ষড়যন্ত্রের সূচনা বিশ শতকের শেষার্ধে। আল-কুদসসহ ফিলিস্তিন ভূখণ্ড তখন উসমানি খেলাফতের শাসনাধীন। যদিও খেলাফতের দাপট নিভু নিভু, তারপরও তাে খেলাফত! মুসলিম শক্তি। ফিলিস্তিনিদের জীবনমান বেশ উন্নত ও সমৃদ্ধ। সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী আরব মুসলিম আর কিছু খ্রিষ্টান।
ইহুদিদের সংখ্যা সাকুল্যে শতকরা চার ভাগ। ধূর্ততা, শঠতা আর বেইমানির কারণে ইহুদিদের স্থায়ী নিবাস হতাে না কোথাও। ছলচাতুরীর কারণে যেখানেই গেছে, মার খেয়েছে। যাযাবরের জিন্দেগি ছিল তাদের। এ স্থানে কত দিন তাে ও স্থানে কত দিন, এভাবেই ছিল তাদের জীবনযাত্রা। মার খেয়ে খেয়েই তারা স্বপ্ন দেখত একটি নিজস্ব ভূখণ্ডের। যেখানে নীরবে, নির্বিঘ্নে ধূর্ততা আর শঠতার চর্চা করতে পারবে। অশান্তির আগুন কীভাবে জ্বালিয়ে রাখা যায় পুরাে দুনিয়ায়, ঠান্ডা মাথায় বসে সে ষড়যন্ত্রের ছক আঁকতে পারবে।
ইহুদিরা স্বপ্ন দেখল জেরুজালেম নিয়ে। মুসলমানদের ভালােবাসার আল-কুদস। ফিলিস্তিন। হ্যাঁ, ফিলিস্তিনেই হবে তাদের স্বপ্নের সেই প্রতিশ্রুত ভূমি। শুরু হলাে স্বপ্নপূরণের মিশন। ফিলিস্তিনে তারা রাষ্ট্র গড়বে, কিন্তু এখানে তাদের লােক কই? পুরাে ফিলিস্তিনে সাকুল্যে কয়েক হাজার ইহুদির বসবাস।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ। ব্রিটেনের মিত্রশক্তির বিপরীত জোটে ছিল উসমানি খেলাফত। ব্রিটেনের জোটের কাছে তাদের পতন হয়েছে। ফিলিস্তিন থেকে গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে হাজার বছর ধরে চলে আসা মুসলিম শাসনের হাত। ১৯১৯ সালে উসমানি খেলাফতের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে
ফিলিস্তিনের মাটি থেকে। পবিত্র আল-কুদসের অলিগলিতে এখন তুর্কি সৈনিকদের পরিবর্তে ব্রিটিশ সৈনিকদের দাম্ভিক পদচারণ। ফিলিস্তিন এখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন। খ্রিষ্টানদের উপনিবেশ।
১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বাধে, তখন ব্রিটিশ সৈন্যরা ফিলিস্তিনে এসেছিল উসমানি খেলাফতের কর্তৃত্ব থেকে ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করতে। হ্যাঁ, রক্ষা করতে। আরব জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফিলিস্তিনিরাই তাদের স্বাগত জানিয়েছিল। উসমানিদের শাসন তখন তাদের মনে হয়েছিল ভিনদেশিদের শাসন। কারণ, উসমানিরা তুর্কি আর তারা আরব। ভিনদেশিরা কেন আমাদের শাসন করবে? আমরা স্বাধীনতা চাই। আমরাই আমাদের দেশ শাসন করব।
ইসলামের মূল শিক্ষাটা তারা ভুলে গিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিল মুসলিম ভ্রাতৃত্বের সৌন্দর্য। (নাকি কৌশলে তাদের ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল?) তুর্কি হলেও ওরা তাে মুসলিম। মুসলিম মুসলিমের ভাই। ভাই আবার ভিনদেশি হয় কীভাবে?
