টেক্সাসের রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ এবং ইউএস কংগ্রেসম্যান লুই গোহমার্টের করোনা পজেটিভ হবার খবর চাউর হয়েছিলো গত বছরের ২৯শে জুলাই। ঐদিনই এয়ারফোর্স ওয়ান (আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে বহনকারী রাষ্ট্রীয় বিমান) এ করে তখনকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরসঙ্গী হওয়ার কথা ছিলো তার। তার সহকর্মী অন্যান্য কংগ্রেসম্যানরা মাস্ক পরলেও তিনি পরতেন না।
সরাসরি মানুষকে মাস্ক না পরার জন্যে আহবান করতেন এবং কোভিড-১৯ পজিটিভ হওয়ার পরও একই কথাই বলতে থাকেন৷ করোনা পজিটিভ অবস্থাতেই তিনি ক্যাপিটল হিলে মাস্ক না পরেই আসার অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেন। এছাড়াও বলেন কোভিড-১৯ পজিটিভ হলেও এতে তার কিছুই হবে না কারণ এসব ভাইরাস থেকে তার শরীর ইমিউন।
তার কাছে প্রশ্ন করা হয়, তার মতে কেন তিনি কোভিড পজিটিভ হয়েছেন?এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি যা বলেন তাতে মাথা ঘুরে যায় অনেকের। তিনি বলেন, উনি যে কয়দিন মাস্ক পরেছেন, সেই সময় হয়তো তার মাস্কে করোনার জীবাণু প্রবেশ করে আর মাস্ক থেকেই তার নাকে নাকি করোনার জীবাণু প্রবেশ করেছে! গোহমার্টের এই যে মাস্কের ব্যাপারে অবিশ্বাস, এটি কেবল তার ব্যক্তিগত মত নয় বরং অসংখ্য সাধারণ আমেরিকান এখনও মাস্ক পরলে কোন উপকার হবে এটি বিশ্বাস করেন না।
মাস্ক ইস্যু নিয়ে পুরো দেশ ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় করোনাকালীন সময়ে। গত জুলাই মাসে মাস্ক ব্যবহারের ব্যাপারে একটি পোলের আয়োজন করা হয়। এই পোলে দেখা যায় ৯৭% অর্থাৎ, ডেমোক্র্যাটদের প্রায় সবাই-ই বাইরে গেলে মাস্ক পরেন। অন্যদিকে রিপাবলিকানদের ভেতর এই হার অনেকটা কম, ৭০%। পাবলিক হেলথ অফিশিয়ালদের বার্তা পরিষ্কার, মাস্ক পরলে কোভিড-১৯ ছড়ানোর সম্ভাবনা কমে। তাহলে সমস্যা কোথায়? কোথায় যোগাযোগ বিভ্রাট ঘটলো? কেন মাস্ক পরার মত সহজ একটা বিষয় রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হলো?
