জীবনের কঠিন সময়ের মুখোমুখি হলে আমরা একটা কথা প্রায়ই বলি, “ইচ্ছা করছে সব ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাই’। মাঝে মাঝে মনে হয় যদি জীবন বিক্রি করে সব আশা পূরণ করা সম্ভব হতো ! কিন্তু সবারই পিছুটান থাকে তাই সেটা বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু সেটা বাস্তবেই করে দেখালেন ইয়ান উশার নামের এই মানুষটি।
অনলাইন নিলামঘর ই-বেতে অদ্ভুত সব কিছু বিক্রির জন্য হাজির হয় অসংখ্য মানুষ। তেমনি ২০০৮ সালের মার্চে একটি বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেরই চক্ষু চড়াকগাছ। ‘সূলভমূল্যে কিনে নিন একজন মানুষের জীবন। সীমিত সময়ের এই সূযোগে মালিক হয়ে যান তার সব কিছুর। কেউ কি আগ্রহী আছেন? তাহলে যোগাযোগ করুন- ইয়ান উশার, পার্থ, অস্ট্রেলিয়া।’
“জীবন বিক্রি”, অন্যরকম এই বিজ্ঞাপনের কারণে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান বিজ্ঞাপনদাতা। যারাই তার এই বিজ্ঞাপন দেখেছেন সবার মনেই প্রশ্ন তিনি কেন এমন বিজ্ঞাপন দিলেন? কী তার পরিচয়?
ইয়ান উশারের জন্ম ইংল্যান্ডের ডারলিংটনে। বেড়ে উঠেছেন বানার্ড ক্যাসেল এলাকায়। লিভারপুলের একটি কলেজ থেকে নিয়েছিলেন ব্যাচেলর ডিগ্রি। ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসতে ঘুরতে। কিন্তু কেন যেন তিনি কোথাও কখনো স্থির হতে পারতেন না। কাবুটাজ নামের এক সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত হয়ে ১৮ বছর বয়সে চলে যান ইসারাইল। সেখান থেকে আবার ইংল্যান্ডে ফিরে এসে কিছুদিন কাজ করেন রেলওয়েতে। কিছুদিন পর সেই চাকরি ছেড়ে দেন, তারপরে আবার বেশ কয়েকবার চাকরিবদল করেছেন। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তিনি ঘুরে বেড়ান আর জেট স্কি ব্যবসা চালু করেন তার প্রিয় বন্ধু ব্রুসের সাথে। তেমনি ১৯৯৩ সালে একদিন এক সমুদ্রসৈকতে তার সাথে পরিচয় হয় লরা হ্যানককের। প্রণয়ের পর ২০০০ সালে বিয়ে করে দুজনে ঘর বাঁধেন অস্ট্রেলিয়ার পার্থে।
সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন এই দম্পত্তি। একটি কার্পেটের দোকানে চাকরি নেন উশার এবং সানগ্লাসের ব্যবসা শুরু করেন লরা। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ছিলেন ভ্রমণপিয়াসী। সুযোগ পেলেই দুজনেই বেরিয়ে পড়তেন বিশ্বভ্রমণে। কিন্তু সেই সংসার টিকলো না শেষ পর্যন্ত। ২০০৬ সালে বিবাহবিচ্ছেদের পর একেবারেই ভেঙ্গে পড়েন উশার। অনেক চেষ্টা করেছেন স্ত্রীকে ফেরানোর কিন্তু সফল হননি। সেই ব্যাথা বুকে নিয়ে কাটিয়ে দেন দুইটি বছর। কাজ কিংবা ব্যাক্তিগত জীবন কিছুতেই মন দিতে পারছিলেন না। আগের চাকরি ছেড়ে তিনি চলে যান খনিতে, সেখানে ট্রাক চালকের কাজ নেন। কিন্তু বাসায় ফিরলেই চারপাশের সব কিছুতেই তিনি তার সাবেক স্ত্রীর ছোয়া দেখতে পাচ্ছিলেন শুধু। খনিতে কাজ করার ফাকে যে সময় তিনি পেলেন তাতেই তিনি একসময় বুঝতে পারলেন এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না।
শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন তিনি সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করবেন। তার জন্য তাকে যা করতে হবে তা হল এখন তার কাছে যা আছে সব ছেড়ে দেয়া। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তার যা কিছু আছে তিনি সব তিনি বিক্রি করে দিবেন!, তিন বেডরুমের বাসার সাথে সব ফার্নিচার, স্পা রুম, মাদজা গাড়ি, কাওয়াসাকি মোটরবাইক, জেটস্কি এবং প্যারাস্যুটের জিনিসপত্র সব তিনি বিক্রি করে দিবেন। একসময় তার মনে হলো তিনি সবকিছুকেই একটি গোটা প্যাকেজ আকারে বিক্রি করতে পারবেন। তিনি বাড়ি, গাড়ির পাশাপাশি যে চাকরি করতেন তা, তার বন্ধুদের বন্ধুত্ব, তার নেশা। তারমানে তিনি শুধু তার বাহ্যিক সম্পদ বিক্রি করবেন না, তিনি তার গোটা জীবনটাই বিক্রি করে দিতে পারবেন! অর্থাৎ যিনি সবকিছু কিনবেন তিনি যেন পার্থে ইয়ান উশারের জীবন নিজেই উপভোগ করতে পারবেন।
