আমরা অনেকেই ‘মারিয়ানা ট্রেঞ্চ’ এর নাম শুনেছি। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ হলো পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম সমুদ্রখাত। আমরা কি জানি যে আমাদের দেশেও মানে আমাদের বঙ্গোপসাগরেও একটি গভীরতম সমুদ্রখাত রয়েছে। হ্যাঁ, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের কথাই বলছি। আজকে আমরা জানব সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড সম্পর্কে।
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড, বঙ্গোপসাগরের অজানা রহস্য |
অনেকেই হয়ত ভাবছেন সমুদ্রখাত আবার কি? সমুদ্রখাত হচ্ছে গভীর সমুদ্রের নিচে গিরিখাত। টিভিতে কিংবা মুভিতে আমরা বিভিন্ন সময় ভূপৃষ্ঠের উপরের গিরিখাত দেখেছি। দুইটি পাহাড়ের মাঁঝখান দিয়ে গভীরতম নদী বয়ে চলেছে কিংবা অনেক সময় খাড়া ঢাল বিশিষ্ট গভীর ফাটলের মত যা সমান্তরালভাবে বয়ে গেছে। সরুভাবে বয়ে চলা এই খাদকেই গিরিখাত বলে। ঠিক তেমনি সমুদ্রের তলদেশেও গিরিখাত রয়েছে। আর সমুদ্রের তলদেশের এই গিরিখাতকে বলা হয় সমুদ্রখাত।
সুন্দরবনের শেষ প্রান্ত দুবলার চর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ এর অবস্থান। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড বঙ্গোপসাগরের সর্বোচ্চ গভীরতম খাদ। বর্তমানে এটি একটি সংরক্ষিত এলাকা। চলুন যেনে নেওয়া যাক বঙ্গোপসাগরের রহস্যময় গিরিখাত সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড সম্পর্কে।
সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড পৃথিবীর ১১তম গভীর খাদ। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড সর্বোচ্চ গভীরতা ১৩৪০ মিটার। এই গভীরতম খাদের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪ কিলোমিটার। এখানকার ডুবো গিরিখাত বঙ্গ পাখার অংশ, যা বিশ্বের বৃহত্তম ডুবো গিরিখাত হিসেবে পরিচিত।
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত। এজন্য অনেকেই এ খাদকে ‘গঙ্গা খাদ’ বলে থাকে। বঙ্গোপসাগরের এ অংশের পানি তুলনামূলক বেশি নীল রঙের। এখানে আকাশে রয়েছে সামুদ্রিক পাখির মেলা আর পানিতে তিমি ও ডলফিনের রাজত্ব। স্রষ্টা যেন সামুদ্রিক সৌন্দর্যের সবটাই ঢেলে দিয়েছে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে। সমুদ্র ভ্রমনের জন্য এ জায়গাটি অসাধারণ।
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড বর্তমান একটি মেরিন সংরক্ষিত এলাকা। ২০১৪ সালের ১৭ অক্টোবর এই অঞ্চলটিকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার।। সংরক্ষিত এই এলাকার আয়তন ১,৭৩,৮০০ হেক্টর। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এটি সামুদ্রিক প্রাণীর অভয়াশ্রম।
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড প্রায় ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার প্রস্থ। এর তলদেশ প্রায় সমতল এবং পার্শ্ব দেওয়াল প্রায় ১২ ডিগ্রী হেলানো। মহীসোপানের পাশে খাদের গভীরতা প্রায় ১২০০ মিটার। ধারণা করা হয় সাগরের নিচে কান্দা এবং ব-দ্বীপ উপত্যকার আকারে সাগর অভিমুখে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার সম্প্রসারিত হয়ে আছে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড অবক্ষেপপূর্ণ ঘোলাটে পলি এনে বেঙ্গল ফ্যানে ফেলছে। বঙ্গীয় ডিপ সি ফ্যানের অধিকাংশ পলি ব্রহ্মপুত্র গঙ্গা সংযোগস্থলে উৎপত্তি হয়েছে। বর্তমানে অল্প পরিমাণ ঘোলাটে স্রোত আর বালি সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে পলি পরিবহন পদ্ধতি কে নিয়ন্ত্রণ করে।
