা করতে পারবে।
স্থলভূমিতে খুবই দূর্লভ হলে সমুদ্রের খুবই সাধারণ একটি বিষয় হলো এই বায়োলুমিনিসেন্স। গ্রামে সন্ধ্যা নামলেই দেখা মিলত ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি যাদের গায়ে মিটমিট করে জ্বলত আলো। এই আলোর উৎস মূলত জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া। অর্থাৎ জীবদেহে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে শীতল আলো (২০% কম আলো তাপ উৎপাদন করে) উৎপন্ন হলে সেটিকে বায়োলুমিনিসেন্স বলা হয়। ইডিথ উইডারের মতে সমুদ্রের ৯০% জীব নিজ দেহে আলো উৎপাদন করতে পারে, যাদের মধ্যে মাছের সংখ্যা ১৫০০ বা এর বেশি।
সাধারণত লুসিফারিন এবং তা থেকে উৎপন্ন এনজাইম লুসিফারেজ অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়ায় এই আলো সৃষ্টি করে। তবে বিভিন্ন প্রাণী যেমন পার্চমেন্ট ওর্ম লুসিফারিনের বদলে অ্যাকিয়োরিন (Aequorin) নামের অন্য একধরণের ফটোপ্রোটিন ব্যবহার করে।
বিজ্ঞানীদের মতে গভীর তলদেশের প্রাণীরা মোট ছয়টি কারণে এই বায়োলুমিনিসেন্স ব্যবহার করে।
১. দেখতে, বিশেষ করে শিকার খুঁজতে: যেমন ল্যান্টার্ন ফিশ তার শরীরে থাকা ফটোফোর ব্যবহার করে এসব কাজে।
২. বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্ট করতে: যেমন ক্রাস্টাশিয়ান গ্রুপের অস্ট্রাকডস পুরুষরা একধরণের উজ্জল তরল নির্গত করে নারী অস্ট্রাকডের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
৩. শিকারকে আকৃষ্ট করতে। বিশেষ করে ভয়ালদর্শী অ্যাঙ্গলার ফিশ তার মাথায় বসানো ইলিসিয়ামে থাকা কিছু বায়োলুমিনিসেন্ট ব্যাকটেরিয়ার আলো ব্যবহার করে শিকারকে কাছে টেনে আনে।
৪. কাউন্টারইল্যুমিনেশন: কিছু কিছু মেসোপেলাজিক (২০০-১০০০ মিটার গভীরতায় যেসব জীব বাস করে) প্রাণী, যেমন ফায়ারফ্লাই স্কুইড, তাদের শরীরের তলদেশে থাকা ফটোফোর ব্যবহার করে এমন উজ্জলতা এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো উৎপন্ন করতে পারে যা সেই গভীরতায় একেবারে অল্প যে আলো থাকে তার সাথে মিলে যায়। এরফলে যদি তাকে নিচ থেকে দেখা হয় তাহলে সে একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়। বিশেষ করে শিকারী প্রাণীদের চোখ এড়াতে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
৫. শিকার অথবা শিকারীকে দ্বিধায় ফেলতে: কিছু স্কুইড হঠাৎ আলো সৃষ্টি করে তার শিকারকে চমকে দিয়ে আক্রমণ করে।
৬. শিকারীকে অন্যের শিকারে পরিণত করতে: কিছু সি কিউকাম্বার এক ধরণের উজ্জ্বল মিউকাস তাকে যে প্রাণী শিকার করতে আসছে তার উপর ছুড়ে মারে। এতে করে তার চেয়ে বড় কোন শিকারী প্রাণী সেই আলো অনুসরণ করে তাকেই শিকার করতে আসে।
সমুদ্রে বায়োলুমিনিসেন্সে উৎপন্ন বেশিরভাগ আলোই হয় নীল নাহয় নীলাভ-সবুজ। এর কারণ এই দুই রঙএর আলো পানিতে বেশিদূর যেতে পারে। এরফলে বেশিভাগ প্রাণী লাল রঙ দেখার ক্ষমতা হারায়, কারণ সূর্যের সাত আলোর মধ্যে এই লাল রঙ সবার আগে পানিতে গভীরতার সাথে হারিয়ে যায়। কিন্তু খুবই অল্প কিছু প্রাণী, যেমন ড্রাগনফিশ অভিযোজিত হয়ে লাল রঙ উৎপন্ন এবং দেখতে পারে। ফলে তারা শিকারের সময় এই আলো ব্যবহার করে। অপরদিকে তার শিকার বুঝতেই পারেনা যে আলো ব্যবহার করে তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে!