কিন্তু জাতীয়তাবাদের ভূত তাদের মাথায় এতই শক্ত হয়ে আসন গেড়েছিল যে এসব ভাবার মতাে বােধশক্তিটুকুও তাদের ছিল না। যুদ্ধ তাে শেষ। তুর্কি সৈন্যরা চলে গেছে ফিলিস্তিন ছেড়ে। ব্রিটিশদের কাজ শেষ। তাদের এবার চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু না, তারা যাবে না! এই অঞ্চলে শান্তি (!) প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের আরও কিছুদিন থাকতে হবে।
আরব জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফিলিস্তিনিরা তবুও খুশি। দেরি হােক, তবু তারা তাে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পাবে। যেখানে তুর্কিদের কোনাে কর্তৃত্ব থাকবে না। নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর একটি ঘােষণা দেন। ইতিহাস যেটাকে বেলফোর-ঘােষণা নামে স্মরণরেখেছে। ঘােষণাটিতে তিনি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার
শপথ করেন। এটা ছিল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একটি ধোকা। কারণ, জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফিলিস্তিনিদের বাইরে যারা ছিলেন, তাঁরা
মনেপ্রাণে চাইতেন উসমানি খেলাফতের অধীনেই থাকুক আল-কুদস আর ফিলিস্তিন। তারা কোনােভাবেই ব্রিটিশদের পদচারণ এই মাটিতে সইতে পারছিলেন না। ব্রিটিশবিরােধী এসব ফিলিস্তিনির সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যেই ছিল তার এ ঘােষণা।
নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা শুনে এসব ফিলিস্তিনি পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু এর পেছনে যে বেলফোরের অসৎ ও ধূর্ত একটি উদ্দেশ্য ছিল, তারা টেরই পাননি। টের পেলেন যুদ্ধ যখন শেষ হলাে, তখন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল ফিলিস্তিনের মাটিতে দলে দলে ইহুদিরা এসে ঘরবাড়ি নির্মাণ করছে। জাহাজ বােঝাই করে ইহুদিরা আসছে ইউরােপ থেকে। তাদের পৃষ্ঠপােষকতা আর পুনর্বাসনের কাজে সার্বিক সহযােগিতা করছে ফিলিস্তিনের ব্রিটিশ প্রশাসন। ইহুদিদের কেউ কেউ স্থানীয় আরবদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে বাড়ি নির্মাণ করে, কেউ কেউ পতিত জমি দখলে নিয়ে সেখানে থিতু হয়। আবার কারও কারও জন্য স্বয়ং ব্রিটিশ প্রশাসন জমি অ্যাকোয়ার করে বসতি নির্মাণের বন্দোবস্ত করে দেয়।
ব্রিটিশ উপনিবেশ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল যেখানে কয়েক হাজার, অল্প কদিন যেতে না যেতেই তা লাখ ছাড়িয়ে যায়। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ইহুদিদের ছােট-বড় ২২০টি বসতি গড়ে ওঠে। ১৯৩১-এ এসে দেখা গেল ইহুদিদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পৌনে ২ লাখ। মূল জনসংখ্যার ১৭ ভাগ। অল্প কয়েক বছরে ৪ ভাগ থেকে ১৭ ভাগ-কল্পনা করা যায়?
কল্পনা করা যাক বা না যাক, ইহুদিদের সংখ্যা বাড়তেই থাকল ফিলিস্তিনে। বাড়তে থাকল এর চেয়েও আরও অকল্পনীয় আর দ্রুত হারে। ইহুদিদের স্বপ্নপূরণের জন্যই এত আয়ােজন। তাদের একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন। যেখানে নির্বিঘ্নে তারা ধূর্তামির জাল বুনতে পারবে। পৃথিবীকে অশান্তির দাবানলে পােড়ানাের জন্য ব্রিটিশরা তাদের সেই স্বপ্নপূরণে সর্বাত্মক সহযােগিতা করছে। তাদের সঙ্গে আছে আমেরিকা।
বেলফোর ঘােষণা ছিল এই স্বপ্ন বাস্তবায়নেরই একটি পদক্ষেপ। কিন্তু আমেরিকা আর ব্রিটেন কেন ইহুদিদের এমন সহযােগিতা করবে? বিশ্ব জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে ইতিহাসখ্যাত সন্ত্রাসী জাতি ইহুদিদের জন্য স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তারা কেন এত গরজ দেখাবে?
