মহাজগতে সম্ভবত আলোই সবচেয়ে গতিশীল। তবে এর প্রকৃত গতি নিয়ে বিজ্ঞানীদের রয়েছে মতভেদ। শতকে পর শতক ধরে আলো নিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিভিন্ন মতবাদ দিয়েছেন। সর্বশেষ আমরা যে আলোর গতিটা জানি সেই মতবাদটা দিয়েছেন বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। আজকে আমরা জানব আলাের গতির বিস্তারিত।
আমরা সবাই জানি যে, আলাে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে চলে। সেকেন্ডে অতিক্রম করে ১৮৬,২৮২ মাইল। আলাের গতিকে ‘c’ দ্বারা প্রকাশ করা হয়। c এসেছে ল্যাটিন শব্দ celeritas থেকে। অর্থ দ্রুততা বা দ্রুতি। এক সময় ‘v’ দ্বারাও প্রকাশ করা হত যা ম্যাক্সওয়েল পরিচিত করিয়েছিলেন ১৮৬৫ সালে।
১৮৯৪ সালে পল ডুড ‘c’ পুনরায় ব্যবহার করেন। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন তার বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে প্রথমে ‘v ব্যবহার করলেও পরে ১৯০৭ সালে তা ‘c’ তে পরিবর্তন করেন। এর মাধ্যমে ‘c’ আধুনিক বিজ্ঞানে আলাের গতির অর্থবহ প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে।
আলোর গতি নিয়ে গবেষণা বহু দিনের। প্রাচীন গ্রিকদের থেকে শুরু করে মুসলিম বিজ্ঞানীদের যুগ পর্যন্ত আলাের বেগ নিয়ে চলেছে বিতর্ক।
সতের’শ শতক পর্যন্ত আলাের সসীম গতি বা তাৎক্ষণিকভাবে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে পারার বিষয়টা বিজ্ঞানীদের কাছে পরিষ্কার ছিল না। ১৬৬৭ সালে ইতালীয় জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও আলাের গতির ওপর পরীক্ষা চালান। কিন্তু সঠিক বেগ পরিমাপ করতে ব্যর্থ হন। তিনি শুধু এতটুকু বলেন যে, আলাে শব্দের থেকে ১০ গুণ জোরে ছুটে।
এরপর ১৬৭০ সালে ড্যানিশ জ্যোতির্বিদ ওলে রােমা বৃহস্পতি ও তাঁর উপগ্রহের মধ্যে আলাের গমনের উপর পরীক্ষা চালান। দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করে তিনি দেখেন, সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলাে আসতে কিছু সময় লাগে। তিনি হিসেব করে দেখেন, সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলাে আসতে ১০ থেকে ১১ মিনিট সময় লাগে। তাঁর হিসাব অনুযায়ী আলাের বেগ সেকেন্ডে ১২৫,০০০ মাইল হয়। আলাের গতি সংক্রান্ত গবেষণার ইতিহাসে এটা ছিল একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার।
১৭২৮ সালে ইংরেজ পদার্থবিদ জেমস ব্র্যাডলি পৃথিবীর ঘূর্ণনের ওপর ভিত্তি করে এই হিসাব পরিবর্তন করে নতুন হিসাব প্রদান করেন। তিনি আলাের গতি নির্ধারণ করেন সেকেন্ডে ১,৮৫,০০০ মাইল, যা কিনা প্রায় ৯৮% সঠিক। গতি নিয়ে আরেক দফা বিতর্ক শুরু হয় ১৮ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে। ফরাসি পদার্থবিদ হিপােলয়েট ‘ঘূর্ণায়মান চাকা’ এবং একই সময়ে আরেক ফরাসি পদার্থবিদ লিয়ন ফউকাল্ট ‘ঘূর্ণায়মান আয়না’ পরীক্ষার মাধ্যমে হিসেব করে বের করেন যে আলাের গতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০০ মাইল!
