রমাদান হলো মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র মাস। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে এই মাসটি অতিবাহিত করেন মুসলমানরা। রমাদান মাসের নান্দনিক পর্বগুলোর মধ্যে ইফতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। সারাদিন রোযার শেষে ইফতারের টেবিলে তৈরি হয় নতুন উদ্দীপনা। প্রতিদিনের ছাপোষা রুটিনকে পেছনে ফেলে রমাদান মাসে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আসে অনেক পরিবর্তন। এর মধ্যে থাকে ভোর রাতে উঠে সেহরি খাওয়া, সারাদিন কাজের পাশাপাশি ধর্মীয় কাজকে প্রাধান্য দেয়া এবং সংযমী জীবন যাপন করা, সন্ধ্যে বেলা পরিবার বা বন্ধুদের সবার সাথে মিলে ইফতার করা, ইফতার শেষে তারাবীহ পড়া ইত্যাদি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইফতারের রয়েছে বৈচিত্র্যতা। আর এই বৈচিত্র্যতা নিয়েই আজকে আমরা জানার চেষ্টা করব।
সৌদি আরব
ইসলামের পূণ্যভূমি সৌদি আরব। ধর্মের উৎপত্তি যেখানে, ধর্মীয় আচারাদির বৈচিত্র্যতা সেখানে বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আছেও তাই। রোযার মাসে সৌদি আরবের বেশিরভাগ অফিস আদালতই ছুটি থাকে। সৌদিরা সাধারণত ইফতারের পর সেহরি পর্যন্ত জেগে থাকে। তাই সৌদি ইফতারের আয়োজনটাও হয় অনেক জাঁকজমকপূর্ণ। পুষ্টিকর খাবারে পরিপূর্ণ সৌদি ইফতারে থাকে উন্নত মানের খেজুর, ভিমতো (আঙ্গুর রসের শরবত), লাবান, বিভিন্ন ধরনের স্যুপ, তামিজ (একধরনের রুটি), বোরাক (মাংসের পিঠা), মানডি (মুরগী ও ভাত দিয়ে তৈরি এক ধরনের খাবার) অথবা ভেড়া/মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি খাবসা।
তুরস্ক
ইসলামের ইতিহাসে তুরস্কের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের চতুর্থ খিলাফত অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল এই তুরস্ককে কেন্দ্র করেই। রংয়ে ঢংয়ে আর বৈচিত্র্যতায় রমাদান মাসটা তুরস্কে বেশ উপভোগ্য। বাহারি ইফতারে রয়েছে বৈচিত্র্যতা।
চালচলনে ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রভাব থাকেলও ধর্মীয় ব্যাপারগুলোতে তুর্কিরা এখন রক্ষণশীল। রোজা এবং ইফতারকে তারা বেশ আন্তরিকভাবেই পালন করে থাকে। এজন্যে বেশ বর্ণাঢ্য আয়োজন থাকে তুর্কি ইফতারে। ইফতারের লিস্টে থাকে বিখ্যাত পাইড নামক রুটি, মেজ্জুল জাতের খেজুর, কাল এবং সবুজ জলপাই, বিভিন্ন ধরনের পনীর, পাস্তিরমাহ (মসলাই গরুর মাংস), সসেজ, ফলমূল, সব্জি ও মধু।
ইন্দোনেশিয়া
জনসংখ্যা বিবেচনায় ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। শুধু তাই নয় ইসলামী রক্ষণশীল নীতিগুলোর বিধি-বিধানও এখানে কার্যকর রয়েছে। রমজান মাসে ইফতারের টেবিলে ইন্দোনেশিয়াতেও থাকে নান্দনিক খাবারের পসরা।
ইন্দোনেশিয়ায় ইফতারকে বুকা পুয়াসা বলা হয়। সেখানেও বেদুক বাজানোর মাধ্যমে ইফতারের সময় নিশ্চিত করা হয়। আছরের নামাজের পর ঐতিহ্যবাহী বাজারগুলোতে বিভিন্ন ইফতার আইটেম বিক্রি হয়। দেশটির মানুষজন খাবারের ক্ষেত্রে বেশ সচেতন। তাদের খাবারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা মসলা ছাড়া খাবার বেশি পছন্দ করে। ইফতার সামগ্রীর ক্ষেত্রেও ঠিক একই রীতি দেখা যায়। মেন্দোয়ান’ নামক একটি খাবার ইন্দোনেশিয়ার ইফতারে বেশ জনপ্রিয়। মেন্দোয়ান কিছুটা আমাদের দেশের পিঁয়াজুর মতো। একটু ভারী খাবার হিসেবে থাকে সেতো পাং কং (সামুদ্রিক মাছ দিয়ে তৈরি খাদ্য), পাকাথ (একধরনের সবজি), সাতে সুসু (গরুর মাংস দ্বারা তৈরি), কিস্যাক (সিদ্ধ চাল দ্বারা তৈরি খাবার) ইত্যাদি।
