২০১৩ : ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল ছিলো নেটফ্লিক্সের জন্য ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়। ২০১৩ সাল থেকেই মূলত শুরু হয় নেটফ্লিক্সের অগ্রযাত্রা। এই বছর এবং তার পরবর্তী সময়ে নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর বদৌলতে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নেটফ্লিক্স ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যায় এবং স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের জন্য মানদণ্ড স্থাপন করে। অগ্রযাত্রার পথে তাদের প্রথম পদক্ষেপ কি ছিলো জানতে চান? সেটি হলো তারা মুভি এবং টিভি ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
২০১৩ সালে আমরা প্রথমবারের মত নেটফ্লিক্সকে নিজেদের অরিজিনাল কন্টেন্ট তৈরীর প্রতি মনোযোগী হতে দেখি৷ তাদের প্রথম কন্টেন্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে হাই প্রোফাইল পলিটিক্যাল ড্রামা হাউজ অফ কার্ডস। আর এই হাউজ অফ কার্ডস-ই ছিলো কোম্পানি হিসেবে নেটফ্লিক্সের জন্য টার্নিং পয়েন্ট। দর্শক এবং সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে এটি৷ নেটফ্লিক্সও নিজেদের কন্টেন্ট তৈরীর ফলাফল কেমন হতে পারে তার উদাহরণ দেখতে পায় সরাসরি। এর ফলশ্রুতিতে তারা টানা নিজেদের অরিজিনাল কন্টেন্ট বানানোর এবং এগুলোকে নিজেদের প্ল্যাটফর্মে প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয়। যত নতুন শো তারা নিয়ে আসে, ততই নতুন গ্রাহক তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আর এই আকর্ষণের ফলে তাদের সাবস্ক্রাইবার বাড়ে এবং মুনাফাও বাড়তে থাকে ক্রমাগত। এরপর তাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি, পরবর্তীকালে কেবলই এগিয়ে চলার গল্প। ২০১৩ এর শেষ নাগাদ নেটফ্লিক্সের গ্রাহক সংখ্যা হয় ৪৪ মিলিয়ন, যেটি আগের বছরের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। এবং তাদের মোট মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪.৩ বিলিয়ন, যেটি আগের বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি।
এবছরই নেটফ্লিক্স অ্যাপল টিভিতে সীমিত সময়ের জন্য লঞ্চ হয় এবং এসময় ইউজার প্রোফাইল বানানোর সুযোগ দেওয়া হয় গ্রাহকদের। পরবর্তীতে আগস্ট নাগাদ সকল গ্রাহককেই এই ফিচার ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া হয়।
২০১৫ : নেটফ্লিক্স এবছর উন্মোচিত করে সম্ভাবনার নতুন দ্বার। এই বছরই তারা মুক্তি দেয় তাদের ১ম ফিচার ফিল্ম ‘বিস্টস অফ নো নেশন‘। ৬ বিলিয়ন ডলার বাজেটের এই সিনেমার গল্প ছিলো একজন শিশু যোদ্ধার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যুদ্ধের ভয়াবহতার বর্ণনা নিয়ে। এটি বক্স অফিসে তেমন ভালো করতে পারে নি। দেশব্যাপী মাত্র ৫০ হাজার ডলার আয় করে এটি। তবে নিজেদের স্ট্রিমিং সার্ভিসে এটির পার্ফম্যান্সে সন্তুষ্ট ছিলো নেটফ্লিক্স। এই চলচ্চিত্রই আবার নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় নেটফ্লিক্সকে। এবার তাদের প্রতিপক্ষ ছিলো প্রধান সিনেমা থিয়েটারগুলো। এটি মুক্তির পরপরই তারা এটিকে বয়কট করে। কারণ একই সাথে স্ট্রিমিং সাইট এবং সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়ার ফলে ৯০ দিন ধরে সিনেমা হলে একটি মুভি চালানোর অধিকারের লঙ্ঘন হয়েছে বলে তারা দাবী করে।