অ্যালবার্ট মাইকেলসন, একজন প্রুশিয়ান বংশােদ্ভূত অ্যামেরিকান পদার্থবিদ। তিনি ১৮৭৯ সালে ফউকাল্টের পরীক্ষাটি আবার করেন আরাে বেশি দূরত্ব এবং আরাে ভালাে মানের আয়না দিয়ে। তাতে তিনি অবিশ্বাস্য ফলাফল পান। আলাের গতি পর্যবেক্ষকের গতির ওপর নির্ভরশীল নয়। তিনি আলাের গতির হিসেব বের করেন সেকেন্ডে ১৮৬,৩৫৫ মাইল! এবং এটাকেই আলাের গতি গবেষণার ওই চল্লিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে সঠিক ধরা হয়।
১৮৬৫ সালে বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল আলােকে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ হিসেবে প্রস্তাব করেন এবং আরাে বলেন যে আলাের গতি তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্ব অনুসরণ করে। ১৮৮৭ সালে। মাইকেলসন-মর্লি পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে জানা যায়, আলাের গতি পর্যেবেক্ষকের গতির ওপর নির্ভরশীল নয়। নির্দিষ্ট মাধ্যমে যে কোনাে
পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে আলাে সব সময় ধ্রুব বেগে চলবে। যার মান শূন্য মাধ্যমে সেকেন্ডে ১,৮৬,২৮২ মাইল বা ৩০ কোটি মিটার।
আলোকবর্ষ কি?
আমরা সায়েন্স ফিকশনে অনেক বেশি আলােকবর্ষ নিয়ে কথা শুনি। আসলে আলােকবর্ষ কী? মূলত, আলাে এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে এক আলােকবর্ষ (Light year)
বলা হয়।
শুনতে সময়ের মনে হলেও এটি আসলে দূরত্বের একক। বিষয়টা কিন্তু সহজ। এর মানে হলাে, আলাে এক সেকেন্ডে যে দূরত্ব অতিক্রম করে। যেমন, আমাদের সবচেয়ে কাছের তারা ‘আলফা সেন্টোরি’ থেকে আলাে আসতে প্রায় ৪.৩ বছর লাগে অর্থাৎ আলফা সেন্টোরি’ ৪.৩ আলােকবর্ষ দূরে অবস্থিত। অর্থাৎ কেউ যদি আলাের গতি অর্জন করতে পারে তথা সেকেন্ডে ১,৮৬,২৮২ মাইল অতিক্রম করতে পারে তাহলে ‘আলফা সেন্টোরি’তে পৌছাতে তাঁর ৪.৩ বছর সময় লাগবে। বছরের বদলে সেকেন্ড বা মিনিট দিয়েও হিসাব করা যায়।
যদি চাঁদ থেকে আলাে আমাদের চোখে আসতে ১ সেকেন্ড লাগে তাহলে বলা যায় চাঁদ আমাদের থেকে ১ আলােক সেকেন্ড দূরত্বে। আবার, সূর্য থেকে আলাে আসতে ৮ মিনিট লাগে অর্থাৎ আমরা সূর্য থেকে ৮ আলােক মিনিট দূরত্বে আছি। আমাদের সৌরজগতের বাইরে যত নক্ষত্র আর
বস্তু রয়েছে তা আমাদের থেকে কয়েক আলােকবর্ষ থেকে শুরু করে লক্ষ লক্ষ আলােকবর্ষ দূরে!
তাই জ্যোতির্বিদরা যখন ওইসব দূরের নক্ষত্র থেকে আসা আলাে নিয়ে গবেষণা করেন তখন যেই আলাে তারা দেখতে পান তা ওই তাৎক্ষণিক সময়ে ওই নক্ষত্র থেকে আসা কোনাে আলাে নয়। তা অনেক অনেক বছর আগে বিচ্ছুরিত কোনাে আলাে। আমরা যখন কোনাে নক্ষত্রের আলাে দেখি হতেও পারে যে ওই সময়ে ওই নক্ষত্র আর আলােই দিচ্ছে না। আমরা অনেক আগে দেয়া আলােই দেখছি! অর্থাৎ যদি কোনাে নক্ষত্র আমাদের থেকে ১০ লক্ষ আলােকবর্ষ দূরে থাকে তাহলে আমরা তার যে আলাে দেখতে পাই তা মূলত ওই নক্ষত্র হতে ১০ লক্ষ বছর আগে বিচ্ছুরিত আলাে!