এছাড়াও সম্পূর্ণ অন্ধকার বলে অনেক মাছের দৃষ্টিশক্তিই থাকে না। আবার অনেক মাঝের বিশাল চোখ দেখা যায় যাতে সে একেবারে কম আলোতেও দেখতে পায়।
পানির চাপ সহ্য করার ক্ষমতা:
সমুদ্রের গভীরতা ২০০-১১০০০ মিটারের মধ্যে হয়ে থাকে, যার অর্থ সেখানকার চাপও ভূপৃষ্ঠের তুলনায় ২০-১১০০ গুণ বেশি। আমাদের মত সরাসরি বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করা প্রাণীদের দেহের বেশ কিছু অংশ বাতাস দিয়ে পূর্ণ থাকে। যেমন: ফুসফুস, কান, নাসারন্ধ্র। সমুদ্রের গভীরে অনেক বেশি চাপে এই বাতাস সংকুচিত হয় এবং যেসকল অঙ্গ তাদের ঘীরে রাখে তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যেসকল প্রাণী সমুদ্রের গভীরে এবং পৃষ্ঠে নিয়মিত আসা-যাওয়া করে, যেমন স্পার্ম তিমি, তারা এই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে অভিযোজিত হয়েছে। তারা কান এবং নাকের রক্ত নালিকাগুলো এমনভাবে ফুলিয়ে ফেলে যাতে করে সব বাতাস বেরিয়ে যেতে পারে এবং সেখানে কোন ফাঁকাস্থান না থাকে। ফুসফুসকেও তারা একইভাবে সংকুচিত করতে পারে। তবে যেসকল প্রাণী প্রতিনিয়তই এই চাপ সহ্য করে সমুদ্রের তলদেশে বাস করছে, তারা তাদের শরীরে কোন ফাঁকা স্থান রাখে না।
যেসকল প্রাণীর শরীরে অল্প কিছু বাতাস থাকে, বিশেষ করে সুইম ব্লাডারে, মূলত তাদেরকেই সমুদ্র থেকে উপরে তুলে নিয়ে আসলে সেই ব্লাডারে থাকা বাতাস প্রসারিত হওয়ায় ফেটে সেই প্রাণীটি মারা যায়।
কম তাপমাত্রায় অভিযোজন:
চাপের সাথে কম তাপমাত্রা মিলে গভীরে বাস করা প্রাণীদের কোষ ঝিল্লির ফ্যাটকে শক্ত করে তুলতে পারে এবং তাদের বিপাকের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন ধ্বংস করে দিতে পারে। এই সমস্যা এড়াতে প্রাণীদের কোষ ঝিল্লি গঠিত হয় অনেক বেশি পরিমাণে অসম্পৃক্ত চর্বি (unsaturated fat) দিয়ে, (যা রান্নায় ব্যবহৃত তেলে পাওয়া যায়) যা অনেক কম তাপমাত্রাতেও তরল অবস্থায় থাকে। এছাড়াও কোষগুলো ছোট জৈব পদার্থ পিজোলাইট (Piezolytes) সংগ্রহ করে যা প্রোটিনগুলোকে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করে। মজার ব্যাপার হলো, এক প্রকারের পিজোলাইট যাকে বলা হয় TMAO (trimethylamine oxide), এটিই মাছের গায়ে যে গন্ধ পাওয়া যায় তার কারণ। অর্থাৎ গভীর সমুদ্রের মাছে অনেক বেশি TMAO আছে, যার অর্থ সে মাছগুলোর গন্ধ সাধারণ অগভীরে পাওয়া মাছের চেয়ে বেশি।
তবে এখানে আরেকটি বিষয় না বললেই না, যেটি হলো পিজোলাইট কোষের ভেতরের অংশকে লবণাক্ত করে তোলে। তাই এর পরিমাণ বেশি হলে মাছের দেহে লবণের ঘনত্ব এর বাইরে পানির চাইতে বেশি হয়। যার অর্থ তখন কোষ বাইরের সাথে ভেতরের সাম্যাবস্থায় আসতে চাইবে এবং কোষ ফেটে যাবে। এই জন্য সমুদ্রের একটি নির্দিষ্ট গভীরতা পর্যন্ত আমরা মাছের দেখা পাই। যা প্রায় ৮.২ কিলোমিটার।
