ইন্দোনেশিয়ার বাহাসা ভাষার ভাষাভাষী লোকজন কফি কে বলেকোপি।আর তারা বিড়ালের মত দেখতে গন্ধগোকুল বা খট্টাশ নামক প্রাণীকে বলেলুয়াক।এসব প্রাণীকে সাধারণত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং সাব-সাহারা (সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে অবস্থিত দেশসমূহ) অঞ্চলে দেখা যায়। বিড়াল ছাড়াও এদের সাথে বানর এবং র্যাকুন নামক প্রাণীর মিল আছে। বানরের মত এদের আছে লম্বা লেজ আর তাদের মুখাবয়ব দেখতে অনেকটা র্যাকুনের মত। এছাড়া এদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো তাদের গায়ের ডোরা কাটা দাগ। খাদ্যশৃঙ্খলে তারা পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এরা সাধারণত পোকামাকড়, ছোট আকারের সরীসৃপ, তাল, আম এবং জামজাতীয় ফলমূল খেয়ে জীবনধারণ করে। কফি বীন খেতেও তারা খুব ভালোবাসে। গাছগাছালিতে ভরা অঞ্চলেই সাধারণত এদের দেখা মেলে। অন্যদিকে খাদ্যশৃঙ্খলে লুয়াক বা গন্ধগোকুলের খাদকেরা হলো যথাক্রমে চিতা বাঘ, বড় আকারের সাপ এবং কুমির।
লুয়াক নিয়ে লেখার কারণ এই কফির সাথে এই প্রাণী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কফির নামের সাথেও জুড়ে গেছে তাদের নাম। এক কাপকোপি লুয়াককফি আমেরিকায় ৮০ থেকে ১০০ ডলারে বিক্রি হয়ে থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে দামী এই কফি তৈরী হয় লুয়াকের মল বা বিষ্ঠা থেকে! অন্যভাবে বলতে গেলে কোপি লুয়াক তৈরীতে এমনসব কফি বীন ব্যবহৃত হয় যেগুলো লুয়াক খেয়ে আংশিকভাবে হজম করে এবং মলত্যাগের মাধ্যমে বের করে দেয়।
যেভাবে তৈরী হয় কোপি লুয়াক
পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কফির খেতাবের পাশাপাশি পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ কফি হওয়ার খেতাবও কোপি লুয়াকের দখলে। কোপি লুয়াকের প্রস্তুত প্রক্রিয়ার শুরুতে খট্টাশ নিজের পছন্দ অনুযায়ী কফি বীন ভক্ষণ করে। এই কফির সংগ্রাহক বা বাজারজাতকারীরা গন্ধগোকুল বা খট্টাশের নিঃসৃত মল কুড়িয়ে জমা করে। তাদের সংগৃহীত এই বিষ্ঠার মধ্যে গন্ধগোকুলের খাওয়া আধা হজম হওয়া কফি বীন থাকে। গন্ধগোকুলের অন্ত্রে এগুলোর গাঁজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তারপর এই কফি বীনগুলোকে সংগ্রহ করে ভালোভাবে ধৌত করা হয় এবং রোদে শুকানো হয়। একবার শুকানো হয়ে গেলে এগুলোকে আবারও ধোয়া এবং শুকানো হয় যাতে করে সংগ্রহকৃত কফি বীনের বহিঃস্থ আবরণের সম্পূর্ণ অপসারণ নিশ্চিত হয়। বীনের পাতলা বহিঃস্থ আবরণ অপসারণ করার পর এগুলোকে যাচাই – বাছাই করে রোস্টিং এর জন্য সংরক্ষণ করা হয়।
গন্ধগোকুলের পরিপাকতন্ত্রে অবস্থান করা পাচক এনজাইমের কারণে বীনের নিজস্ব প্রোটিনসমূহ ভেঙ্গে যায়৷ এই প্রক্রিয়াসমূহ কোপি লুয়াকের সামগ্রিক ফ্লেভার প্রোফাইলে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। এই কফির ভক্তরাও একই মত দিয়েছেন। তাদের মতে এর অপ্রচলিত গাঁজন প্রক্রিয়া বীনের ফ্লেভারকে পরিশোধন করে। এই কফির স্বতন্ত্র ফ্লেভার হয়তো খট্টাশের পেটের ভেতরে থাকা জারক রস এবং অন্যান্য উপাদানের কারণে সৃষ্টি হয়। খট্টাশের পাকস্থলীর পাচকরস এবং বিভিন্ন এনজাইম বীনের সাইট্রিক এসিডের পরিমাণকে বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে লেবুজাতীয় অম্ল স্বাদ এবং আরো বেশি উপাদেয় সুবাসযুক্ত কফি উৎপাদিত হয়। কোপি লুয়াকের জনপ্রিয়তার ফলে একই পদ্ধতিতে আরো অন্যান্য কফি উৎপাদনের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এর কোনটিই এটির মত সফল হতে পারে নি।