মিশর
বিশ্বের প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মিশর। ইসলামী রীতিনীতিগুলো ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে পালিত হয় এদেশে। তাছাড়া ইসলামের প্রতি এদেশের মানুষের রয়েছে গভীর ভালবাসা। সংস্কৃতিতেও মিশে আছে ইসলামী রীতিনীতি।
রমজান মাসে ইফতারের পসরা সাজিয়ে বসে যান দোকানিরা। সাধারণত খেজুর মুখে দিয়েই রোজা শেষ করে মিশরের মুসলমানরা। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের বাহারি খাবার তো রয়েছেই। প্রধান প্রধান ইফতার সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে কোনাফা ও কাতায়েফ (আটা, মধু, বাদাম ও কিসমিসের সমন্বয়ে তৈরি কেক জাতীয় খাদ্য বিশেষ), ককটেল খুশাফ, মলোকিয়া, খেজুর ইত্যাদি।
ইফতারের টেবিলে মিশরের বিখ্যাত একটি পানীয় হচ্ছে ‘কামার আল দিনান্দ আরাসি’। শুকনা আখরোট সারাদিন পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। এরপর এর সাথে মধু মিশিয়ে তৈরি করা হয় কামার আল দিনান্দ আরাসি। ‘খাবোস রমজান’ নামক একধরনের রুটি মিশরে বেশ জনপ্রিয়। এটি কিছুটা অর্ধচন্দ্রাকৃতির হয়ে থাকে। মিশরীয়রা বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে একসাথে ইফতার করতে পছন্দ করেন।
মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়ায় সাধারণত খেজুর দ্বারা রোজা ভাঙ্গে মুসলমানরা। ইফতারে এখানে শুকনা খাবার বেশি জনপ্রিয়। এছাড়া বেশকিছু দেশীয় আইটেম তো থাকেই। মালয়েশিয়ার লোকদের একটি স্থানীয় ইফতারে আইটেমের নাম হচ্ছে ‘বারবুকা পুয়াসা’। এটা আখের রস এবং সোয়াবিনের দুধ দ্বারা তৈরি একধরনের বিশেষ মিষ্টান্ন সামগ্রী। এছাড়া মালয়েশিয়ার ইফতারে থাকে নাসি আয়াম, পপিয়া বানাস, আয়াম পেরিক, লেমাক লাঞ্জা ইত্যাদি।
মালয়েশিয়ায় মসজিদ থেকে রোজাদারদের ‘বুবুর ল্যাম্বাক’ নামক একটি খাবার বিনামূল্যে দেওয়া হয়। চাউল, মাংস, নারিকেলের দুধ, ঘি ইত্যাদি দিয়ে বুবুর ল্যাম্ব্যাক তৈরি করা হয়। প্রায় পাঁচ দশক আগে কুয়ালালামপুর কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে এই খাবারটি বিতরণের প্রচলন শুরু হয়।
আরব আমিরাত
আরব বিশ্বের অন্যতম দেশ আরব আমিরাত। এ দেশের সংস্কৃতি এবং কালচার অনেকটাই ইসলামের পূণ্যভূমি সৌদি আরবের ন্যায়। অন্যান্য আরব দেশগুলোর মত এদেশেও ইফতারের সময় জানান দেওয়া হয় কামান দাগানোর মাধ্যমে। এই কামানকে বলা হয় ‘মিদফা আল-ইফতার’ বা ‘ইফতারের কামান’।
‘হারিরা’ নামক একপ্রকার খাবার দুবাইয়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। হারিরা তৈরি হয় ভেড়ার মাংস ও মসুরের ডালের সমন্বয়ে। এছাড়া ‘মালকুফ’ (মাংস ও ভেজিটেবল রোল) বেশ জনপ্রিয়। ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি ‘ওউজি’, কউশা মাহসি (মাছ দিয়ে তৈরি একধরনের খাবার) দুবাইয়ের ইফতার আয়োজনে বেশ গুরুত্ব পায়। মিষ্টান্ন হিসেবে দুবাইয়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ‘কুনাফেহ’। আরব আমিরাতে কুনাফেহ ছাড়া ইফতার কল্পনাও করা যায় না। কুনাফেহ চীজ সহকারে তৈরি একধরনের পেস্ট্রি।