এই কেন’র জবাবে অনেক কিছু বলা যেতে পারে। অধিকাংশ ইহুদির বাস ছিল ইউরােপে। এরা কখন কী করে বসে, কোনাে ঠিক নেই। এদের বিশ্বাস করা খুব কঠিন। যত দূরে রাখা যায় এদের, ততই মঙ্গল। ফিলিস্তিনে তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র বানিয়ে দিলে তারা নিজেদের রাষ্ট্রে চলে যাবে। ইউরােপিয়ানরা আতঙ্ক আর অনিষ্টের আশঙ্কা থেকে রেহাই পাবে। তা ছাড়া ইহুদিরা খুবই দূরদর্শী জাতি। ব্রিটিশ ও মার্কিন প্রশাসনের প্রতিটি বিভাগে তাদের লােক নিয়ােজিত। এরা ভেতর থেকে প্রশাসনকে সব সময় চাপের মুখে রাখে। এদের চাপের কারণেই ব্রিটিশ-মার্কিন প্রশাসন ইহুদিদের জন্য স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্রের পক্ষে তােড়জোড় দেখাতে বাধ্য হয়।
ইহুদিদের আছে বিপুল অর্থবিত্ত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতারা ব্রিটেনকে প্রস্তাব দিল, ফিলিস্তিন তাে তােমাদের দখলেই আছে, সেখানে আমাদের একটি রাষ্ট্র বানিয়ে দাও, যুদ্ধে তােমাদের যা লােকসান হয়েছে, আমরা সব পুষিয়ে দেব। বােমা তৈরির দুর্লভ একটি উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের প্রয়ােজনে ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান এই জিনিসটা তৈরি করে দিয়েছিলেন। তার তৈরি এ উপকরণ যুদ্ধের সময় অনেক কাজে লাগে ব্রিটিশদের। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তাঁর এ কাজে খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করেন, এর জন্য তিনি কী পুরস্কার চান?
বাইজম্যান উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমাদের স্বাধীন একটি ভূখণ্ড নির্মাণে আপনারা সহযােগিতা করবেন। আর সেটা হবে ফিলিস্তিনের মাটিতে। ব্যস, আর কিছু লাগবে না।
এসব নানাবিধ কারণে ব্রিটিশ-মার্কিন শক্তি ফিলিস্তিনে ইহুদিদের স্বাধীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে তােড়জোড় শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে রেখেছিল মূলত এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই। দীর্ঘ ৩০ বছর তারা এখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে রাখে এবং ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বন্দোবস্ত করে। একদিকে তারা বিশ্বের নানা স্থানে বসবাসরত ইহুদিদের জন্য অবারিত করে দেয় ফিলিস্তিনের দুয়ার, আরেক দিকে আগত ইহুদিরা তাদের মদদে গড়ে তােলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন।
এই সংগঠনগুলাের কাজ হলাে স্থানীয় আরব মুসলিমদের তাদের নিজস্ব ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে ইহুদি বসতি নির্মাণ করা। স্বভাবতই স্থানীয় আরব মুসলিমরা নিজেদের ভিটেমাটি ছাড়তে চাইত না। ইহুদি সংগঠনগুলাে তখন বেছে নিত ভয়ংকর পন্থা। যারাই ভিটেমাটি ছাড়তে অস্বীকৃতি জানাত, তারাই শিকার হতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের।
ইহুদিদের এই দমন-পীড়ন যখন বিশ্ব মিডিয়ায় উঠে আসে আর সমালােচনার ঝড় শুরু হয়, তখন তারা কৌশল পরিবর্তন করে। ইহুদিরা বড় ভয়ানক সম্প্রদায়। নিজেদের জাতীয় স্বার্থ অর্জনের জন্য এরা নিজেদের নিরপরাধ লােককে হত্যা করতেও পিছপা হয় না।
এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলো পড়ুন:
মুসলমানদের জেরুজালেম বিজয়
ক্রুসেডারদের নৃশংসতা এবং সালাউদ্দিন আইয়ুবীর মহাবিজয়
ফিলিস্তিনের বুকে দখলদার ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা
This is a Bengali article. This is the third episode of ‘The History of Zionist Israel’.
Necessary reference are hyperlinked inside article
Featured image: Getty image