লিখুন
ফলো

কাঞ্চনজঙ্ঘা: তুষারধবল শুভ্রতায় আচ্ছাদিত ওপারের স্বর্গ

পর্বতের প্রতি মানুষের বিনম্র শ্রদ্ধা সেই আদিকাল থেকেই। আর পর্বতের চূড়া জয় করার মতো গৌরবের ভাগীদার হতে মানুষ চেষ্টাও করে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরেই। পর্বত আরোহণ চাট্টিখানি কথা নয়, এজন্য প্রয়োজন হয় কঠোর অনুশীলন, প্রশিক্ষণ, মানসিক আর শারীরিক সক্ষমতা। বেকায়দা হলে পর্বত জান কবচ করে নিতে মোটেও দ্বিধা করে না। এই যেমন যাত্রাপথে হাজারে হাজারে হিন্দুস্তানী বন্দী মারা পড়তো বলে আফগানিস্তানের একটি পর্বতের নামই হয়ে গিয়েছে হিন্দুকুশ বা হিন্দুদের ঘাতক। তাই বলে পর্বত আরোহীরা কিন্তু থেমে নেই।
কাঞ্চনজঙ্ঘা
কাঞ্চনজঙ্ঘা পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত চূড়া; image: times of india

শুভ্র আর সাদা বরফে আচ্ছাদিত হিমালয় পর্বতশ্রেণীর দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বতটির নাম কাঞ্চনজঙ্ঘা। উচ্চতা বিবেচনায় মাউন্ট এভারেস্ট এবং কে২ এর পরেই কাঞ্চনজঙ্ঘার অবস্থান। মেঘমুক্ত নীল আকাশে সাদা বরফে আচ্ছাদিত পাহাড়ের চূড়ার এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে কার না মন চায়! তাইতো প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমান ভারত এবং নেপাল সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলে।কাঞ্চনজঙ্ঘা পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। এর উচ্চতা ৮,৫৮৬ মিটার বা ২৮,১৬৯ ফুট। এটি ভারতের সিক্কিম রাজ্যের সঙ্গে নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে অবস্থিত। হিমালয় পৰ্বতের এই অংশটিকে কঞ্চনজঙ্ঘা হিমাল বলা হয়। এর পশ্চিমে তামূর নদী এবং জংসং লা শৃঙ্গ, এবং পূর্বদিকে তিস্তা নদী অবস্থিত। মাউন্ট এভারেস্টের মত কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করাও বেশ দুরূহ কাজ। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্র সাদা রূপ পর্বত আরোহীদের ভুলিয়ে দেয় দুনিয়ার মায়া। তাই প্রতিবছর হাজার হাজার পর্বত আরোহী পৃথিবীর তাবৎ কুৎসিতকে ভুলে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ছুটে আসেন কাঞ্চনজঙ্ঘা জয় করতে। কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করতে যেয়ে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতর বেশি মানুষ জান কুইয়েছেন। আক্ষরিক অর্থে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় আজ পর্যন্ত কেউ পা রাখতে পারেনি বা রাখেনি। অবশ্য এর একটি ব্যাখ্যা আছে।

নেপাল আর সিকিমের অনেক মানুষ এই পর্বতকে পূজা করে। প্রথম এর চূড়ায় যে দলটি পদার্পণ করে, তারা সিক্কিমের রাজা এবং ধর্মগুরুকে কথা দিয়ে এসেছিল যে, কাঞ্চনজঙ্ঘার সর্বোচ্চ চূড়ায় কেউ পা রাখবে না। সেই থেকে এ পর্যন্ত সকল অভিযাত্রী দল এই নিয়মটি মেনে এসেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার নিচে বাস করা লেপচারা বিশ্বাস করে, এই পর্বতে ইয়েতি থাকে। অমরত্বের রহস্যও নাকি এর শ্বেতশুভ্র শৃঙ্গের নীচে লুকানো আছে। ১৮৫২ সালের আগপর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘাই পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ বলে পরিচিত ছিল।

কাঞ্চনজঙ্ঘা
image: getty image

স্বাভাবিকভাবেই আমরা জানি যে হিমালয় পর্বতশ্রেণীতে শীতকালে আরোহণ করা সবচেয়ে দুরুহ এবং বিপদজনক কাজ। সেজন্য গ্রীষ্মকালে কিংবা বছরের অন্যান্য সময় যখন বরফের পরিমাণ কম থাকে তখন পর্বতশৃঙ্গ আরোহন করা হয়ে থাকে। ২৫শে, মে ১৯৫৫ সালে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ অভিযাত্রী জো ব্রাউন এবং জর্জ ব্যান্ড কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় আরোহণ করতে সক্ষম হন। তবে এটা শীতকালীন আরোহণ ছিল না। ১৯৮৬ সালের ১১ই জানুয়ারি সর্ব প্রথম শীতকালীন আরোহন সম্পন্ন করেন ব্রিটিশ পর্বত আরোহী জের্জি কুকুচজকা এবং ক্ৰিজটোভ উয়িলিকি।