যে ভাবা সেই কাজ। তিনি তার আরেক বন্ধু মিলে একটি ওয়েবসাইট নির্মাণ করলেন যার নাম ‘A Life For Sale’। তিনি সবকিছু নিলামে তুলতে চাইলেন, যার জন্য ই-বের চাইতে উপযুক্ত আর কিছুই হতে পারে না। এরপর তিনি দিলেন সেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপন, ‘একটি জীবন বিক্রি হবে।’ তার আরেক বন্ধু স্থানীয় পত্রিকায় এই নিয়ে একটি সংবাদ ছাপান। ব্যাস! এরপরেই রাতারাতি বিখ্যাত বনে যান তিনি। স্থানীয় রেডিও, টিভিতে সাক্ষাতকারের পাশাপাশি তার ডাক পড়ে ইউরোপ আমেরিকার টিভি চ্যানেলগুলোতেও। সব জায়গাতেই তিনি একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হন, যা নিয়ে তিনি আগে কখনোই ভাবেননি, জীবন বিক্রির পর তিনি কী করবেন?
ইয়ান উশার একটি তালিকা করা শুরু করেন তার জীবনের সব ইচ্ছা নিয়ে। তিনি জীবনে যা কিছু করতে চান, তার যত অপূর্ণ ইচ্ছা আছে সব তিনি এই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা শুরু করেন। তারপর সেই তালিকা যখন ১০০ পুর্ণ হল তারপর তিনি ভাবলেন এই ১০০টি ইচ্ছা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনি পূরণ করবেন। ১০০ মাস? অনেক বেশি সময়। ১০০ দিন? অনেক কম সময়। তাহলে ১০০ সপ্তাহ? হ্যাঁ, তাহলে তিনি ১০০ সপ্তাহে তার ১০০ টি ইচ্ছা পূরণে নামবেন।
উশারের আশেপাশের মানুষরাও বেশ আগ্রহী ছিল এই নিলাম নিয়ে। তার সাথে কার্পেট দোকানে চাকরি করা তার বন্ধু জয় জোন্স বলেন,
বিবাহবিচ্ছেদের পর আমরা দেখেছি ইয়ান ঠিক কতটা ভেঙ্গে পড়েছিল। তাই সে যখন তার এই আইডিয়া নিয়ে হাজির হয় আমরা সবাই ভাবলাম, কেন নয়? একটা সূযোগ দেয়াই যায়। আমরা অনেক আগ্রহী এই বিষয়টি নিয়ে।
ইয়ান উশার নিজেও বেশ উত্তেজিত ছিলেন এই নিলামটি নিয়ে। বিজ্ঞাপন দেয়ার অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ সাড়া ফেলে। এতটা সাড়া ফেলবে তিনি তা কল্পনাও করেন নি। তিনি বলেন,
আমি শুধু চেয়েছিলাম যেদিন সব বিক্রি হবে, আমি ঘরের দরজা দিয়ে এক পকেটে আমার ওয়ালেট আরেক পকেটে আমার পাসপোর্ট নিয়ে বের হয়ে যাব ইচ্ছাপূরণে। এর চাইতে বেশি আর কিছুই আমার চাওয়া নেই।
অনেক ক্রেতাই অংশ নেয় তার এই নিলামে। এর মধ্যে অনেকেই অবশ্য মজার ছলে অহেতুক দাম ডেকে বসেন। কিন্তু সব শেষে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি কিনে প্রায় চার লক্ষ ডলারে কিনে নেন তার সব কিছু।
ব্যাস! ইয়ান উশার নিজের সব কিছু বিক্রি করে কাঁধে ব্যাগ আর পকেটে পাসপোর্ট, ক্রেডিট কার্ড নিয়ে চলে যান এয়ারপোর্টে এবং সেখান থেকে সরাসরি দুবাই। দুবাইয়ে বিশ্বের সবচাইতে বড় ইনডোর বরফের রিসোর্টে কইয়েকদিন কাটান। তারপর চলে যান ফ্রান্স। সেখানে তিনি আকাশ থেকে প্যারাস্যুট নিয়ে লাফ দেন, উঠেন আইফেল টাওয়ারে। গেলেন লন্ডন, যেখানে তিনি চলন্ত বিমানের ডানার উপর হাঁটলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায় গিয়ে হাতের উপর রেখে বাজপাখিকে খাবার খাওয়ালেন।শিখলেন লস অ্যাঞ্জেলসের ফায়ার ক্লাবে আগুন খেলা। ঘুরলেন গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে। জাপান গিয়ে বাইক চালালেন ওয়াল অব ডেথে, ঘুমালেন বিখ্যাত ক্যাপসুল হোটেলে। নেপাল গেলেন, যেখানে ঘুরলেন মাউন্ট এভারেস্টের পাদদেশে। শিখলেন ফরাসী এবং স্প্যানিশ ভাষা। রপ্ত করলেন হেলিকপ্টার এবং প্লেন চালানো।
আরো পড়ুনঃ
হঠাৎ মানুষ বিলুপ্ত হয়ে গেলে কী ঘটবে পৃথিবীতে?
