প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে
মাইক্রোপ্রসেসর ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়া
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৮৪ সালের দিকে ইন্টেলের মার্কেট শেয়ার নাটকীয়ভাবে কমে আসে। এর কারণ ছিলো বিদেশী সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানির বাজারে আগমন। তবে এর ধাক্কা তেমন একটা লাগে নি ইন্টেলের গায়ে। কারণ এসময় নাগাদ তারা তাদের ব্যবসার ফোকাস মেমোরি চিপ থেকে মাইক্রোপ্রসেসরের দিকে সরিয়ে নেয়। আর কোম্পানি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এটি ছিলো সঠিক সিদ্ধান্ত।
ইন্টেলের উৎপাদিত এতসব মাইক্রোপ্রসেসরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো সম্ভবত ৮০৩৮৬। ৩২-বিটের এই চিপটি কোম্পানি বাজারে ছাড়ে ১৯৮৫ সালে। এই চিপ নির্মাণের সময় ইন্টেল এমন একটি সিদ্ধান্ত নেয় যেটি তাদের বর্তমান দৈত্যাকার আকৃতির পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
এসময় তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তটি ছিলো ইন্টেল এখন থেকে তাদের চিপগুলো এমনভাবে বানাবে যেন কেউ নতুন সিপিইউ নিলে সেগুলোতেও আগের চিপগুলো ব্যবহার করা যায়। এর ফলে অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপার এবং পার্সোনাল কম্পিউটার মালিকরা নিশ্চিন্ত হন। কারণ এর ফলে তারা আগের মডেলের ইন্টেল মেশিনের সফটওয়্যার পরের মডেলের মেশিনে ব্যবহার করতে সমর্থ হন।
পেন্টিয়াম মাইক্রোপ্রসেসর
কোম্পানি পেন্টিয়ামমাইক্রোপ্রসেসর বাজারে নিয়ে আসে ১৯৯৩ সালে। এবছর তারা তাদের মাইক্রোপ্রসেসরগুলোর নামকরণের ক্ষেত্রে সংখ্যা সংক্রান্ত নামের ঐতিহ্য বাদ দিয়ে ট্রেডমার্ক করা নাম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। পেন্টিয়াম ছিলো পিসির জন্য নির্মিত প্রথম ইন্টেল চিপ যাতে প্যারালাল বা সুপারস্কালার প্রসেসিং ব্যবহৃত হয়। এই প্রসেসিং পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে ইন্টেল চিপগুলোর প্রসেসিং হার বাড়ে ব্যাপক হারে। পেন্টিয়ামে ৩.১ মিলিয়ন সংখ্যক ট্রানজিস্টর ছিলো যেখানে এর পূর্বসূরি ৮০৪৮৬ তে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা ছিলো ১.২ মিলিয়ন। মাইক্রোসফটের 3.x অপারেটিং সিস্টেম এবং দ্রুতগতির পেন্টিয়াম চিপ মিলে পিসি মার্কেটের ব্যাপক হারে সম্প্রসারণ ঘটায়৷ যদিও ব্যবসা সংক্রান্ত কাজের জন্য এমনিতেই পিসি বিক্রিত হচ্ছিলো, তথাপি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পেন্টিয়াম মেশিনগুলো সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে পিসির প্রচলনের পথ খুলে দেয়। কেননা এগুলোতে গেমসের মত অধিক প্রসেসিং পাওয়ার লাগে এমন মাল্টিমিডিয়া গ্রফিক্যাল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের সুযোগ ছিলো।
ইন্টেলের বিজনেস স্ট্র্যাটেজি ছিলো তাদের গত ভার্সনের চিপের চেয়ে নতুন ভার্সনের চিপের প্রসেসিং পাওয়ার যতটা পারা যায় বাড়ানো। এভাবে তারা পিসির মালিকদেরকে নিজেদের পিসি আপগ্রেড করতে উৎসাহিত করতো। এবং চিপের প্রসেসিং পাওয়ার বাড়ানোর একটা পদ্ধতি হলো আরো বেশি ট্রানজিস্টরসমৃদ্ধ চিপ তৈরী করা। আর এই পদ্ধতিরই ব্যবহার করে ইন্টেল। উদাহরণস্বরুপ বলা যায় আইবিএমের প্রথম পিসিতে ব্যবহৃত ৮০৮৮ মডেলের চিপের কথা। এটিতে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা ছিলো ২৯,০০০। অন্যদিকে এর ৪ বছর পরের মডেল ৮০৩৮৬ এ ট্রানজিস্টর ছিলো ২,৭৫,০০০টি। ২০০৮ সালে বাজারে আসা মডেল কোর টু কোয়াডের ট্রানজিস্টর সংখ্যা ছিলো ৮০০০০০০০০ এবং ২০১২ সালের ইটানিয়াম ৯৫০০ মডেলে ট্রানজিস্টর ছিলো ৩১০০০০০০০০টি। এই যে চিপে ট্রানজিস্টের সংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি, এটি পরিচিত হয় মুর’স লনামে। এই নিয়মের নামকরণ করা হয় কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুরের নামে। ১৯৬৫ সালে তিনি সিলিকন চিপে বছরান্তে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা দ্বিগুণ করার ব্যাপারে মত দেন। ১৯৭৫ সালে তিনি আবার প্রতি ২ বছরে চিপের ট্রানজিস্টর সংখ্যা দ্বিগুণ করার কথা বলেন।
বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ
গ্রাহকদেরকে ইন্টেল কোম্পানির ব্যাপারে অবগত করার লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে তারা কম্পিউটারের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কম্পিউটার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভর্তুকি পাওয়ার জন্য ঐসকল প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের বিজ্ঞাপনে ইন্টেলের ‘Intel Inside’লেবেল ব্যবহার করতে হতো। ভর্তুকির অর্থ সংস্থানের জন্য ইন্টেল কোন কম্পিউটার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান হতে চিপ বিক্রির জন্য বার্ষিকভাবে যে অর্থ পেত, তার একটি অংশ আলাদা করে রাখতো। এই অর্থের মাধ্যমে তারা ঐ কোম্পানি সেই বছরে প্রিন্ট এবং টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনের পেছনে যে অর্থ ব্যয় করতো; তার অর্ধেক খরচ যোগাতো। যদিও এই সিদ্ধান্তের ফলে ইন্টেলের কয়েকশো মিলিয়ন ডলার ব্যয় হতো, তথাপি এই ধরণের ক্যাম্পেইনের ফলে তারা বিশ্বব্যাপী পরিচিত একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়। আর নিজেদেরকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ডে পরিণত করাই ছিলো তাদের লক্ষ্য। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তারা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সমর্থ হয়।
আবারও ব্যর্থতার হানা
ইন্টেলের সর্বজনবিদিত যে টেকনিক্যাল পরাক্রম তাতেও ব্যর্থতা এসেছে। এখন পর্যন্ত এর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার নাম ‘পেন্টিয়াম ফ্ল’।এতে পেন্টিয়াম সিপিইউ এর ৩.১ মিলিয়ন ট্রানজিস্টরের মধ্যে অজানা একটি অংশ ভুলভাবে কাজ করে। ১৯৯৩ সালে বাজারে আসা এই চিপে যে সমস্যা রয়েছে তা কোম্পানির ইঞ্জিনিয়াররা ধরতে পারেন চিপ বিক্রির উদ্দেশ্যে মার্কেটে চলে যাওয়ার পর। তবে তারা এই ব্যাপারে চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং ঠিক করেন যে পরের চিপগুলোতে যেন এই সমস্যা না থাকে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। কিন্তু ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া‘র লিঞ্চবার্গ কলেজএর গণিতবিদ থমাস নাইসলিএই ত্রুটির ব্যাপারটি ধরে ফেলেন।
প্রথমদিকে তৎকালীন সিইও গ্রুভ ত্রুটিযুক্ত প্রোডাক্টগুলো ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু যখন আইবিএম ঘোষণা দেয় যে তারা এই সিপিইউযুক্ত কম্পিউটার বিক্রি করবে না, তখন ইন্টেল এই প্রোডাক্ট ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এর ফলে ইন্টেলকে ৪৭৫ মিলিয়ন ডলারের লোকসান গুনতে হয়।
পেন্টিয়াম সংক্রান্ত বিভ্রাটের কারণে কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও ইন্টেল চিপ এবং মাইক্রোসফট সফটওয়্যারযুক্ত প্রযুক্তি প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধরাশায়ী করে নিজেদের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখে। অ্যাডভান্সড মাইক্রো ডিভাইসেস (এএমডি/AMD), ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন্স কোম্পানি মটোরোলা, কম্পিউটার ওয়ার্কস্টেশন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সান মাইক্রোসিস্টেমসবা অন্যান্য কোম্পানিগুলো ইন্টেলের মার্কেট শেয়ারে কখনোই হুমকির কারণ হতে পারে নি৷
বিতর্ক
উইন্টেলের যন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মত কেউ না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত মনোপলি বা একক আধিপত্য সৃষ্টির অভিযোগ উঠতে থাকে। এসব অভিযোগের কিছু প্রমাণিতও হয়৷ ১৯৯৯ সালে আমেরিকান একটি ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট মাইক্রোসফটকে মনোপলির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলো আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস।
