১৯৯১ সালের ১৫ জানুয়ারি বেলা এগারটার দিকে ওভাল অফিসে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক শীর্ষ স্থানীয় উপদেষ্টাদের সঙ্গে এক বৈঠক করার পর প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরাকে হামলা চালানাের নির্দেশনামায় স্বাক্ষর করেন। ওইদিন বিকেলে ডিক চেনী প্রেসিডেন্টের নির্দেশনামা বাস্তবায়িত করার আদেশনামায় স্বাক্ষর করেন। পরদিন অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারি বুশ পররাষ্ট্রসচিব বেকার ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ, মিত্রদেশগুলাের রাষ্ট্রদূত ও অন্যদের জানিয়ে দেন যে ওইদিন রাতেই ইরাকের ওপর হামলা চালানাে হবে।
হামলা শুরুর এক ঘণ্টা আগে পর্যন্ত কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত ছিল। মস্কো শেষ চেষ্টার জন্য ওয়াশিংটনের কাছে সময় চাইলেও যুদ্ধ বন্ধ করা যায়নি। ১৭ জানুয়ারি প্রথম প্রহরে ইরাকের লক্ষ্যবস্তুতে ‘টমহক’ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনী উপসাগরীয় সংকটের শেষযাত্রায় শরিক হয়। ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ শুরুর আগের সপ্তাহের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল বেশ লক্ষণীয়।
জাতিসংঘ মহাসচিব পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে নিষ্ফল জেনেও শেষ মুহূর্তে ছুটে গিয়েছিলেন বাগদাদে। সাদ্দাম হােসেন সম্ভবত কুয়েত থেকে এভাবে সরে আসার থেকে যুদ্ধ করাটাই বড় মনে করছিলেন। তাই অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে
১৫ জানুয়ারি তিনি নিজের হাতে যুদ্ধের সমস্ত দায়িত্বভার তুলে নেন। অন্যদিকে, বুশও পেন্টাগনকে ইরাক আক্রমণের কথা জানিয়ে দেন। তবে সম্ভবত বিমান আক্রমণ রাতে সুবিধাজনক হবে ভেবে আক্রমণ কয়েক ঘণ্টা বিলম্বে ১৭ জানুয়ারি প্রথম প্রহরে শুরু হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রজোটের ওই যুদ্ধ ছিল ‘গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা’ রক্ষার জন্য। মার্কিন সমর বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকভাবে ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মে’র স্থায়িত্বকাল ৪৮ ঘণ্টা বলে ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের তৃতীয় দিনে ইরাকের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও বিমানবাহিনীর সাহায্যে আক্রমণ প্রতিহত করার প্রেক্ষাপটে এর স্থায়িত্বকাল সপ্তাহ বলে জানিয়ে দেন।
ওই সংবাদে মার্কিন জোটভুক্ত দেশগুলাের মধ্যে একটা অস্বস্তির ভাব লক্ষ করা গিয়েছিল। একটা ছােট্ট পরিসংখ্যান দিলে বােঝা যাবে কত ব্যাপক আকারে ইরাকের ওপর বােমা হামলা চালানাে হয়েছিল। প্রথম দিকে অর্থাৎ ১৭-২৫ জানুয়ারি, সময়সীমায় মােট বিমান হামলা চলে ১৪,৪০০ বার। গড়ে প্রতিদিন বােমাবর্ষণ করা হয় ১৮,০০০ টন যা
হিরােশিমায় নিক্ষিপ্ত বােমার সমান। এই বিরাট বহরের আক্রমণ চালাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্রজোটের বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়ােজন হয়।
তারপরও প্রেসিডেন্ট বুশ ঘােষণা দিয়েছিলেন যে, এ যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সব থেকে কম অর্থ ব্যয়ের যুদ্ধ। যুদ্ধে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৬৮ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থ দেবে কুয়েত
১৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, জাপান ১১ বিলিয়ন ডলার, জার্মানি ৫.৫ বিলিয়ন ডলার, সৌদি আরব ৩৩ বিলিয়ন ডলার; যুক্তরাষ্ট্র ০৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও অনুমানের তুলনায় যুদ্ধ কিছুটা বিলম্বিত হওয়ার কারণে আরও বেশি কিছু অতিরিক্ত অর্থ যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যয় করতে হয়েছিল।
এর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় ছিল ৩.১ ট্রিলিয়ন ডলার, কোরিয়া যুদ্ধে মার্কিনীদের ব্যয় ছিল ২শ ৬৫ বিলিয়ন ডলার, সেই তুলনায় উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন ব্যয়ের পরিমাণ ছিল নিতান্তই সামান্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওই স্বল্প (!)