খাবার:
যেহেতু কোন সূর্যের আলো নেই, তাই সেখানে কোন সালোকসংশ্লেষণও নেই। যার অর্থ গভীর সমুদ্রের প্রাণিগুলো হয় মাংসাশী নতুবা মৃতভোজী। আর তাদের বেশ পরিচিত খাবার, যেটাকে বেশ আদর করেই বলা হয় ‘মেরিন স্নো’। এই মেরিন স্নো মূলত উপরিভাগে যেসব প্রাণী মারা যায় তাদের দেহাবশেষ। ছোট প্রাণীর দেহাবশেষ মূলত তলদেশে পৌছানোর আগেই বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের কারণে তেমন কিছু অবশিষ্ট থাকে না। সে কারণে যাতে এই মেরিন স্নো যতটা সম্ভব বেশি গ্রহণ করতে পারে, প্রাণীরা হয় অভিযোজিত হয়ে নিজের আকার বাড়িয়ে ফেলেছে নতুবা খাদ্য ধরার জন্য তাদের টেনড্রিলগুলো বড় করে ফেলেছে।
তবে আস্ত তিমির মত বিশাল প্রাণীর মৃতদেহ পড়লেতো কথাই নেই। প্রাণীদের মধ্যে বিশাল এক উৎসব শুরু হয় তখন। হ্যাগফিশ, স্লিপার শার্ক কয়েক মাইল দূর থেকে চলে আসে উৎসবে যোগ দিতে।
আরো পড়ুনঃ
ভিয়েতনাম যুদ্ধঃ মার্কিন বাহিনীর পরাজয়ের করুণ ইতিহাস (পর্ব ১)
ভিয়েতনাম যুদ্ধঃ মার্কিন বাহিনীর পরাজয়ের করুণ ইতিহাস (পর্ব ২)
অর্থ সম্পর্কে যে ১২ টি বিষয় খেয়াল রাখা উচিৎ
ইন্টারভিউ প্রশ্নঃ “আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি কি”
কিভাবে চাকরির ইন্টারভিউতে নিজেকে উপস্থাপন করবেন
তবে যেসব প্রাণী মৃতদেহে আকৃষ্ট নয়, তারা শিকারকেই বেছে নেয় খাদ্যের উৎস হিসেবে। যার কারণে তাদেরকেও অভিযোজিত হতে হয়েছে। বেশিরভাগ শিকারীর দানবের মত বিশাল দাঁত নিশ্চিত করে শিকার যাতে কোনভাবেই হাতছাড়া না হয়। অনেকে যেমন অ্যাঙ্গলার ফিশ, তাদের দেহ থেকেও বড় শিকার ধরে ফেলতে পারে। এই জন্য তাদের চোয়াল এবং পাকস্থলীর প্রসারণ ক্ষমতাও থাকে অতুলনীয়।
হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট:
সমুদ্রের যেসকল স্থানে আগ্নীয়গিরি রয়েছে, সেখানেই দেখা পাওয়া যায় এসকল হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট্গুলোর। এই ভেন্টগুলো পৃথিবীর তলদেশ থেকে তাপ এবং ‘ব্ল্যাক স্মোকারস’ নামে অজস্র মিনারেল সমুদ্রে নিয়ে আসে। আগে ধারণা ছিল সকল জীবই কোন না কোনভাবে কেবল সূর্যের আলোর উপর নির্ভরশীল। কিন্তু হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের আবিষ্কার এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে। এখানে যে বাস্তুসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে আছে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ শক্তি (Geothermal energy)। অনেক বিজ্ঞানীরা এটা বিশ্বাস করেন পৃথিবীতে প্রাণের প্রথম সঞ্চার হয়েছিল এই হাইড্রোথার্মাল ভেন্টেই তিন বিলিয়ন বছর আগে।
