তুরস্কের সামরিক ইতিহাস নিয়ে লিখিত আমাদের দুই পর্বের ধারাবাহিক সিরিজের আজকে দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে আলোচনা করব। বর্তমানে তুরস্ক বিশ্বের একটি শক্তিশালী এবং পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু আজকের এই শক্তিশালী তুরস্ক গঠনের পথ এত সহজ ছিল না। বারবার হোঁচট খেয়েছে তুরস্কের গণতন্ত্র, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। এভাবেই এগিয়ে গেছে আধুনিক তুরস্ক। তো চলুন জেনে নেয়া যাক তুরস্কের সামরিক অভ্যুত্থানের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে।
১৯৮০ সালের সামরিক অভ্যুত্থান
১৯৮০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, ভোরের আলো তখনও ভালোভাবে ফুটতে পারেনি। ঘড়ির কাঁটায় ৪:৩০ বাজে তখন। ঠিক সেই সময় সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে দেশে সেনাশাসন জারির ঘোষণা দেওয়া হলো। তৃতীয়বারের মতো ধাক্কা খেল তুরস্কের গণতন্ত্র। সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে।
অভ্যুত্থান ঘটানোর কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় গণগ্রেফতার। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর সভাপতি, সেক্রেটারিসহ কেন্দ্রীয় নেতারা কেউই বাদ পড়েনি। তৃণমূল পর্যায় থেকে সকল নেতৃত্ব বাতিল করা হয়। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান বিশেষ করে মিউনিসিপালিটির মেয়র ও মিউনিসিপালিটি পার্লামেন্টের সদস্যদেরকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এভাবেই কেন্দ্র ও স্থানীয় সকল পর্যায়ে সেনাবাহিনীর একচ্ছত্র প্রভাব সৃষ্টি হয়।
এই অভ্যুত্থানের পর গণগ্রেপ্তার এত বেশি পরিমাণে ছিল যে রীতিমত দেশকে ভয়ে প্রকম্পিত করে তোলে। প্রথম মাসেই গ্রেফতার করা হয় ৩০ হাজার লোককে। এক বছর পর সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১,২২,৬০০ তে। তবে এই ধাক্কায় উগ্রপন্থী গ্রুপগুলো বেশ শক্তভাবে দমন-পীড়নের শিকার হয়েছিল। সব মিলিয়ে, ১৯৮০ সালের অভ্যুত্থান তুরস্কের রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়।
লক্ষনীয় ব্যাপার হচ্ছে, তুরস্কের সামরিক বাহিনী সবসময় বামপন্থী বা সেক্যুলারপন্থী দলগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও এ যাত্রায় তারাও রক্ষা পায়নি। যদিও গতানুগতিক ধারায় এইবারও ডানপন্থী দলগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
১৯৯৭ সালের সামরিক অভ্যুত্থান
১৯৯৫ সালে তুরস্কের সাধারণ নির্বাচনে ইসলামপন্থী রেফা পার্টি ২১.৪% ভোট পেয়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়। রেফা পার্টির প্রধান ছিলেন ড. নাজিমুদ্দিন এরবাকান। ব্যক্তি হিসেবে ড. নাজিমুদ্দিন এরবাকান ছিলেন কট্টোর ইসলামিক। রেফা পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও অন্যান্য দলগুলোর প্যাঁচে সরকার গঠন করতে সক্ষম হলো না। পরবর্তীতে অন্য দলগুলো টিকতে না পারায় রেফা পার্টি তৃতীয় প্রধান দলকে সাথে নিয়ে সরকার গঠন করে।
১৯৯৬ সালের ২৮ জুন রেফা পার্টি ও দরয়ু ইয়ুল পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। কামাল আতাতুর্কের সেক্যুলার তুরস্কের ইতিহাসে সর্বপ্রথম একটি ইসলামপন্থী সরকার ক্ষমতায় এলো। স্বাভাবিকভাবেই সেনাবাহিনী এটা ভালো চোখে দেখল না। কারণ তুরস্কের সেনাবাহিনীর বিশাল একটা অংশ কামালপন্থী সেক্যুলারবাদে বিশ্বাসী। ইতিপূর্বে ডানপন্থী সরকারগুলোকে তারা ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি আর এবার তো স্বয়ং ইসলামিস্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তুরস্কের সামরিক বাহিনীর নীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। এই জন্য ইসলামিক সরকারের প্রত্যেকটি পদক্ষেপেই তারা নাক ছিটকাতে শুরু করল।
এসবেরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মিটিংয়ে দীর্ঘ বৈঠকের পর সেনাদের পক্ষ থেকে ১৮টি শর্ত দেয়া হয়। এ শর্তগুলো ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব টিকিয়ে রাখতে বেশ কিছু বিষয় বাস্তবায়নের দাবী। এই দাবীগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো, ৮ বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষা চালু করা, মাদরাসা বন্ধ করা, কুরআন কোর্স সীমিত করা, ইউনিভার্সিটিতে হিজাব নিষিদ্ধ করা, ইসলামপন্থী জামায়াতের (অরাজনৈতিক সংগঠন) কাজগুলো বন্ধ করা ইত্যাদি।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী ড. নাজিমুদ্দিন এরবাকান সেনাদের দাবীতে সাক্ষর না করে অন্যান্য দলগুলোর সমর্থন চান। কিন্তু কোনো দলই তাকে সমর্থন দেয়নি। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে সেক্রেটারি জেনারেল জানান, এই দাবীগুলো যদি মেনে নেওয়া না হয় তাহলে সামরিক অভ্যুত্থানের অনুমোদন দেওয়া হবে। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী এরবাকান দাবীগুলো মেনে নেন। সেনাবাহিনীকে দাবীগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাসও দেন।