ইরান
পৃথিবীর একমাত্র শিয়া অধ্যুষিত দেশ ইরান। দেশটিতে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য এবং উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গেই পালিত হয় রমজান মাস। রমজান মাসে ইফতারের টেবিলে থাকে বাহারি সব খাবারের পসরা। ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানের ইফতার সামগ্রীতে ফলমূল এবং মিষ্টান্ন সামগ্রী একটু বেশি গুরুত্ব পায়। দেশটিতে ইফতার সামগ্রীতে ফল হিসেবে খেজুর, আপেল, চেরি, আখরোট, তরমুজ, তেলেবি, আঙ্গুর, কলা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া মিষ্টান্ন সামগ্রীর মধ্যে মধু, পনির, দুধ, রুটি, চা উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া ইরানের রয়েছে ঐতিহ্যবাহী জিলাপি। যদিও এই জিলাপির স্বাদ আমাদের দেশের জিলাপির মতো নয়। ইরানের ‘শোলে জার্দ’ নামক একটি খাবার বেশ জনপ্রিয়। চিনি, ছোট চাল, আর জাফরান দিয়ে এই খাবারটি রান্না করা হয়। ইরানের ১২ ইমামের একজন হচ্ছেন ইমাম রেজা (আঃ)। ইমাম রেজা (আঃ) এর মাজার কমপ্লেক্সের পাশে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এই ইফতার মাহফিলটিতে প্রায় তিন লাখ লোক অংশগ্রহণ করেন।
পাকিস্তান
অন্যতম মুসলিম প্রধান দেশ পাকিস্তান। রমজান মাসে এদেশের ইফতারের টেবিলেও থাকে হরেক রকমের খাবার। রুটি এবং মাংস পাকিস্তানীদের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। রমজান মাসে ইফতারের ক্ষেত্রেও এ খাবারটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া ইফতারের টেবিল সাজাতে আরও গুরুত্ব পায় টিক্কা সমুচা, ব্রেড রোল, চিকেন রোল, তান্দুরি কাটলেট, নুডুলস কাবাব, সুফিয়ানী বিরিয়ানি, গোলাপী কাবাব ইত্যাদি।
মিষ্টান্ন হিসেবে বিভিন্ন খাবার স্থান পায় সেদেশের ইফতার টেবিলে। যেমন- বিভিন্ন ধরনের ফলমূল, সালাদ, করাচি ফালুদা ইত্যাদি। ঝাল জাতীয় খাবারের মধ্যে রয়েছে নিমকি, সমুচা পরোটা ইত্যাদি।
ভারত
ভারতীয়দের ইফতার সামগ্রীতে মুঘলদের প্রভাব স্পষ্ট। প্রত্যেকটি খাবারের ক্ষেত্রেই মুঘলদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে দেখা যায়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে ইফতারের বৈচিত্র্য রয়েছে। যেমন- হায়দ্রাবাদে ইফতার হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হালিম। তামিলনাড়ু ও কেরালায় ‘কাঞ্জি’ ছাড়া যেন ইফতার জমেই না। এটি তৈরি হয় ভাত, খাসির মাংস, মসলা ও সবজি দিয়ে।
ভারতের ইফতার সামগ্রীর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পনীরযুক্ত খেজুর, ডালের কাবাব, বটি কাবাব, খাসির মগজ এর কাটলেট, চিকেন শর্মা, কিমা সমুচা, খাসির লেগ রোস্ট, লাহোরি মাটন ইত্যাদি লোভনীয় খাবার। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের স্যুপ, পরোটা, রুটি, তরকারি ইফতারের টেবিলে বেশ গুরুত্ব পায়।
This is a Bengali article. It’s about different types of iftar in Muslim world
All necessary reference arehyperlinked inside article.