এই ভেন্টগুলো সালফার সম্বৃদ্ধ মিনারেল সমুদ্রে নির্গত করে যা থেকে কিছু ব্যাকটেরিয়া কেমোসিন্থেসিস প্রকিয়ায় রাসায়নিক শক্তিকে ব্যবহার করে, যেভাবে ফাইটোসিন্থেসিস প্রকিয়ায় উদ্ভিদ সূর্যের আলোর শক্তি ব্যবহার করে। এই ব্যাকটেরিয়াগুলোর কারণেই সেখানে নতুন আরেকটি খাদ্যশৃংখল সৃষ্টি হয় যাতে থাকে টিউবওর্মের মত অদ্ভুতসকল প্রাণী।
গায়ের রঙ:
মূলত চারপাশের পরিবেশের মাঝে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে এবং শিকারীর হাত থেকে রক্ষা পেতে বেশ কিছু প্রাণী হয় ট্রান্সপারেন্ট (জেলিফিশ এবং কিছু প্রজাতির স্কুইড), কালো (ব্ল্যাকসমেল্ট শিপ), অথবা লাল (বেশ কয়েক প্রজাতির চিংড়ি) রঙের হয়ে থাকে।
বংশবৃদ্ধি:
আগেই আমরা বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্ট করতে আলোর ব্যবহার দেখেছি। তবে কিছু প্রাণী ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। যেমন নারী অ্যাঙ্গলার ফিশের তুলনায় পুরুষ অনেক ছোট হয়ে থাকে। যার ফলে পুরুষ অ্যাঙ্গলার ফিশ অনেকটা পরজীবির মতই তার সঙ্গির গায়ে দাঁত ব্যবহার করে আটকে থাকে। এতে করে পুরুষটি নারী অ্যাঙ্গলার ফিশ থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে।
বিশালাকৃতি অথবা ক্ষুদ্রাকৃতি দেহ:
অনেক প্রাণী আছে যাদের আমরা সমুদ্রের পৃষ্ঠের চাইতে তলদেশে বেশ ক্ষুদ্র অবস্থায় দেখতে পাই। ধারণা করা হয়ে খাদ্যের অপ্রতুলতার জন্যেই তারা ছোট হয়ে যায়। ছোট দেহে কম শক্তি প্রয়োজন তাই কম খাবারেই সেটা পূরণ হয়ে যায়। তবে আবার কিছু প্রাণী দানবাকার রূপ ধারণ করে। যেমন গারগেনচুয়ান স্কুইড ১৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এছাড়াও আছে বিশাল জাপানিক স্পাইডার ক্রাব। তবে এর কারণটা এখনও পুরোপুরি জানা সম্ভব হয়নি। যেখানে হাইড্রোথার্মাল ভেন্টে থাকা বিশাল টিউবওর্ম সেখানকার প্রচুর পুষ্টি পেয়ে দাবনাকার ধারণ করে, অপরদিকে খাদ্য এত কম থাকার পরেও কিভাবে এত বিশাল আকার ধারণ করে। এর একটা কারণ ধরা হয় অক্সিজেন লেভেল বেশি থাকা যা তাদের বাড়তে সাহায্য করে আরেকটি কারণ হতে পারে অনেক বছর বেঁচে থাকার ক্ষমতা।
বহুবর্ষজীবিতা:
ছোট হোক বা দানব, সমুদ্রের তলদেশের অনেক প্রাণী কয়েকদশক থেকে শতাব্দী পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। অনেকে মনে করেন সমুদ্রের তলদেশের কম তাপমাত্রাই এর কারণ।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, এক সময় বসবাসের অনুপযুক্ত ভাবা সমুদ্রের তলদেশে আজ বিচিত্র প্রাণের সম্ভার। জীবনকে থামাতে পারেনি এই প্রতিকূল পরিবেশও। তেমনি সেটা মানুষকেও থামাতে পারবেনা। আশা করা যায়, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে সমুদ্রের অজানা সব রহস্যের উন্মোচন একদিন হবেই।
This is a Bangla article about deep sea creatures and their adaptation.
All necessary links are hyperlinked.