কাঞ্চনজঙ্ঘা মাউন্ট এভারেস্টের ১২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এর পাঁচটি মূল শৃঙ্গের মধ্যে তিনটা–মুখ্য, কেন্দ্ৰীয় এবং দক্ষিণ- ভারতের উত্তর সিক্কিম জেলায়, এবং নেপাল সীমান্তে অবস্থিত। বাকী দুটি শৃঙ্গ নেপালের তাপ্লেজুং জেলায় অবস্থিত। কাঞ্চনজঙ্ঘা-মুখ্য ভারতের সৰ্বোচ্চ শৃঙ্গ। পাঁচটি পর্বতচূড়ার কারণে একে “তুষারের পাঁচটি ঐশ্বৰ্য” বলা হয়। সিক্কিম এবং দার্জিলিংয়ের স্থানীয় লোকেরা একে পবিত্র মনে করে পূজা করে।।

১৮৫২ সালের আগ পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘাকে পৃথিবীর সৰ্বোচ্চ শৃঙ্গ বলে ধারণা করা হত, কিন্তু ১৮৪৯ সালে ভারতের বৃহৎ ত্রিকোণমিত্রিক জরীপে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল যে মাউন্ট এভারেস্টই হচ্ছে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। আরো কিছু পুনঃনিরীক্ষণ করার পর ১৮৫৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় যে কাঞ্চনজঙ্ঘা পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। এ কাজে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছিলেন ভারতের কালজয়ী গণিতবিদ রাধানাথ শিকদার।

image: the independent
নামকরণ
কাঞ্চনজঙ্ঘা শব্দটি শুনে তৎসম কাঞ্চন + জঙ্ঘা মনে হলেও আসলে নামটি স্থানীয় শব্দ “কাং চেং জেং গা” থেকে এসেছে, যার অর্থ তেনজিং নোরগে তার বই, ম্যান অফ এভারেস্ট (Man of Everest)-এ লিখেছেন “তুষারের পাঁচ ধনদৌলত”। এটির পাঁচ চূড়া আছে তাদের চারটির উচ্চতা ৮, ৪৫০ মিটারের ওপরে। এ ধনদৌলত ঈশ্বরের পাঁচ ভান্ডারের প্রতিনিধিত্ব করে, স্বর্ণ, রূপা, রত্ন, শস্য, এবং পবিত্র পুস্তক।

 

 

image: Getty image

বাংলাদেশ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা

প্রতিবছর অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল থেকে স্পষ্টভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। দূরের স্বর্গকে নজরবন্দী করতে তাই এই সময়ে হাজার হাজার পর্যটক পাড়ি জমান পঞ্চগড়, লালমনিরহাট এবং তেতুলিয়া অঞ্চলে।

শরতের শেষ সময়ে সচরাচর আকাশে মেঘের আনাগোনা থাকেনা। তাছাড়া শিশির ভেজা হেমন্তের শুরুতে কুয়াশারও খুব একটা প্রকোপ দেখা যায় না। সে কারণে আকাশ থাকে নির্মল এবং স্বচ্ছ। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর করোনা মহামারীর কারণে প্রকৃতি একটু বেশিই নির্মল। যার কারণে দূরের সৌন্দর্যকে এবার একটু বেশি স্পষ্টরূপে দেখা গিয়েছে।

কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম ভাবে ফুটে ওঠে। যেমন সকালের দিকে তুষারধবল পর্বতকে নীল আকাশে মেঘমালার মত ভেসে থাকতে দেখা যায়। বেলা বাড়তে থাকলে কিছুটা ঝাপসা হয়ে ওঠে। আবার শেষ বিকেলে সূর্যকিরণ যখন তির্যক হয়ে পড়ে তখন অপূর্ব মহিমায় অন্যরূপে ধরা দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। রক্তিম দ্যুতি ছড়ানো তুষারধবল পর্বতকে তখন ওপারের স্বর্গ বলে মনে হয়। পর্বতশৃঙ্গটি পর্যটকদের অবাক করতে থাকে তার দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যে।

কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখতে সারাবিশ্ব থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ভারতের দার্জিলিংয়ের টাইগার হিলে ছুটে যান। ভোরে ঊষার সময় কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর রোদ পড়ে সেই রোদ যেন ঠিকরে পড়ে পর্যটকের চোখে। দার্জিলিং-এর টাইগার হিলই কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখার জন্য সবচেয়ে আদর্শ জায়গা। কিন্তু যদি পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই সেই দৃশ্য দেখতে পারেন তবে কেমন হয়? হ্যাঁ এমন সুযোগই রয়েছে।

তেতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা; image: Bangla News 24
এর জন্য আপনাকে পঞ্চগড় আসতে হবে। তেতুলিয়ার ডাকবাংলোর বেলকনিতে বসে দেখতে পারবেন পাহাড়ী নদী বেয়ে আসা পাথর কুড়ানো এবং তারকাঁটা’র ওপাড়ের মানুষের চলাফেরা ও কর্মব্যস্ততা। আর যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে তাহলে তো কথাই নেই-বাংলাদেশে বসেই দেখা যাবে হিমালয়ের অন্যতম বড় পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য! দেশের একমাত্র ‘হিমালয়কন্যা’ হিসেবে খ্যাত পঞ্চগড়ে সবুজ মাঠের পাশে ভেসে উঠছে ছবির মতো সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই সঙ্গে দেখা মিলছে ছায়ার মতো দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি অঞ্চলেরও।

পঞ্চগড়ে হালকা এই শীতের সময়ই কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য দর্শনের সবচেয়ে ভালো সময়। এখন অনেক পর্যটক পঞ্চগড়ে ছুটে আসছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে। এ বছর আকাশ বেশি নির্মল হওয়ায় তেতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার তলদেশের শহরের ঘরবাড়ি এবং গাড়ীর লাইটের আলোও প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব মাত্র ১২২ কিলোমিটার।

এই বছরে শুধু পঞ্চগড়ই নয়, নীলফামারী ও ঠাকুরগাঁও জেলার কয়েকটি এলাকা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গিয়েছে। এসব জেলা থেকে এর আগে এই পর্বতশৃঙ্গটি দেখা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। বিবিসির একটি প্রতিবেদনে এমনটাই জানানো হয়েছে। তেতুলিয়া আবহাওয়া কর্মকর্তা জানান-

বছরের এই সময়ে বৃষ্টি হওয়ায় আর বাতাসে ধুলা, মেঘ-কুয়াশামুক্ত থাকায় অনেক দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। অন্য বছরেও এই সময়ে এখান থেকে এই পর্বত দেখা যায়। তবে এই বছরে আবহাওয়া বেশি পরিষ্কার থাকার কারণে অনেক ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে।

image: Prothom Alo
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সিলেট অঞ্চলে পাহাড় থাকলেও সেগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। বাংলাদেশের পর্বতগুলো মাটির তৈরী এবং সবুজ গাছপালা এবং মেঘের হাতছানিতে ভরপুর। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে গেলেও। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা কিংবা হিমালয় পর্বত শ্রেণীর শুভ্র সাদা আবরণ স্বচক্ষে দেখা চাট্টিখানি কথা নয়।
এর জন্য ভিসা, পাসপোর্টসহ বিভিন্ন ঝামেলা পোহাতে হয়। সবকিছুর পাঠ চুকিয়ে সকলের পক্ষে দার্জিলিং কিংবা সিক্কিম যাওয়া সম্ভবপর হয়ে ওঠেনা। কিন্তু বছরের ওই সময়টাতে স্বদেশের মাটিতে বসেই সেই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। তাই প্রকৃতির নির্মল এবং শুভ্র সাদা হাতছানিতে দেশীয় পর্যটকদের আনাগোনায় ভরে ওঠে উত্তরাঞ্চল।
তুষারধবল হিমালয় পর্বত শ্রেণীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে আপনিও চলে আসতে পারেন তেঁতুলিয়ায়।
আরো পড়ুন:

This is a Bengali article. It is written about Kanchenjunga, the third highest mountain peak in the world.

All the references are hyperlinked within the article.
Featured Image: The Independent
Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous Article

আন্দেজ পর্বতমালায় নিখোঁজ এক বিমানের অমীমাংসিত রহস্য

Next Article

হঠাৎ মানুষ বিলুপ্ত হয়ে গেলে কী ঘটবে পৃথিবীতে?

Related Posts

নেটফ্লিক্সের বিবর্তন : একটি ডিভিডি রেন্টাল কোম্পানি যেভাবে পরিণত হলো বিশ্বের জনপ্রিয়তম স্ট্রীমিং প্লাটফর্মে [পর্ব : ২]

পূর্বের অংশের পর থেকে ২০১৩ : ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল ছিলো নেটফ্লিক্সের জন্য ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়। ২০১৩ সাল থেকেই…

যেভাবে আমেরিকা পরিণত হলো বৈশ্বিক সুপার পাওয়ারে (পর্ব -১) : রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা থেকে জাতিসংঘের সৃষ্টি

বিশ্বজুড়ে ৮০০টিরও বেশি সামরিক ঘাঁটি এবং অন্য যেকোন দেশের চেয়ে সামরিক খাতে বেশি অর্থ ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র মানব…

কন্সপিরেসি থিওরিষ্টদের চোখে ‘এরিয়া ৫১’

সূচিপত্র Hide তাহলে কি হয় এরিয়া-৫১ এর ভিতরে?এখানে এলিয়েন স্পেসক্রাফট বানানো হয়এলিয়েনদের আটকে রাখা হয়েছে এখানেনীল আর্মস্ট্রংয়ের চাঁদে…

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন

Total
0
Share