এছাড়া মাস্ক পরা লোকজনকে এখনও অ্যান্টি-মাস্কারদের (যারা মাস্ক পরতে আগ্রহী নয়) উপহাস-ট্রলেরও শিকার হতে হয় প্রতিনিয়ত।
এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য ফিরে যেতে হবে এই শতাব্দীর শুরুর দিকে। ২০০১ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র একটি ভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হয়৷ কেউ একজন সংবাদ মাধ্যম এবং সরকারী অফিসগুলোতে এনথ্রাক্সের জীবাণু সম্বলিত এনভেলপ পাঠায়। প্রথমে সেখানকার হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেস এর সেক্রেটারি টিভিতে অন এয়ারে প্রথম রোগীর মধ্যে কিভাবে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমিত হয়েছে সেটি অনুমান করতে গিয়ে বলেন, “তিনি (প্রথম রোগী) সম্ভবত কোন নদী বা ধারা থেকে পানি পান করেছিলেন।”উপস্থিত এক সাংবাদিক সাথে সাথে প্রশ্ন তোলেন, “আপনি এই তথ্য আমাদেরকে কেন জানাচ্ছেন?”উত্তরে সেক্রেটারি বলেন, “কারণ আক্রান্ত ব্যক্তি নিয়মিত বাইরে যেতেন এবং তখন পানি পান করার ফলে তিনি এটিতে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন।”তখন আরেক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, “তাহলে অ্যানথ্রাক্স কি নদী বা জলাশয়ের পানির মাধ্যমে ছড়ায়?”সেক্রেটারি তার জবাবে বলেন, “আমরা এখনও জানি না। যেকোন কিছুই হতে পারে।”
এই ক্রাইসিস যত দীর্ঘতর হয়, ততই সরকারী কর্মকর্তারা একের পর এক পরস্পর বিরোধী বক্তব্য রাখতে থাকেন। কেউই জনগণের সাথে যোগাযোগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন না। ফলে সবাই একই বিষয়ে বিভিন্ন বক্তব্য রাখছিলেন এবং এতে করে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। জনগণও ঠিক করতে পারে না আসলে কার কথা বিশ্বাস করবে। এই ঘটনার পর সেদেশের সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) যেকোন ধরণের মহামারীর সময় ব্যবহারের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। এটি সার্ক (CERC – Crisis & Emergency Risk Communication) নামে পরিচিত।
সিডিসি’র প্রাক্তন চিফ অফ মিডিয়া রিলেশন্স গ্লেন নোয়াকের মতে, এই নীতিমালা হলো অ্যানথ্রাক্সের ফলে সৃষ্ট সংকটকালীন সময়ে তারা যা শিখেছিলেন তার প্রতিফলন। সিডিসি’তে কর্মরত থাকা অবস্থায় উনি সার্ক ব্যবহার করেছিলেন এমনকি এর কিছু অংশ লিখেছিলেনও।
তিনি বলেন, অ্যানথ্রাক্স বিপর্যয়ের সময় তারা নানা শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। আর এক্ষেত্রে প্রাপ্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বলে বিবেচনা করা হয় যে বিষয়টিকে, সেটি হলো একজন নির্দিষ্ট মুখপাত্র থাকা। নির্দিষ্ট একজন মুখপাত্রের কাছ থেকে সব তথ্য পেলে জনমনে বিভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকে না। এবং এই বিষয়টিই মহামারী নিয়ন্ত্রণে অনেকটা এগিয়ে দিতে পারে একটি দেশ বা জাতিকে।