যেভাবে এই কফির প্রচলন শুরু হয়
অন্যান্য কফি উৎপাদন প্রণালীর চেয়ে স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে উৎপাদিত এই কফি উৎপাদন করতে শুরু করে ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় কৃষকরা। সময়কাল ছিলো ১৮০০ শতকের দিকে। তখন ইন্দোনেশিয়া ছিলো ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ কোম্পানীর উপনিবেশ। তারা এখানকার জাভা এবং সুমাত্রা দ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকায় কফির প্ল্যানটেশন তৈরী করে। এই প্ল্যানটেশনগুলোতে তারা চাষ করতো অ্যারাবিকা কফি।
এই ডাচ বা ওলন্দাজরা স্থানীয় লোকদের উপর একটি আদেশ জারী করে। এই আদেশ অনুযায়ী স্থানীয়দেরকে প্ল্যানটেশনের কফি গাছ থেকে নিজেদের জন্য কফি বীন ছিঁড়তে নিষেধ করা হয়। কিন্তু গাছ থেকে মাটিতে পড়া কফি বীন সংগ্রহ করার ব্যাপারে তাদের ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি। জাভা এবং সুমাত্রা দ্বীপের স্থানীয় কৃষকরা সহসাই এটি আবিষ্কার করে যে, গন্ধগোকুল প্ল্যানটেশনের কফি গাছ থেকে বীন খায় এবং আংশিক বা পুরোপুরি পরিপাক না হওয়া বীনগুলো তাদের বিষ্ঠায় থেকে যায়। তারা খট্টাশের বিষ্ঠার এই বীন সংগ্রহ করে শুকিয়ে রোস্ট এবং গুড়ো করে নিজেরা ব্যবহার করতে শুরু করে। অল্প সময়ের মাঝেই এই রীতি আশপাশের সমস্ত উপনিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু বন্য খট্টাশকে শিকার করে এই ধরণের কফি উৎপাদন করা বেশ শ্রম ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিলো; তাই এ ধরণের কফি বেশ ব্যয়বহুল পণ্যে পরিণত হয়। অনেক সূত্রের মতে, বালি দ্বীপে পর্যটন শিল্পের অগ্রগতির পরই এইসুখাদ্যে’র ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ এবং চাহিদা বেড়ে যায়।
আরো পড়ুনঃ
পাস্তাঃ যে খাবার ছাড়া ইতালিয়ানরা এক প্রকার অসম্পূর্ণ
কোপি লুয়াকের উচ্চমূল্যের কারণ
কোপি লুয়াক কফি বীনের উচ্চমূল্যের কারণ ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে এই কফি উৎপাদন করতে গেলে প্রচুর সময় এবং শ্রমের দরকার হয়। কৃষকরা বন এবং জমিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজে যে বিষ্ঠা পায়, তাতে হয়তো এক দলায় পাঁচ বা ছয়টি বীন পাওয়া যায়। কৃষকদের মতে, গন্ধগোকুলের বিষ্ঠা পাওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো ভোর বেলা। কারণ এরা নিশাচর প্রাণী। কিন্তু এটা অনুমান করতে কষ্ট হওয়ার কথা না যে এক পাউন্ড কোপি লুয়াক কফির বীন সংগ্রহ করতে প্রচুর সময় লাগে। তার ওপর এইসব বীন সংগ্রহ এবং পরিষ্কার করা জন্য স্বয়ংক্রিয়, উচ্চ-দক্ষতাসম্পন্ন কোন যন্ত্রও নেই। এই কফির বীন পরিষ্কার করার সময়ও সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কেননা, খট্টাশের মলের সংস্পর্শে আসার ফলে এই বীন দ্বারা খাদ্য বাহিত রোগ ছড়াতে পারে। তবে কোপি লুয়াকের উদ্ভট উৎপাদন প্রক্রিয়া মানুষকে এর ব্যাপারে অনুৎসাহী করার বদলে উৎসাহী করে তুলেছে। আর নব্বইয়ের দশকে উৎপাদনকারীরা কোপি লুয়াকের মোড়কে গন্ধগোকুলের ছবি ব্যবহারের মাধ্যমে এই জনপ্রিয়তাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছেন।