কিন্তু ৩১ মার্চে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মিটিংয়ে সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান বলে বসেন যে, এরবাকান সরকারকে সরিয়ে দেওয়ায় তাদের প্রথম লক্ষ্য। তিনি উল্লেখ্য করেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সেনাবাহিনীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। ২১ মে সাংবিধানিক আদালতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মূলনীতি লঙ্ঘনে রেফা পার্টি বন্ধের ব্যাপারে মামলা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮ জুন ড. নাজিমুদ্দিন এরবাকান প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে মেসুত ইলমাসের নেতৃত্ব কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। পরোক্ষভাবে ক্ষমতা চলে যায় সেনাবাহিনীর হাতে।
২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থান
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তখন মারমারিসের একটি হোটেলে অবকাশ যাপনে ছিলেন। হঠাৎই খবর এলো সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। সামরিক বাহিনীও ঠিক এই সময়ইটিকেই কাজে লাগিয়েছে। যদিও এই অভ্যুত্থানে জনতার সামনে টিকতে পারেনি বিদ্রোহী সেনারা। সেদিনের সেই অভ্যুত্থান যদি ব্যর্থ না হত তাহলে তুরস্কের গণতন্ত্রের জন্য আরেকটি কালো অধ্যায় সৃষ্টি হত। এই অভ্যুত্থানের পেছনের গল্পও ভিন্ন ছিল না। বরাবরের মত এবারও যে বিষয়টি সামনে এসেছে সেটা হচ্ছে তুরস্কের সেনাবাহিনীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে ক্ষমতাচুত্য করতেই এই অভ্যুত্থান ঘটায় সেনাবাহিনী। সেক্যুলার তুরস্কে এরদোয়ান সরকারের কার্যক্রম ভালো চোখে দেখছিল না সেনাবাহিনী। অনেকেই মনে করেন ড. নাজিমুদ্দিন এরবাকানের দেখানো পথেই হাটছেন এরদোয়ান। এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পর বন্ধ থাকা মসজিদগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে, নারীদের হিজাবের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, মাদরাসা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে, কুরআন কোর্স বৃদ্ধি করা হয়েছে। পশ্চিমাপন্থী তুরস্কের জনগণের বিশাল একটা অংশ এটাকে সহজভাবে নেয়নি।
সেদিন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান মাত্র কয়েক মিনিটের একটি ভিডিও বার্তায় জনগণের উদ্দেশ্যে যে ঐতিহাসিক আহবান জানান তা সেদেশের ইতিহাসে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেই আহবান শুনে তুরস্কের নিরস্ত্র জনগণ ট্যাংকের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে নজীর বিহীন ঘটনা। সেই ভাষণের কিছু অংশ ছিল এমন-
আজকের এই অভ্যুত্থান সামরিক বাহিনীর একটি ছোট দলের বিদ্রোহ। আমি বিশ্বাস করি, জনগণ এই ষড়যন্ত্রের যথোপযুক্ত জবাব দেবে। জনগণের টাকায় কেনা ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার নিয়ে জনগণের পর আক্রমণের খুব বড় ক্ষতিপূরণ তাদেরকে দিতে হবে। আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ও প্রধানমন্ত্রী সরকারের প্রধান হিসেবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। দৃঢ়ভাবেই ময়দানে দাঁড়াব। ময়দান তাদের হাতে ছেড়ে দেব না।
জনগণকে একটি আহ্বান করছি। সবাইকে প্রদেশগুলোর ময়দানে আসতে আহ্বান জানাচ্ছি। বিমানবন্দরে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। সেই সংখ্যালঘু বিদ্রোহীরা ট্যাঙ্ক কিংবা অন্য যা কিছু নিয়ে আসুক, জনতা তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। জনতার শক্তির চেয়ে বড় কোনো শক্তি আমি আজ অবধি দেখিনি।
১৫ই জুলাইয়ের এই অভ্যুত্থান যেভাবে জনতা রুখে দিয়েছে এতে করে ক্ষমতার উপর এরদোয়ানের অবস্থান আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। অভ্যুত্থানের পরপরই বৈশ্বিক মিডিয়া যে বিষয়টি উঠে আসে সেটা হল গুলেন মুভমেন্ট। ফেতুল্লাহ গুলেনের নেতৃত্বেই এই অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অনেকেই আবার মনে করেন, এই অভ্যুত্থানের পেছনে পশ্চিমা দেশগুলোর মদদ রয়েছে।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বামপন্থী দলগুলো এরদোয়ান সরকারের কাজে সন্তুষ্ট না থাকলেও সামরিক অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেনি। বরং, সংসদের জরুরি অধিবেশনে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় এরদোয়ানকে সমর্থন করে। বামপন্থী ও ডানপন্থী দলগুলোর এই একতা তুরস্কের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
গণতন্ত্রিক দেশগুলোতে বিভিন্ন ইস্যুতে প্রায়ই সামরিক অভ্যুত্থানের খবর শোনা যায়। কিন্তু তুরস্কের ক্ষেত্রে প্রতিটি অভ্যুত্থানের পেছনের গল্প অনেকটাই এক। আর সেটা হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। এই অভ্যুত্থানের ফলে বার বার হোঁচট খেয়েছে তুরস্কের গণতন্ত্র, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ডানপন্থী সরকারের কার্যক্রম। কিন্তু ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে তুরস্কের গণতন্ত্র। এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে নতুন তুরস্কের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা।
This is a bengali article. It about history of turkey army coup ‘part-2’
All the reference are hiperlinked in within article
Feature Image: Al Jazeera