সার্কের নীতিমালা অনুযায়ী মুখপাত্র হতে হবে এমন একজনকে যিনি ঐ বিষয়ের সাথে পরিচিত এবং এই ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলতে সক্ষম। জনগণের স্বাস্থ্যবিষয়ক দূর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার নিয়ন্ত্রণ, কতটুকু তাদের আশা করা উচিত, কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে কি করছে, বর্তমানে কি অবস্থা, কবে নাগাদ দূর্যোগ থেকে পুরোপুরি মুক্তি মিলবে এসকল বিষয়ে মানুষকে পরিষ্কারভাবে জানানোর ভূমিকা অপরিসীম। এক্ষেত্রে মুখপাত্র যেসব ব্যাপারে জানেন এবং যেসব ব্যাপারে জানেন না উভয়দিকই পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে। মোটকথা, মুখপাত্রকে হতে হবে বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য।
আর ঠিক এই কারণেই দূর্যোগের সময়ে কোন রাজনীতিবিদের দূর্যোগ মোকাবেলা কমিটির মুখপাত্র হওয়া উচিত না। কারণ সব মানুষের কাছে একজন রাজনীতিবিদের গ্রহণযোগ্যতা সমান নয়। সবাই তাকে সমানভাবে বিশ্বাসও করে না। যারা তাকে ভোট দিয়েছেন, তার সমর্থক; তাদের কাছে তিনি বিশ্বাসযোগ্য আছেন এবং থাকবেন। কিন্তু বিরোধীদের কাছে তার দেওয়া তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নাও হতে পারে।
তারমানে এই না যে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কোন কমিটিতে কোন রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের থাকা উচিত না, কেবল তাদের মুখপাত্র বা দলনেতা হওয়া থেকে দূরে থাকা উচিত। দলনেতা বা মুখপাত্র হবার দায়িত্ব নেওয়া উচিত বিজ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তির।
করোনাকালে এই ধরণের নীতিমালা যথাযথভাবে মেনে কাজ করেছে এমন একটি দেশের উদাহরণ হলো নিউজিল্যান্ড। সেখানে করোনা বিষয়ক অনেকগুলো প্রেস ব্রিফিং এ অংশগ্রহণ করেছেন প্রেসিডেন্ট জেসিন্ডা আর্ডেন কিন্তু তিনি ঐ দলের নেতৃত্বে বা মুখপাত্র হিসেবে ছিলেন না। করোনাকালীন সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ভারতের কেরালা রাজ্যের ভূমিকাও প্রশংসনীয়।
আরো পড়ুনঃ
পাইলট থেকে ট্রাক ড্রাইভার-এয়ারলাইন ক্যারিয়ার কোভিড-১৯ মহামারী দ্বারা যে ভাবে ধ্বসে গেলো
এই ধরণের প্রেস ব্রিফিংয়ের মূল লক্ষ্য হলো সবাই যেন দেশে কি হচ্ছে তা জানতে পারে এবং একই ধরণের তথ্য পায়৷ কিন্তু আমেরিকাতে যেসব প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়, সেগুলোতে পরিষ্কারভাবে কে মুখপাত্র বা কি ধরণের বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছাচ্ছে তা পরিষ্কার ছিলো না। প্রেস ব্রিফিং এ দলনেতা ছিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওনার সাথে প্রেস ব্রিফিং এ জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গও উপস্থিত ছিলেন৷ তাদের বক্তব্য ছিলো পরস্পর বিরোধী এবং বিভ্রান্তিকর। এছাড়া জনগণের কি আশা করা উচিত তা পরিষ্কারভাবে জানানো হয় নি। যেমন : বিশেষজ্ঞ হয়তো বললেন আরো পজিটিভ কেস আসবে কিন্তু প্রেসিডেন্ট বললেন আর পজিটিভ কেস আসবে না। বা বিশেষজ্ঞ বললেন করোনা আবারও হতে পারে, সেকেন্ড ওয়েভ আসতে পারে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বললেন সেকেন্ড ওয়েভ আসবে না, আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়বে না। এ ধরণের বিভ্রান্তি প্রায় দূর্যোগের সময়ই দেখা যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।
এইসমস্ত বিভ্রান্তিকর তথ্যের ফলে আমেরিকার জনগণ দুটি প্রশ্নের সামনে নিজেদের আবিষ্কার করলো। কাকে বিশ্বাস করবে তারা? প্রেসিডেন্টকে নাকি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের?