২০১৬ : এবছর নেটফ্লিক্সের সফলতার মুকুটে যুক্ত হয় আরো একটি পালক। একসাথে ১৩০টি দেশে নেটফ্লিক্সের স্ট্রিমিং শুরু হয়। ফলে রাতারাতি একটি আমেরিকান কোম্পানি থেকে তারা পরিণত হয় বৈশ্বিক কোম্পানিতে। এবছর আরো ৭ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার যুক্ত হয় এই কোম্পানিতে। আর বছর শেষে তারা রেকর্ড সংখ্যক ৫৪টি মনোনয়ন লাভ করে ৬৮তম এমি অ্যাওয়ার্ডসে। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যামাজন প্রাইম পেয়েছিলো কেবল ১৬টি মনোনয়ন।
২০১৭ : এবছরে নেটফ্লিক্সের গ্রাহক সংখ্যা আমেরিকান ক্যাবল টিভি গ্রাহকের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এখানেই থেমে থাকে না তারা। এবছর তারা ৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করে নিজস্ব কন্টেন্টের পেছনে। যেটি আগের বছরের তুলনায় ২ বিলিয়ন বেশি। ২০১৭ এর চতুর্থ কোয়ার্টারে এসে নেটফ্লিক্সে যুক্ত হয় আরো ৮.৩ বিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার। যেটি আগের বছরের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেশি।
অ্যামাজন প্রাইম, এইচবিও ম্যাক্স, হুলুসহ অন্যান্য নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী এলেও স্ট্রিমিং জগতে নেটফ্লিক্স এখনো মুকুটহীন সম্রাট। ২০১৮ তে তাদের মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের পরিমান দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। যেটি কেবল এটিঅ্যান্ডটি, কমকাস্ট এবং ডিজনির চেয়ে কম। ২০১৯ সালেও তরতর করে এগিয়েছে তারা। ২০২০ সালে কোভিড প্যান্ডেমিকের সময় সিনেমা হলগুলোতে নতুন সিনেমার মুক্তি এবং দর্শকের আগমন বন্ধ থাকলেও নিত্যনতুন কন্টেন্ট এসেছে নেটফ্লিক্সে। ২০২১ সালেও তাদের কন্টেন্টে বিনিয়োগ চলছেই।
নেটফ্লিক্সের জায়ান্ট কোম্পানিতে পরিণত হওয়ার পেছনে হাউজ অফ কার্ডসের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এর পাশাপাশি তারা প্রডিউস করেছে স্ট্রেঞ্জার থিংস, ব্ল্যাক মিরর, থার্টিন রিজনস হোয়াই, সেক্স এডুকেশনের মত শো। অফিস স্থাপন করেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। নার্কোস, লা কাসা ডি পাপেল, ডার্ক, সেক্রেড গেইমসের মত ভিন্ন ভাষার সিরিজগুলোকে জনপ্রিয় করেছে সারা বিশ্বে। যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী একটি আবেদন সৃষ্টি হয়েছে তাদের৷ ট্র্যাডিশনাল সিনেমার পাশাপাশি তাদের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে অ্যানিমেটেড সিনেমা, কার্টুন এবং তাদের স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে এসেছে অ্যানিমেও। ফলে নানা ভাষার এবং নানা ধারার দর্শক গ্রাহক হয়েছে তাদের৷ বিশ্বের গুটিকয়েক দেশ ছাড়া সবগুলো দেশেই আছে তাদের প্রবেশাধিকার। নিজেদের সাথে তারা যুক্ত করেছে মার্টিন স্করসেজি, ডেভিড ফিঞ্চার, আনুরাগ কাশ্যপের মত পরিচালককে। কাজ করেছে ইন্ডি সিনেমাকে মানুষের কাছে পৌঁছাতেও। কিছুদিন আগেও নেটফ্লিক্সের অরিজিনাল কন্টেন্ট কুইন’স গ্যাম্বিট আলোড়ন তুলেছিলো।
এবার আসুন দেখি নেটফ্লিক্স কেন এত জনপ্রিয়? ঠিক কোন জায়গায় তারা ইউনিক?
গত বছর অর্থাৎ, ২০২০ সালেও নেটফ্লিক্স প্রায় ১৫.৮ মিলিয়ন নতুন সাবস্ক্রাইবার পেয়েছে। বছরের শুরুতে তাদের অনুমান ছিলো তারা সে বছর ৭ মিলিয়নের কিছু বেশি সাবস্ক্রাইবার পেতে পারে। কিন্তু বছর শেষে দেখে তারা যা আশা করেছিলো তার চেয়ে দ্বিগুণ বেশি গ্রাহক পেয়েছে!