আন্দেজ পর্বতমালায় নিখোঁজ এক বিমানের অমীমাংসিত রহস্য
কানাডায় গিয়ে মো নামক এক নারীর সহায়তায় কুকুর টানা স্লেজ গাড়িতে চড়ার সুযোগ হয়। তারপর দূজনে মিলে ঘুরে এলেন জ্যামাইকা এবং কোস্টারিকা। দুই বছরে তিনি পা দিয়েছেন ছয়টি মহাদেশে। দেখা হলো হাজার হাজার মানুষের সাথে। তিনি তার আনন্দ প্রকাশ করে বলেন,
এই দুই বছর ঠিক কিভাবে যে চোখের পলকে চলে গেলে নিজেও বুঝতে পারলাম না। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন আইফেল টাওয়ারে উঠেছিলাম বা সেদিনই হিমালয়ের কোলে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর আমি তুলেছি অসংখ্য ছবি, যা ১ সেকেন্ডে একটি করে দেখলেও আপনার চল্লিশ মিনিট সময় লাগবে।
১০০ সপ্তাহে ১০০ টি ইচ্ছা পূরণ সম্ভব হলো না অবশেষে। কিন্তু এই নিয়ে আক্ষেপ নেই তার। ৯৩ টি ইচ্ছা পূরণের পর পানামা উপকূলের বোকাস ডেল টোরো প্রদেশে দুই দশমিক দুই একরের একটি দ্বীপ কিনে সেখানেই তিন বছর দারুণ একটি রোমাঞ্চকর সময় কাটান তিনি। লিখে ফেলেন নিজের এই অসাধারণ অভিজ্ঞতা নিয়ে বই।
আমি মতে, আমরা সবাই জীবনে একটা জিনিস চাই, সুখী হতে। আমার সত্যি বিশ্বাস করি যে সঠিক লক্ষ্য স্থাপন এবং সেই উদ্দেশ্যে কাজ করে গেলেই আমরা সুখের সন্ধান পেতে পারি।
২০১৩ সালে নতুন এই জীবনে তার দেখা নতুন ভালোবাসা ভেনেসার সাথে। ২০১৪ সালে ইয়ান বিক্রি করে দেন সেই দ্বীপ। তারপর থেকে দুইজনের কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই। তারপর দুজন মিলে ২৩ টি দেশ ঘুরে এখন আছেন ফ্রান্সে। এদিকে ডিজনি তার বইয়ের স্বত্তাধিকার কিনে নিয়েছে এবং তারা বইটির আলোকেই একটি সিনেমা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।
তার অন্যতম ইচ্ছা ছিল অস্ট্রেলিয়াতে ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। কারণ তার বাবা ১৯৯৪ সালে ক্যান্সারে মারা যান। এই ইচ্ছা পূরণ হলে তিনি তার ১০০ ইচ্ছা পূরণের আরেক ধাপ এগিয়ে যাবেন।
চলুন দেখে নেই ইয়ান উশারের সেরা কিছু ইচ্ছা:
১। স্পেনের টমেটো উৎসবে অংশগ্রহণ।
২। দক্ষিণ আফ্রিকায় খাচাবন্দি হয়ে হাঙরের সাথে সাঁতার কাটা।
৩। আগ্রার তাজমহল দর্শন।
৪। চীনের মহাপ্রাচীরে হাঁটা।
৫। স্পেনের ষাড়ের লড়াই দেখা।
৬। ইতালিতে সাগরের নীচে যীশুকে দেখা।
৭। পেরুর মাচুপিচু দর্শন।
৮। ফ্রান্সের আল্পস পর্বতে প্যারাসুট দিয়ে নামা।
৯। হাওয়াইয়ে জীবন্ত আগ্নীয়গিরি দেখা
১০। আইসল্যান্ডের হিমশৈল দর্শন
It’s a Bangla Article. Here, everything is written about IAN USHER and his life story.
All reference links are hyperlinked.
Featured image taken from Google