আলাে তরঙ্গ আকারে চলে যেমন চলে শব্দ। অবশ্য শব্দ তরঙ্গের ধরনটা একটু আলাদা। গতিপথের মাধ্যমের ওপর ভিত্তি করে আলাের বেগ কম বেশি হতে পারে। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে ভারী পদার্থের পাশ দিয়ে আলাে যাবার সময় পদার্থটির মহাকর্ষ বলের প্রভাবে পড়ে যায় আলােসহ অন্য ভর বাহী সত্তা (যেমন গ্রহ,নক্ষত্র, ধূমকেতু, উল্কা ইত্যাদি)। এই বক্রতাকে বলে “গ্র্যাভিট্যাশানাল লেন্সিং বা মহাকর্ষীয় বক্রতা।
দূর নক্ষত্র থেকে আসা আলাে স্থান-কালের বক্রতা অনুসরণ করে চলে, তাই গ্র্যাভিট্যাশনাল লেন্সিং এর জন্যে আমরা নক্ষত্রটাকে আসল জায়গার বদলে অন্য জায়গায় দেখবাে। এটা খুবই দারুণ ব্যাপার। অন্য কোনাে লেখায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করা যাবে।
আরো পড়ুনঃ
দূরত্ব মাপতে আলােকবর্ষ কেন প্রয়োজন হলো?
এখন আমরা এই আলাের গতি নিয়ে কিছু মজাদার তথ্য জেনে নেইঃ
- চাঁদ থেকে পৃথিবীতে আলাে আসতে সময় লাগে ১.৩ সেকেন্ড।
- পৃথিবী থেকে বুধ গ্রহে আলাের গতিতে যেতে সময় লাগবে ৫ মিনিট, শুক্রের বেলায় ২.৫ মিনিট, মঙ্গলে ৪ মিনিট, বৃহস্পতিতে ৩৫ মিনিট, শনিতে ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট, ইউরেনাসে ২.৫ ঘণ্টা আর সবচেয়ে দূরের গ্রহ নেপচুনের বেলায় ৪ ঘণ্টা।
- সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলাে আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড। সূর্যের পরে পৃথিবীর নিকটতম নক্ষত্র আলফা সেন্টোরি থেকে পৃথিবীতে আলাে আসতে সময় লাগে ৪.২৫ বছর।
- আলাের গতিতে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে যেতে লাগবে ৩৮ হাজার বছর এবং অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে যেতে লাগবে ২২ লাখ বছর।
- একটা গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে আলাের সময় লাগবে সাধারণত ১ লাখ বছর। একটি মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে আলাের সময় লাগে ১০ হাজার কোটি বছর।
- ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মহাকাশে ভয়েজার-১ মহাকাশযান পাঠানাে হয়। বর্তমানে সৌরজগতের সবচেয়ে দূরবর্তী স্থানে রয়েছে এই মহাকাশযান। সেখান থেকে ছুটে আসা আলাের পৃথিবীতে পৌঁছতে সময় লাগবে ১৫.৫ ঘন্টা।
- শূন্যে আলাের গতি প্রতি সেকেন্ডে ১,৮৬,২৮২.৪ মাইল। ডায়মন্ডে আলাের গতি প্রতি
সেকেন্ডে ৭৭,৫০০ মাইল।
কিছুদিন আগে আবার এক অদ্ভূত ঘটনা ঘটেছে। স্কটল্যান্ডের একদল বিজ্ঞানী দাবি করছেন আলোর গতি কমানো সম্ভব হয়েছে। তাঁরা আলোর চলার পথে একটি বিশেষ আবরণের মাধ্যমে ফোটন সরবরাহ করেন। এতে ফোটনগুলোর আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং আলো নিজস্ব গতির চেয়ে কম গতিতে চলাচল করে। মুক্ত স্থানে ফিরে যাওয়ার পরও এসব ফোটনের তুলনামূলক ধীরগতি অব্যাহত থাকে।
This is a Bengali article. This article about speed of light.
Necessary references are hyperlinked inside the article.
Featured Image: Getty Image