২০০৯ সালে ইন্টেলকে একই অভিযোগে অভিযুক্ত করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এজন্য তাদেরকে ১.৪৫ বিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে হয়। এছাড়া একই বছর প্রতিদ্বন্দ্বী এএমডিকেও ১.২৫ বিলিয়ন ডলার দিতে হয় ইন্টেলকে। এর মাধ্যমে তারা দীর্ঘদিন ধরে চলমান এক আইনি ঝামেলা অবসান ঘটায়। এই ঝামেলার কারণ ছিলো এএমডির একটি অভিযোগ৷ তাদের অভিযোগ ছিলো ইন্টেল পিসি প্রস্তুতকারকরা যেন এএমডির চিপ ব্যবহার না করে এজন্য তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করেছিলো।
সম্প্রসারণ এবং ক্রমাগত এগিয়ে চলা
১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি এসে ইন্টেল চিপ ছাড়াও অন্যান্য যন্ত্রাংশ তৈরী করতে শুরু করে। আইবিএম এবং হিউলেট-প্যাকার্ডএর মত বড় প্রস্তুতকারকেরা নিজেদের গ্রাহকদের জন্য ইন্টেল-বেইজড কম্পিউটার তৈরী করতে সমর্থ হন। কিন্তু ইন্টেল চাইতো অন্যান্য ছোট কোম্পানিগুলোও যেন তাদের চিপ ব্যবহার করতে পারে। এতে করে বাজার ধরে রাখতে তাদের সুবিধা হবে। তাই তারা গ্রাফিক্স এবং নেটওয়ার্কিং চিপসহ প্রয়োজনীয় সবগুলো যন্ত্রাংশ সহযোগে মাদারবোর্ড তৈরী করতে শুরু করে। ১৯৯৫ সাল নাগাদ কোম্পানিটি ১০ মিলিয়নেরও বেশি মাদারবোর্ড বিক্রি করছিলো পিসি কোম্পানিগুলোর কাছে, যা ছিলো পুরো মার্কেটের প্রায় ৪০ শতাংশ। একবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে এসে তাইওয়ানের আসুসটেক/ ASUSTeKনামক কোম্পানি মাদারবোর্ড তৈরীতে ইন্টেলকে ছাড়িয়ে যায়।
গত শতাব্দীর শেষ নাগাদ অ্যাপল ইনকর্পোরেটেডএর ম্যাকিনটশছাড়া পৃথিবীর সকল পার্সোনাল কম্পিউটারই ইন্টেল বা এএমডির চিপ ব্যবহার করছিলো। ১৯৮৪ সাল থেকে অ্যাপল মটোরোলার সরবরাহকৃত চিপ ব্যবহার করছিলো। ১৯৯৮ সালে ইন্টেলের সিইও হিসেবে গ্রুভের স্থলাভিষিক্ত হন ক্রেইগ ব্যারেট৷তিনি এই অবস্থা বদলে দিতে সমর্থ হন। ২০০৫ সালে স্টিভ জবসযখন ঘোষণা দেন যে ভবিষ্যতের অ্যাপল পিসিতে ইন্টেলের চিপ ব্যবহৃত হবে, তখন টেক বিশ্ব অবাক হয়ে যায়। এভাবে কিছু সার্ভারএবং মেইনফ্রেমনামক কিছু হাই-পার্ফম্যান্স কম্পিউটার ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব পার্সোনাল কম্পিউটারে স্থান করে নেয় ইন্টেল এবং ইন্টেল-কম্প্যাটিবল চিপ। এভাবে নতুন শতকেও সিপিইউ বাজারে চলতে থাকে ইন্টেলের রাজত্ব।
২০০৫ সালে ক্রেইগের পরিবর্তে ইন্টেলের সিইও পদে বসেনপল ওটেল্লিনি।৪ বছর পর অর্থাৎ, ২০০৯ সালেজেন শক্রেইগকে সরিয়ে চেয়ারম্যানের পদে বসেন এবং ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন৷অ্যান্ডি ব্রায়ান্টজেনের পর চেয়ারম্যান হন। তার পরের বছর সিইও পদে অভিষিক্ত হনব্রায়ান ক্রাজনিচ।২০১৯ সালে চিফ ফাইনান্সিয়াল অফিসারবব সোয়ানসিইও হন এবং তার আমলেই ইন্টেল ‘ফরচুন ৫০০’ এর করা সবচেয়ে বড় আমেরিকান কোম্পানির তালিকায় স্থান পায়। তাদের বর্তমান সিইও হলেন প্যাট্রিক পি গেলসিঙ্গার।২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লোকের সংখ্যা মোট ১,১০,৮০০জন মতান্তরে ১,১০,৬০০জন।
মূল কোম্পানি ছাড়াও পুরো বিশ্বজুড়ে ইন্টেলের অধীনে নানা প্রতিষ্ঠান আছে। যেমন :মোবিলআই, মোভিডিয়াস, সিগঅপ্ট, উইন্ড রিভারইত্যাদি।
আয়
২০২০ সালে ইন্টেলের মোট আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৭৭.৮৭ বিলিয়ন ডলারে। তার আগের বছর, ২০১৯ সালে তাদের আয়ের পরিমাণ ছিলো ৭১.৯৭ বিলিয়ন ডলার। এক বছরে তাদের আয় বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। ২০২০ সালে তাদের নেট আয়ের পরিমাণ হলো ২০.৯ বিলিয়ন ডলার। মূলত একুশ শতকে এসে কেবল ৩-৪ বছর ছাড়া আর কোন বছরই ইন্টেলের আয় আগের বছরের তুলনায় কমেনি। করোনাকালীন সময়েও অর্থনৈতিকভাবে তরতর করে এগিয়ে গিয়েছে তারা৷
This is a Bangla article. This article is about the evolution of American tech giant Intel.
All the necessary links are hyperlinked.
Featured images are collected from Google.