উৎপত্তি
রহস্যময় সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড |
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এর উৎপত্তি সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, প্লাইসটোসিন যুগে (২৪ লক্ষ বছর পূর্বে) সমুদ্রের তলদেশে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীর পলির স্তুপ সরাসরি মহীসোপান প্রান্তে নির্গত হয়েছে। মহীসোপান প্রান্তে উর্ধ্ব ঢালে উৎপন্ন ঘোলাটে স্রোত ও নদীপ্রবাহের সম্মিলিত প্রভাবে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড গঠিত হয়। বঙ্গীয় ডিপ সির প্রক্রিয়া থেকেও এটাই প্রমাণিত হয়।
গবেষকরা মনে করেন, প্রাচীন যুগে সমুদ্রপৃষ্ঠ যখন নিচু ছিল তখন বঙ্গীয় ডিপ সি এর ঘোলাটে স্রোতের প্রভাবে অবক্ষেপণ সংঘটিত হতো, আর সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড থেকে সৃষ্ট আন্তঃমহাদেশীয় খাল থেকে এই উপ-বদ্বীপটিতে পলি বন্টিত হত।
নামকরণ
‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ বা ‘অতলস্পর্শী’ নামটি দিয়েছিল ব্রিটিশরা। এ সম্পর্কিত একটি চমৎকার ঘটনা রয়েছে। ১৮৬৩ সালে উপমহাদেশ থেকে বিপুল পরিমান ধনরত্ন বোঝাই করে গ্যাটফ্লাই নামক একটি ব্রিটিশ জাহাজ ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে ঝড়ের কবলে পড়ে জাহাজটি। প্রচন্ড ঝড় ও গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের ত্রিমহনায় জলের ঘূর্ণিপাকের পড়ে ২১২ টন ওজন বিশিষ্ট এই জাহাজটি ডুবে যায়।
এই গানবোটটিকে উদ্ধার করার জন্য ব্রিটিশদের একাধিক জাহাজ উদ্ধার তৎপরতা চালায়। কিন্তু তারা ডুবে যাওয়া জাহাজটি খুজে পাচ্ছিল না। তাছাড়া সমুদ্র তলেরও কূলকিনারা করতে পারছিল না। বিশেষ করে মহীসোপানের এত নিকটে এত বড় গভীরতা তারা ভাবতেও পারেনি। শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়ে জায়গাটির নাম দিয়েছিল ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ বা ‘যার কোন তল নেই’।
এছাড়া জেলেরা বাঁশ এর সাহায্যে সমুদ্রের গভীরতা পর্যবেক্ষণের একটি পদ্ধতিকে ‘বাম’ বলে থাকে। এই অঞ্চলে গভীরতার কোন হিসাব না পেয়ে তারা এই জায়গাটার নাম দিয়েছে ‘না বাম’। জেলেদের কাছে এই জায়গাটি ‘না বাম’ নামেই পরিচিত।
জীববৈচিত্র্য
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে ডলফিনের ঝাঁক |
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক অভয়ারণ্য। এটি ডলফিন, পরপাস তিমি ও হাঙ্গরের প্রজননক্ষেত্র। এটাই একমাত্র সোয়াচ যেখানে এই তিন প্রকারের সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী একসঙ্গে দেখা যায়। ২০১৭ সালে ‘ইসাবেলা ফাউন্ডেশন’ নামে একটি গবেষণা সংস্থা এখানে জরিপ চালায়।
গবেষণায় এখানে হ্যামারহেড শার্ক এবং চার প্রজাতির ডলফিন এর অস্তিত্ব পেয়েছে। ১৯১৪ সালের ২৭ অক্টোবর এই অঞ্চলে প্রথমে জরিপ চালানো হয়। প্রাথমিকভাবে হাঙ্গর, তিমি এবং ডলফিন দেখে জরিপ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এখানকার জীববৈচিত্রের আসল রহস্য বের হয়ে আসে। জীববৈচিত্র্যের জন্য এখানকার পানির মান শ্রীলঙ্কা, ভারত, মিয়ানমার এবং মালদ্বীপ এর চেয়ে উন্নত।