মূলত মানুষ যেভাবে কোন শো দেখতো, তার পুরো প্রক্রিয়াটাই পাল্টে দিয়েছে। আসুন জেনে নিই তাদের জনপ্রিয়তার পেছনের মূল কারণগুলো :-
১. নেটফ্লিক্সের হাতে এত বেশি শো বা মুভি আছে যে তারা যদি ৫ মাস কোনকিছু নাও বানায়; তাও তাদের কন্টেন্টের কোন অভাব হবে না। কিন্তু তারা বসে নেই। নতুন নতুন কন্টেন্ট যুক্ত করে চলেছে নিজেদের লাইব্রেরিতে।
২. নেটফ্লিক্স শুরু থেকেই কোন সিরিজের পুরো সিজনই একসাথে রিলিজ করে। এতে করে মানুষকে এক এপিসোড দেখে পুরো এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয় না নতুন এপিসোডের জন্য, টানা দেখে ফেলা যায় পুরো সিজন।
৩. নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রিপশন ফী কম। ১০ ডলারের কম খরচেই পুরো মাসের জন্য নেটফ্লিক্স সাবস্ক্রিপশন কিনে ফেলা যায়। এছাড়া এখানকার বেশিরভাগ শো-ই আপনি ডাউনলোড করে ফেলতে পারবেন এবং অফলাইনে দেখতে পারবেন।
৪. নেটফ্লিক্স তার ব্যবহারকারীদের ক্রস-প্ল্যাটফর্ম সাপোর্ট প্রদান করে। ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় এমন যেকোন ডিভাইসে নেটফ্লিক্সের শো দেখতে পারবেন আপনি। ফলে একই অ্যাকাউন্ট দিয়ে বাসায় পিসি বা টিভিতে অথবা কোথাও গেলে মোবাইল ফোনেই আপনি দেখতে পারবেন আপনার প্রিয় মুভি বা সিরিজ।
৫. নেটফ্লিক্সে কোন কমার্শিয়াল ব্রেক নেই। ফলে ২০ মিনিটের কোন এপিসোড দেখতে আপনাকে ১০ মিনিট অ্যাড দেখে অপচয় করতে হবে না।
৬. নেটফ্লিক্সে যেসব শো আছে, সেগুলো আপনি যেকোন সময় দেখতে পারবেন। এজন্য কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে টিভির সামনে বসার তাড়া নেই। ফলে একজন ব্যবহারকারী সহজেই তার কাজ শেষ করে নেটফ্লিক্সের শো উপভোগ করতে পারেন।
চলুন এবার দেখা যাক কোন বয়সের মানুষজন সবচেয়ে বেশি নেটফ্লিক্স ব্যবহার করেন :-
২০২০ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নেটফ্লিক্স সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। ১৮-২৯ বছর এবং ৩০-৪৪ বছর বয়স সীমার মানুষদের মধ্যে শতকরা ৬৫ ভাগ মানুষেরই নেটফ্লিক্স অ্যাকাউন্ট রয়েছে। অন্যদিকে ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষদের মধ্যে এই হার ৪১%।
নেটফ্লিক্সের সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে আমেরিকায়। ২০২১ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায় ২০২৩ সালের মধ্যে আমেরিকায় নেটফ্লিক্স ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৯.১ মিলিয়নে। ব্যবহারকারীদের সংখ্যার দিক থেকে আমেরিকার পরের স্থানগুলোতে রয়েছে যথাক্রমে ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য, মেক্সিকো, ফ্রান্স এবং কানাডা।
নেটফ্লিক্স বাংলাদেশে অফিশিয়ালি না এলেও বাংলাদেশীরাও এই স্ট্রীমিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা থেকে পিছিয়ে নেই। ক্রেডিট কার্ড মালিকরা সহজেই তাদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে নেটফ্লিক্সের মাসিক বা বাৎসরিক প্ল্যানে সাবস্ক্রাইব করতে পারেন। যাদের ক্রেডিট কার্ড নেই, তারা বিভিন্ন থার্ড পার্টির মাধ্যমে নেটফ্লিক্স অ্যাকাউন্ট কিনে থাকেন। এক্ষেত্রে তাদেরকে সবসময় একটা নির্দিষ্ট খরচ করতে হয়। ফলে এক্ষেত্রে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশী খরচ হয়।
এই বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে দেশী কন্টেন্টও স্থান করে নিয়েছে। নেটফ্লিক্সের বাংলাদেশী কন্টেন্টগুলো হলো কমলা রকেট (২০১৮) এবং ইতি, তোমারই ঢাকা (২০১৮)।
This is a Bangla article. Everything is written here about theNETFLIX
All links are hyperlinked.
Featured image taken fromGoogle