ব্যয়ের জন্য জনগণকে কোনােরকম কর দিতে হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তার আসল উদ্দেশ্য এর মধ্যেই বােঝা যায়। অর্থাৎ বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হবে অথচ জনগণকে তার খেসারত দিতে হবে না, সেটা ছিল অকল্পনীয়।
অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মে মার্কিন কূটনীতির সাফল্যের কোনাে তুলনা হয় না। ওয়াশিংটন সমস্ত পশ্চিমাদেশগুলাের সমর্থন লাভে সমর্থ হয়। সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ইরাকের পরীক্ষিত বন্ধু, কিন্তু কুয়েত আক্রমণের দায়ে সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়ন ইরাকের উপর নাখােশ হয়ে পড়েছিল।
বলা যেতে পারে, উপসাগরীয় যুদ্ধ ছিল একটি দেশের বিরুদ্ধে বহুজাতির যুদ্ধ। অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম-এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আমরা উল্লেখ করতে পারি।
১. আরব দেশগুলাের সেনাবাহিনী এই প্রথম সক্রিয়ভাবে একত্রে কোনাে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
২. আরব দেশগুলাের মধ্যে বিভক্তি আরও প্রকট হয়ে ওঠে এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
৩. এই প্রথমবারের মতাে এই অঞ্চলে মার্কিনীরা এত বড় আকারের ভূমিকা পালন করে। এর আগে তারা দুটো ছােট আকারের ভূমিকা রেখেছিল লেবাননে ১৯৫৮ সালে এবং ১৯৮২-৮৩ সালে।
৪. এই প্রথমবার আঞ্চলিক আর বহিঃশক্তি একত্রে যুদ্ধ করে, যেটা কিনা অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সময় দেখা গিয়েছিল।
৫. ব্রিটেন ও ফ্রান্স একত্রে যুদ্ধে অংশ নেয়, যেটা সচরাচর পরিলক্ষিত হয়নি।
৬. অতীতে সাদ্দাম হােসেন মূলত আশা করেছিলেন ‘প্যান আর
‘প্যান ইসলামিক’ একটা অনুভূতি আরব সরকারগুলাের মধ্যে তৈরি হবে কিন্তু সেটা হয়নি।
৭. যুদ্ধের আগে, এমনকি পরে জোটবন্ধ দেশগুলাের মধ্যে সম্পর্ক সহজ ছিল না। জোটের অন্তর্ভুক্ত অনেক আরব বা অনারব দেশের অনেক রকম সমস্যা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ সেই পরিস্থিতিকে বদলে দেয়। উপসাগরীয় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইরাককে যুক্তরাষ্ট্র সে ‘শাস্তি, দিয়েছিল, তা সমস্যার কোনাে সমাধান বয়ে নিতে পারেনি। তার বড় প্রমাণ ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে পুনরায়
ইরাক আক্রমণ করে ও দেশটি দল করে নেয়।
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ সূচনা করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ড জর্জ এইচ. ডব্লিউ. বুশ, আর ২০০৩ সালে দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু করেন তার ছেলে জর্জ ডব্লিউ. বুশ। ইরাক যুদ্ধে জাতিসংঘের ভূমিকা সামনে চলে এসেছিল। জাতিসংঘের ইতিহাসে এ ধরনের সংকট এই প্রথম নয়। তারপরও এটা অনেক দিক থেকে ছিল অদ্বিতীয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৮ নং প্রস্তাব অনুযায়ী ওই সংকটের সমাধানের চেষ্টা
করা হলে।
ওই প্রস্তাবের উল্লেখলোগ্য দিক ছিল: (১) ইরাককে কুয়েত থেকে হটানাে; (২) শান্তির কোনাে শর্তাবলি দেয়া হয়নি; (৩) জাতিসংঘকে কোনাে প্রকার যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। ইরাকের কুয়েত দখলের পর পরই নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা বারবার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছেন, কিন্তু তারা কোনাে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি।
তারপরও যুদ্ধ শুরু হয়। শেষপর্যন্ত মস্কোর প্রস্তাবে ইরাক কুয়েত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে রাজি হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে যুদ্ধ বন্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ইরাক কেন হরলো? ইরাক কেন পরাজিত হলো?
পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম সেনাবাহিনী এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও, ইরাক কেন যুদ্ধে হেরে গেল, এ ব্যাপারে সমরবিশারদরা বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। সাদ্দামের হেরে যাওয়ার কারণগুলাে ছিল মােটামুটি এরকম:
১. সবচেয়ে বড় ভুল ছিল কুয়েতদখল করার পর সৌদি সীমান্তে থেমে যাওয়া। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ইরাক যদি সৌদি আরবের দাহরান এবং দাম্মাম পাের্ট দখল করে নিত এবং সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় তেলক্ষেত্রগুলাে অধিকার করতে পারত তাহলে মিত্রবাহিনী এত বিশাল সমরসজ্জা করতে পারত না। তাছাড়া তেলের এত বেশি ভাণ্ডার তার নিয়ন্ত্রণে চলে যেত যে শক্তি প্রয়োগের চিন্তা করাটাই তখন কঠিন হয়ে দাঁড়াত।
২. সাদ্দাম হােসেন কুয়েতের প্রতিরক্ষা নিয়েই শুধু ব্যস্ত ছিলেন। দক্ষিণ ইরাকের প্রতিরক্ষা নিয়ে তিনি চিন্তাও করেননি।
৩. সাদ্দাম হােসেনের মার্কিন প্রশাসন সম্পর্কে ধারণা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। আমেরিকান সৈন্যদের সম্পর্কে তার কোনাে অভিজ্ঞতাই ছিল না।
৪. নিজের অস্ত্রপাতির উপর সাদ্দামের ছিল অগাধ বিশ্বাস। তিনি তাঁর স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র, সােভিয়েত ট্যাংক, ফরাসি মিরেজ বিমান নিয়ে গর্বিত ছিলেন। কিন্তু ওই যুদ্ধের ফলে তাঁর সেই গর্ব চূর্ণ হয়ে যায়।
৫. নতুন প্রযুক্তির মুহুর্মুহু টমহকের গর্জন, ক্রুজ মিসাইলের অগ্নি স্কুলিঙ্গ বাগদাদকে বিহ্বল করে দিয়েছিল।
৬, ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র রহস্যজনক কারণে ব্যবহার করা হয়নি। কুয়েতে অনেক রাসায়নিক অস্ত্রের শেল পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু তা ছােড়া হয়নি।
পরবর্তীকালে ইরাকে অস্ত্র পরিদর্শক দলকে পাঠিয়েও কোনাে রকম রাসায়নিক অস্ত্রের
সন্ধান পাওয়া যায়নি। ৪৩ দিনের সেই যুদ্ধে ইরাক তার পুরাে সামরিক শক্তির ৪৫ ভাগ। হারিয়ে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় শােচনীয়ভাবে। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের পরও উত্তেজনা সেখানে ছিল।
আরো পড়ুনঃ
উপসাগরীয় যুদ্ধঃ সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত দখল এবং এর পরিণতি (পর্ব ১)
উপসাগরীয় যুদ্ধঃ সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত দখল এবং এর পরিণতি (পর্ব ২)
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক ইরাকের উপর ‘চাপ’ প্রয়ােগ করতে থাকে। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসেও ইরাকের সামরিক স্থাপনার উপর যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বোমাবর্ষণ করে। এর আগে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে একাধিকবার ইরাকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানাে হয়েছিল। তখন অভিযােগ ছিল ইরাক জাতিসংঘের অস্ত্র-পরিদর্শকদের সব জায়গায় অস্ত্র অনুসন্ধানের অনুমতি দিচ্ছে না। ইরাক জীবাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে এই অভিযােগ তখন উঠে।
এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল:
১. কোয়ালিশন বাহিনীর জয়
২. কুয়েতের দখলমুক্তি
৩ ইরাকি এবং কুয়েতি সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানী
৪. সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের দমন
৫. সৌদি আরবে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি
৬. ওসামা বিন লাদেন কে সৌদি আরব থেকে বহিস্কার
৭. জাতিসংঘ কর্তৃক ইরাকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ
৮. কুয়েত থেকে ফিলিস্তিনিদের বহিস্কার।
উপসাগরীয় যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। এই ঘটনা পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস বদলে দেয়। পাশাপাশি ঘটে যায় ক্ষমতার রদবদল। এত কম সময়ের যুদ্ধে এত বেশি পরিমাণ মানুষ নিহত হওয়ার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
তাছাড়া এই যুদ্ধে যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ বিনষ্ট হয়েছিল তা অন্যান্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোভূক্ত দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ঘাঁটি গাঁড়তে থাকে। সৌদি আরবে অবস্থান নেয় বিপুল পরিমাণ মার্কিন সৈন্য। এছাড়া কাতার, আরব আমিরাত, লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী ঘাঁটি গেড়ে বসে। মোটকথা এই যুদ্ধ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।
This is a Bengali article. It’s About 3rd episode of ‘Gulf War’.
Necessary reference are hyperlinked inside article.
Featured Image: Al Jazeera