এই কফির ব্যাপারে ভোক্তাদের মতামত
এখন পর্যন্ত এই লেখা পড়ে বা কোপি লুয়াকের কোন ভক্তের সাথে কথা বললে আপনার মনে হবে এই কফির চেয়ে মজাদার কোন কফি নেই। তবে এ ব্যাপারে ভোক্তাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। বিজনেস ইনসাইটস গ্লোবালএর মতে, এই কফি দাম এবং মান উভয়ক্ষেত্রেই সেরা।তবে স্পেশালটি কফি এনথুজিয়াস্টঅর্থাৎ দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা গ্রেডের কফির ভক্তদের অনেকেই এই ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। লোকাল কোল্ড ব্রিউএর সহ প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান কফি প্রস্তুতকারী স্যাম রায়োকোপি লুয়াকের ব্যাপারে স্পেশালটি কফি এনথুজিয়াস্টদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে বলেন, এই কফিকে জনপ্রিয় করেছে হলিউড। তার কমিউনিটির অনেকের মতে স্বাদের দিক থেকে স্পেশালটি কফির তুলনায় কোপি লুয়াক হীনতর। এটি কিছুটা হালকা স্বাদের, এতে অ্যাসিডিটিসহ স্পেশালটি কফির অনেক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। যারা সাধারণত কড়া এবং অ্যাসিডিক ধরণের কফি পছন্দ করে না তারা এই কফি পছন্দ করে। তবে এর উচ্চমূল্যের ব্যাপারে তারা একমত। কেননা, এর উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হয়৷ হলিউডের পাশাপাশি এর অপ্রচলিত উৎপাদন প্রণালীর ফলেই এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে বলে তাদের মত।
বিতর্ক
যেকোন অর্থকরী ফসল বা সম্পদে শিল্পপতিদের নজর পড়া আর বিতর্ক সঙ্গী হওয়ার যে রীতি, তা কোপি লুয়াকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই কফির উচ্চমূল্যের কারণে অনেকে বাণিজ্যিকভাবে এটি উৎপাদন শুরু করেন৷ এতে নানা ধরণের সমস্যা ও বিতর্কের উদ্ভব হয়।
প্রথমত, শিল্পপতিদের আগমনের ফলে মূল কোপি লুয়াক চাষীরা কাজ হারায়। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত কফি স্বাদে ও মানে অনেক পিছিয়ে। কোপি লুয়াক কফি সবচেয়ে ভালো মানের হবে যদি বন্য খট্টাশ নিজে পছন্দ করে কফি বীন খায়। কিন্তু বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয় না। তারা খট্টাশকে খাঁচায় বন্দী করে রেখে নিজেদের ইচ্ছামত বীন দেয়। এছাড়া যেসব খাঁচায় তাদের রাখা হয় সেগুলোও আকারে ছোট এবং পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। শুধুমাত্র কফি বীন ছাড়া অন্য কোন খাবার না পাওয়ায় এরা অপুষ্টিতে ভোগে। এসব ব্যাপার নিয়ে প্রাণী অধিকার সংস্থাগুলো ক্রমশ সোচ্চার হচ্ছে এবং এসব কারণে অনেকে এই কফি পান ছেড়ে দিচ্ছে। ভোক্তার সাথে প্রতারণাও হয় এই কফির ক্ষেত্রে। বন্য খট্টাশ থেকে সংগ্রহকৃত বীনের কফির কথা বলে বাণিজ্যিক কোপি লুয়াক গছিয়ে দেওয়া হয় মানুষকে।
This is a Bangla article. The article is about world’s most expensive coffee Kopi Luwak.
All the necessary links are hyperlinked. Featured images are collected from Google