এখানে এমন কিছু জলজপ্রাণী রয়েছে যা বিশ্বে বিলুপ্তপ্রায়। এসব সামুদ্রিক প্রাণীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পরপাস ডলফিন, পৃথিবীর বৃহত্তম প্রজাতির ইরাবতী ডলফিন, গোলাপি কুঁজোপিঠের ইন্দো-প্যাসিফিক ডলফিন, মসৃণ পিঠের পাখনাবিহীন ইমপ্লাইস ডলফিন।
বঙ্গোপসাগরে ব্লু ইকনোমি হিসেবে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাঙ্গর, তিমি এবং ডলফিন ছাড়াও নাম না জানা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এবং বিভিন্ন জলজ প্রাণী অস্তিত্ব রয়েছে এখানে। এছাড়া ঝিনুক, শামুক কচ্ছপ, সাপ, সি উইডস ইত্যাদির অস্তিত্ব শনাক্ত করা হয়েছে।
তিমির মধ্যে এখানে রয়েছে ব্রীড তিমি ও মিল্কি তিমি। এছাড়া সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের আকাশে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখা যায় । সি-গাল পাখির অবস্থান আপনাকে জানিয়ে দেবে তিমি বা ডলফিন এর অস্তিত্ব। কারণ সি-গাল ডলফিন ও তিমিকে কেন্দ্র করে আকাশে উড়তে থাকে।
ব্লু ইকোনমিতে গুরুত্ব
বাংলাদেশের মৎস্য ভান্ডার হিসেবে বিখ্যাত সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। প্রায় দেড় হাজার বর্গমাইলের বিস্তীর্ণ এ অঞ্চলটি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, বিলুপ্ত সামুদ্রিক প্রাণীর নিরাপদ প্রজনন কেন্দ্র। প্রস্তাবিত ব্লু ইকোনমি হিসেবে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরেজমিনে গবেষণা চালিয়ে এমনটাই জানাচ্ছেন গবেষকরা।
প্রায়শই এখানে বড় বড় ডলফিন এবং তিমি মাছের ঝাঁক দেখা যায়। ডলফিন, তিমি এবং হাঙ্গেরের অভয়াশ্রম এবং নিরাপদ প্রজননকেন্দ্র হিসেবে অনেক আগে থেকেই বিখ্যাত এ অঞ্চলটি। ২০১৭ সালে সরকারের সব সংস্থার সহায়তায় ব্যাপকভাবে অনুসন্ধান চালায় ইসাবেলা ফাউন্ডেশন। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডকে কিভাবে সংরক্ষণ করা যায় এবং ব্লু ইকনোমিতে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেটা নিয়ে কাজ করছে সংস্থাটি।
সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের এর জীববৈচিত্র দেখে অবাক হয়েছেন অনেক বিশ্লেষক। এই অঞ্চলের সাগরতলে পানির রং পরিবর্তিত হয়ে নীল আকার ধারণ করেছে। সচরাচর সমূদ্রের তলদেশে এত সচ্ছ পানি দেখা যায় না। সীমিত পরিমাণে জাহাজ চলাচল করায় এবং বিস্তৃতভাবে মৎস্য আহরণ না করায় বঙ্গোপসাগরের এ অঞ্চলটি অনাবিষ্কৃত ইকোসিস্টেম হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশের বিজিত সমদ্র অঞ্চলের পরিমান প্রায় ১ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের চেয়েও বেশি। আর এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। এক কথায় সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড হলো বঙ্গোপসাগরের প্রাণ। হোক সেটা জীববৈচিত্রের জন্য কিংবা অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক দিয়ে।
This is a Bengali article. It’s about a swatch of no-ground in the bay of Bengal
All The Reference Are Hyperlinked Within Article.
Featured Image: Getty Image