আর সাথে সাথে সংবাদ মাধ্যমও বিভক্ত হয়ে পড়লো। কেউ ট্রাম্পকে আর কেউ বিশেষজ্ঞদের সমর্থন করা শুরু করলো। আর এটিই আগুনে ঘি ঢাললো। মানুষ মিডিয়ার কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের তথ্য পাচ্ছিলো।
এছাড়া যেকোন নতুন রোগ সম্পর্কে যত দিন যায় নতুন নতুন তথ্য জানা যায় গবেষণার মাধ্যমে। সিডিসি মহামারীর প্রথমদিকে এপ্রিলের ৩ তারিখে লোকজনকে জানায় মাস্ক না পরলেও চলবে, করোনা আক্রান্ত হলে অবশ্যই লক্ষণ দেখা যাবে। কিছুদিন পর তারা আবার বললো মাস্ক পরলে করোনা ছড়াবে না, উপসর্গবিহীনভাবেও লোকজনেরও করোনা হতে পারে।
ট্রাম্প এবিষয়ে বললেন, মাস্ক পরলে ইচ্ছা, না পরলেও ইচ্ছা৷ কোন বাধ্যবাধকতা নেই। উনি পরবেন না৷কিন্তু তারপরই মাস্ক পরিধনের উপকারীতার কথা জানতে পারলো সিডিসি এবং দেশের মানুষকে মাস্ক পরার আহবান জানালো।
শীঘ্রই মাস্ক পরা আর না পরা নিয়ে ট্রাম্প বনাম বিশেষজ্ঞ দ্বন্দ্ব বেধে গেল। ট্রাম্প সমর্থকরা বরাবরের মতোই তাকে সমর্থন দিলো। তাদের মতে মাস্ক পরতে হবে এটি রাজনৈতিক স্বার্থে সৃষ্টি করা গুজব। এমনকি মাস্ক যারা পরে তাদের লজ্জা থাকা উচিত বলেও তারা মনে করে। বিশেষজ্ঞদের একহাত নিতেও ছাড়ে নি তারা। বিশেষ করে ডক্টর অ্যান্থনি ফাউচি তাদের তোপের মুখে পড়েন মাস্ক পরার কথা বলে। তাদের মতে তিনি নিজের মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে প্রোপাগাণ্ডা ছড়াচ্ছেন।
এছাড়া ট্রাম্প মাস্ক না পরায় এবং লোকজনকে পরতে বাধ্য না করায় ওনাকে ২০২০ সালের নির্বাচনেও ভোট দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তারা। মাস্ক পরতে বাধ্য করাকে তাদের অধিকার হরণের চেষ্টা বলেও মনে করেন অনেকে। তাদের মনে এই ধারাণাও জন্মে যে একমাত্র ডোনাল্ড ট্রাম্পই পারবেন তাদের সকল ধরণের অধিকার রক্ষা করতে। জুন মাস নাগাদ বেশিরভাগ রিপাবলিকান করোনা সংক্রান্ত তথ্যের ব্যাপারে সিডিসি থেকে ট্রাম্পকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য ভাবা শুরু করেন। দেশজুড়ে মাস্কার আর অ্যান্টি মাস্কারদের মাঝে লেগে যায় গন্ডগোলও। আর এই ধরণের পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়, সেজন্যেই কিন্তু রচনা করা হয়েছিলো সার্কের নীতিমালা। কিন্তু বিফলে যায় সবই।
২০০১ সালে কোনভাবে তারা অ্যানথ্রাক্স থেকে রক্ষা পেয়েছিলো কিন্তু এবার পুরো বিশ্বের মত তারাও কখন করোনা থেকে মুক্তি পায় তার কোন ঠিক নেই। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতোমধ্যেই শপথ নিয়ে ফেলেছেন। ক্ষমতায় এসে তিনি জনগণকে ১০০ দিনের মধ্যে ১০ কোটি ডোজ কোভিড-১৯ এর ভ্যাক্সিন দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, নিজেও নিয়েছেন। এই ভ্যাক্সিন নেওয়ার ব্যাপারেও মানুষের মধ্যে অনীহা দেখা যাচ্ছে আমেরিকানদের মধ্যে। করোনায় প্রথমদিকে খুবই জর্জরিত অবস্থায় থাকা স্পেনেও জনগণের মাঝে ভ্যাক্সিন নেওয়ার ব্যাপারে অনীহা দেখা গেছে। দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়। দুনিয়া থেকে কখন এই ভাইরাস পুরোপুরি চলে যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর এখন কেবল সময়ের হাতে।
This is a Bangla Article. Here, everything is written “How Mask became an election issue in USA “
All links are hyperlinked.
Featured image taken from Google